কাজী আবুল মনসুর ::
ইতিহাসবিদ আবদুল হকের লেখা দিয়ে শুরু করি। তিনি তার একটি বইতে চট্টগ্রামের ইংরেজদের নিয়ে এভাবে লিখেছেন, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল ব্যবসা করতে। কাচ কুড়াতে এসে বিধাতা তাদের আঁচলে মাণিক বেঁধে দিলেন। পলাশী যুদ্ধের পরে কোম্পানি এ দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে তারা দেশের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নিল। সাক্ষী গোপাল নবাব মির জাফরকে সরিয়ে ১৭৬০ সালে কোম্পানি তাঁর জামাতা মির কাসিমকে গদিতে বসালো। মির কাসিমকে ঘুষ দিতে হলো বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার রাজস্ব আদায়ের অধিকার। অবশ্য মির কাসিমের সঙ্গে সন্ধির শর্ত ছিল এ জেলাগুলির খাজনা থেকে কোম্পানি দেশবাসীর জন্য সেপাহি রাখার খরচ পুষিয়ে নেবে। মির কাসিম প্রত্যেক জেলা সম্বন্ধে একখানা পৃথক সদন কোম্পানিকে দিলেন। অনেকদিন আগে থেকেই কোম্পানির নজর পড়েছিল চাটগাঁর দিকে। কলিকাতা বন্দর তখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। কোম্পানির দৃষ্টি ছিল সর্বক্ষণ কারবারের মুনাফার দিকে।তারা মনে করত একবার চাটগাঁর বন্দরে জাকিয়ে বসতে পারলে তাদের কায়কারবারের সুরাহা হবে। ১৭৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে কোম্পানি চট্টগ্রাম শাসনের জন্য এক কাউন্সিল নিযুক্ত করলো। ভেরলেস্ট হলেন এই কাউন্সিলের চিফ। অন্যান্য সদস্য ছিলেন ওয়াল্টার উইনকিন্স, টমাস রামবোল্ট ও র্যানডলফ ম্যারিয়েট। ভেরলেস্ট তখন কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে সকলের চেয়ে সিনিয়র। পরে ১৭৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বাংলাদেশের গভর্নর হন ও এই পদে তিন বৎসর বহাল থাকেন। ১৭৬১ সালের ৩ জানুয়ারি ভেরলেস্ট সীতাকুণ্ড থেকে তাঁর চাটগাঁ পৌছার সংবাদ কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানান। এর দু’দিন পরে সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খান থেকে ইসলামাবাদের কার্যভার গ্রহণ করেন।’
এই ভেরলেষ্ট সাহেব তার সাথে নিয়ে আসেন গোকুল ঘোষাল নামের এক ধুর্ত মানুষকে। যার ধুতার্মির কাছে হেরে যায় ইংরেজরাও। ইংরেজদের ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন এই গোকুল। আবার এই গোকুলের কারনে অনেক ইংরেজ লাট চট্টগ্রামে লুটপাট চালিয়েছেন। এই গোকুল ছিলেন কলকাতার খিদিরপুরের বাসিন্দা। চট্টগ্রামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরুর প্রথম চীফ হ্যারি ভেরেলেষ্টের দেওয়ান হিসেবে ছিলেন গোকুল। চট্টগ্রামের প্রথম দেওয়ান। গোকুল ঘোষাল ছিলেন ভেরলেস্ট সাহেবের অতি প্রিয় কর্মচারী। তাকে সামনে রেখে শাসন করেছিলেন ভেরেলস্ট। ১৭৭১ সালের কোম্পানির রাজস্বের হিসাব থেকে জানা যায় গোকুল ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র জয়নারায়ণ ঘোষাল চট্টগ্রাম ও বর্ধমান জেলার সাত লক্ষ টাকা খাজনার জমিদারি ভোগ করতেন। কোম্পানির সাথে সম্পর্ক থাকার কারনে তাঁরা প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। গোকুল প্রথম নজর দেয় চট্টগ্রামের দ্বীপ সন্দ্বীপের দিকে। এ সময় সন্দ্বীপের জমিদার সুপরিচিত দিলাল খাঁর বংশধর আবু তোরাব চৌধুরীর সঙ্গে গোকুলের বিরোধ বাধলে কোম্পানির দাপটে গোকুল তাকে সর্বশান্ত করার পরিকল্পনা নেয়। গোকুলের চক্রান্তে হতভাগ্য আবু তোরাবকে রাজবিদ্রোহী বলে ঘোষণা করা হয়। রাজবিদ্রোহী ঘোষনার পর পরই গোকুল কোম্পানির সেনা নিয়ে আবু তোরাবের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন নলীকিনস সেনা নিয়ে আবু তোরাবের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। আবু তোরাব তাঁর কৃষক সৈন্য নিয়ে নলীকিনসের মুখোমুখি হন। কিন্ত গাদা বন্দুকের সামনে কৃষক নিয়ে যুদ্ধে টিকতে পারেনি আবু তোরাব। বীরের মত সম্মুখসমরে প্রাণ বিসর্জন দেন। গোকুল সন্দীপ দখল করেন। ইংরেজ সহায়তায় আবু তোরাবের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আবু তোরাবের সমস্ত জমিদারি গোকুল তাঁর কর্মচারী ভবানী চরণের বেনামিতে বন্দোবস্ত করেন। গোকুলের ভ্রাতুষ্পত্র জয়নারায়ণ হন সন্দ্বীপের কানুনগো ও লবণের ইজারাদার। তাঁদের কর্মচারি ভবানী চরণ তখন সন্দ্বীপের নায়েব ওহদাদার। মোটকথা, গোকুল ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র জয়নারায়ণ তখন সন্দ্বীপের সর্বময় কর্তা। জয়নারায়ণ সন্দ্বীপের বাকি জমিদার বখতার ও মোহাম্মদ হানিফের জমিদারি নিলাকে কিনে নেন। এরূপে ছলে বলে কৌশলে গোকুল ঘোষাল সন্দ্বীপের সকল জমিদারির মালিক হন। গোকুলের বিষয়ে ঐতিহাসিক আবদুল হক চৌধুরী এভাবে তার লেখনিতে উল্লেখ করেন,‘অতঃপর গোকুল ও তার কর্মচারীরা সন্দ্বীপের প্রজাদের উপরে শুরু করেন অকথ্য অত্যাচার। প্রজারা ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়লো। অত্যাচার চরম পর্যায়ে উঠলে প্রজারা খাজনা বন্ধ করে দিল। ততদিনে কোম্পানির টনক নড়লো। ১৭৭৮ সালে মি. ডানকান স্থানীয় তদন্ত করতে সন্দ্বীপে প্রেরিত হলো। দীর্ঘকাল সন্দ্বীপে অবস্থান করে মি. ডানকান বিস্তারিত রিপোর্ট নেন। এই রিপোর্টের বলে গোকুল ও তাঁর সহকর্মীরা যে সকল জমিদারি অন্যায়ভাবে দখন করেছিলেন সেগুলি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন।গোকুল তার কর্মচারী ভবানী চরণের নামে বাখরগঞ্জের ও সেলিমাবাদ পরগণায় যশোহর জেলায় অনেক জমি বন্দোবস্ত নেন। ঝালকাঠিতে তাঁর জমিদারি কাছারি ছিল। ত্রিপুরা জেলার পাটিকারা পরগণাতেও ঘোষালদের অনেক ভুসম্পত্তি ছিল।১৭৬৫ সালে ভেরলেস্ট বর্ধমানে সুপারভাইজার নিযুক্ত হন। এই সময় বর্ধমান জেলার এক-তৃতীয়াংশ জমি বন্দোবস্ত নেন। এ সময়ে রামবোল্ট পাটনার সুপারভাইজার ও ভেরলেস্ট বাংলাদেশের গভর্নর। স্পষ্ট দেখা যায়, গোকুলের এই দুই মুরব্বি-যারা চট্টগ্রামে তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেনÑতারাই এই সকল জমিদারি লাভে তাকে সাহায্য করেছিলেন। চট্টগ্রাম কাউন্সিল ১৭৬১ সালের ১২ মে ঘোষণা করেন যে যারা জঙ্গল পরিষ্কার করে পতিত জমি আবাদ করবে তাদের পাঁচ বৎসরতক কোন খাজনা দিতে হবে না।গোকুল ঘোষাল তখন কালেক্টরির দেওয়ান। তার দায়িত্ব কোম্পানির হুকুম সকলকে জানিয়ে দেওয়া। পাছে তার নিজের আয়ে ঘাটতি ঘটে এই কারণে সুচতুর গোকুল ঘোষাল কোম্পানির হুকুম কাউকে জানতে দেননি। গোকুল ঘোষাল এক জাল সনদ দেখিয়ে দাবি করেন যে, ভেরলেস্ট তার ভাতিজা জয়নারায়ণ ঘোষালকে চাটগাঁর সমন্ত অনাবাদী জমি বন্দোবস্ত দিয়েছেন। এই সনদের বলে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত দুইশত জন জমিদারের কাছে পতিত জমি বন্দোবস্ত দিয়ে জয়নারায়ণ অনেক খাজনা আদায় করেন। জয়নারায়ণ নিজে কিন্তু এক ছটাক জমিরও জঙ্গল পরিস্কার করান নি। কোম্পানি কাগজপত্র থেকে দেখা যায় ১৭৬৭ সালে জয়নারায়ণ পাঁচ হাজার ৮৭১ টাকা খাজনা দিয়ে তিন হাজার ৮৬৩ দ্রোন জমি ভোগ করতেন। এর মধ্যে মাত্র ৬৯২ দ্রোন জমিতে ফসল ফলত। বাকি জমিতে তখন জঙ্গল ছিল। যারা জঙ্গল পরিস্কার করে ফসল ফলাতো জয়নারায়ণ জাল সনদের বলে তাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। এইরূপে কোম্পানির ঘোষণা অনুযায়ী যারা বিনা খাজনায় পাঁচ বছর জমি ভোগের দাবিদার ছিলেন তারা গোকুলের চক্রান্তে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
আশ্চর্যের বিষয় এই, সনদ যে জাল তা কারেক্টরগণ বহু বছর ধরতে পারেননি। ছত্রিশ বছর পরে চাটগাঁর কালেক্টর রিপোর্ট করেন যে গোকুল ঘোষালের সনদ জাল। উক্ত সনদের তারিখ দেওয়া ছিল ১৭৬০ সালের ১২ মে। চাটগাঁ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে আসে ১৭৬১ সালের প্রথম থেকে। কাজেই কেমন করে ভেরলেস্ট এর আগের বছরে সনদ দিতে পারেন? জাল সদনে ছিল ভেরলেস্ট সাহেবের প্রাইভেট ছাপ। এতে ছিল না ভেরলেস্ট সাহেবের নিজের কোন দস্তখত অথবা সরকারি মোহরের ছাপ। সরকারি কাগজপত্রেও এই জাল সনদের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।এই সনদ যে জাল ছিল সে কথা বুঝা যায় আর এক ব্যাপার। ১৭৬৩ সালে জয়নারায়ণ ঘোষাল কালেক্টর থেকে অনেক পতিত জমি বন্দোবস্ত নেন। জাল সনদ মোতাবেক জয়নারায়ণ চাটগাঁ জেলার সকল জমির মালিক। কাজেই তাঁর পক্ষে আর এক সনদের বলে পতিত জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার কোন দরকারই ছিল না। অবশেষে সনদ জাল প্রমান হলে জয়নারায়ণের উত্তরাধিকারী থেকে সমস্ত জমি ফেরৎ নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে কিন্তু তারা চল্লিশ বছর সমস্ত জমির উপস্বত্ব ভোগ করেছেন। প্রশ্ন ওঠে, গোকুল ঘোষালের দাখিল করা সনদ জাল বলে ধরা পড়তে এত দীর্ঘসময় লাগল কেন? মনে হয়, যে সনদ গোকুল ঘোষালের হাতে ছিল তাতে হয়তো ১৭৬১ সালের তারিখ ছিল। পরে সনদ হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হলে জাল সনদ তৈরি করে সরকারের কাছে দাখিল করা হয়। বহু বছর পরে জাল করতে গিয়ে যে সকল হিন্দু মোহরার দলিল জাল করেছিল তারা হিজরি বছরের হিসাব ঠিক করতে পারেনি। কাজেই ভুলক্রমে তারা উক্ত জাল দলিলে ১৭৬০ সালের হিজরি বছরের উল্লেখ করেছিল। ভেরলেস্ট সাহেব গোকুল ঘোষাল ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র জয়নারায়ণকে বাংলা ও বিহারের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় যেভাবে জমিদারি, পতিত জমি, নিমক মহাল ইত্যাদি বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন তাতে মনে হয় তিনি গোকুল ঘোষালের হাতের পুতুল ছিলেন। কাজেই তাঁর প্রাইভেট মোহর বোধ হয় গোকুলের জিম্মায় ছিল ও তিনি উক্ত মোহর যত্রতত্র ব্যবহার করতেন।
চট্টগ্রামের উপর শোষন, অত্যাচার চালালেও ভেরলেস্ট ১৭৬৯ সালে রিপোর্ট করেন যে, গোকুল ঘোষাল রাজস্ব বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে মোগল সম্রাট জাহানদার শাহ জয়নারায়ণ ঘোষালকে মহারাজা বাহাদুর উপাধিতে ভুষিত করেন। এই জয়নারায়ণ ঘোষালই ভূকৈলাস রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তারই সময়ে ভূকৈলাসের সুন্দর প্রাসাদটি নির্মিত হয়। গোকুল ঘোষালের মৃত্যু হয় ১৭৭৯ সালে। জয়নারায়ণ ঘোষাল ১৮২১ সালে মারা যান। বড়লাট লর্ড এলেনবরার সময়ে এই বংশের কালীশঙ্কর ঘোষালকে রাজা উপাধি দ্বারা সম্মানিত করা হয়। যে গোকুল ঘোষালের অত্যাচারে সন্দ্বীপে প্রজাবিদ্রোহ হয়, যে গোকুল জাল সনদের বলে চাটগাঁয় লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি দীর্ঘকাল অন্যায়ভাবে ভোগ করেছিলেন তাকেই সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট দেন বাংলার গভর্নর ভেরলেস্ট। গোকুল ঘোষালের উত্তরাধিকারই রাজা মহারাজার খেতাব পান বড়লাটদের সুপারিশে। চোরের মার বড় গলা আর কি!
জানা গেছে, ১৮১৫ সালের ৩০ আগষ্ট তৎকালিন কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালত গোকুল জাল সনদ দিয়ে ৩৯ বছর বিরাট ভু-সম্পত্তি ভোগ করেছেন বলে রায় দেয়া হয়! এ রায়ের মূলে ছিল ১৮০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতে আনীত একটি মামলা। তখন গোকুল ঘোষাল ছিল মৃত। জয় নারায়ন ঘোষাল সংসার ত্যাগ করে কাশীবাসী। মামলাটি দায়ের করেন গোকুলের বিধবা স্ত্রী রাজেশ্বরী দেব্যা এবং তিন বিধবা পুত্রবধূ হরিপ্রিয় দেব্যা, পার্বতী দেব্যা এবং হৈমবতী দেব্যা। জাল দলিলে চট্টগ্রাম বৃহত্তম জমিদারী তরফ জয়নগর খ্যাত এ ভু-সম্পত্তির পরিমান ১১ হাজার ৫৮৩ দ্রোনেরও বেশি। যার বছরে আয় ছিল তৎকালিন ৮২ হাজার ৩৩১ টাকা। জাল দলিলে ৩৯ বছর ধরে এ টাকা আয় করেছে গোকুল। ভাগ দিয়েছেন চট্টগ্রামের প্রথম চীফ হ্যারী ভেরেলষ্টকে!### ৪.১০.১৯