-- বিজ্ঞাপন ---

উত্তর কোরিয়াকে কেন্দ্র করেই কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ?

0

কাজী আবুল মনসুর

বিশ্বের আজব এক প্রেসিডেন্ট এর নাম কিম জং উন। তিনি উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট।  তার বাবার নাম কিম জং ইল। বাবার  চতুর্থ সন্তান তিনি। কথিত আছে কিম এমন একজন ব্যক্তি যার ভেতরে কোন দয়া মায়া নেই। কারন সংসদে তার ভাষনের সময় এক চাচাকে ঝিমুতে দেখে তিনি সহ্য করতে পারেননি। চাচাকে নির্মমভাবে কুকুর লেলিয়ে হত্যা করে। আরও শুনা যায় তার নামে কেউ উত্তর কোরিয়াতে নাম রাখতে পারে না। তারে চুলের কাটিং কেউ কাটতে পারেনা। এমনকি তার ড্রেস-আপও কেউ নকল করতে পারবে না। বলা হচ্ছে বর্তমান সময়ের এ পাগল প্রেসিডেন্টের কারনে বেধেঁ যেতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

উত্তর কোরিয়ার পরমাণু পরীক্ষায় চরম ক্ষুব্ধ প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এ পর্যন্ত পাঁচ দফা পরমাণু বোমা পরীক্ষা করেছে উত্তর কোরিয়া। এছাড়া, ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাও অব্যাহত রেখেছে দেশটি। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার দ্বন্ধ তুঙ্গে। আশংকা তৈরী হয়েছে যে কোন সময় যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে পারমানবিক হামলার হুমকি দিয়েছে উত্তর কোরিয়ার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান সাং রিয়ল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়া যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হবে না, এমনটা সহজেই চিন্তা করা যায়।

মাঝখানে ট্রাম্পের সাথে বৈঠক, দক্ষিন কোরীয় প্রেসিডেন্টের সাথে নানা দহরম মহরম সব কিছু হঠাৎ করে থমকে গেছে আবার। আগের অবস্থানে ফিরে গেছে উত্তর কোরিয়া। নিজের শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে উত্তর কোরিয়া জানান দেয় , তারা কোন কিছু পরিবর্তন করেনি।

উত্তর কোরিয়ার প্রায় ১০ লাখ ১০ হাজারের মতো কার্যক্ষম সেনাবাহিনী রয়েছে। দেশটির ৪০ লাখ ১০ হাজারের মতো সৈন্য মজুদ রয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতিতে তাদের কাজে লাগানো হবে। সংখ্যার দিক থেকে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী অনেক বড় এবং খুবই কার্যক্ষম। কর্মক্ষমতার দিক থেকে এ সেনাবাহিনীর অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। তাই স্বাভাবিকভাবে উত্তর কোরিয়া একটি হুমকি। নিকটবর্তী দেশগুলোর জন্য এ হুমকির মাত্রাটা একটু বেশি। উত্তর কোরিয়া যদি কোন রাষ্ট্রকে একবার আক্রমণ করে বসে, তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংসাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হবে।
শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তেই উত্তর কোরিয়ার প্রায় ১৩ হাজার বন্দুকধারী রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় উত্তর কোরিয়া ১০ লাখেরও বেশি স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার তথাকথিত অসামরিকীকৃত অঞ্চলে মার্কিন হামলা প্রতিরোধ করাই এই মাইন পুঁতে রাখার উদ্দেশ্য।
এদিকে জ্বালানি স্বল্পতার কারণে উত্তর কোরিয়ার নৌ ও বিমান বাহিনী কার্যকর বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার শক্তির এই আলোচনা দিনশেষে গড়াবে দেশটির পরমাণু সক্ষমতার ওপর। পরমাণু বোমা তৈরির সব ধরনের কাঁচামাল উত্তর কোরিয়ার রয়েছে। কারিগরি দুর্বলতার কারণে বোমা তৈরির এ উদ্যোগ দূরপাল­ার টর্পেডোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংয়ের ১০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সামরিক মহড়ায় দুটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে। পাঁচ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এ ক্ষেপণাস্ত্র দুটি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে আঘাত হানতে সক্ষম।
অতীত থেকে জানা যায়, অভিবক্ত কোরিয়া মূলত জাপানিদের দখলে ছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার সময় জাপানিরা সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার ফলে অভিবক্ত কোরিয়া ২ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালে সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে চলে যায়, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদি আমেরিকার মতাদর্শে এর পুঁজিবাদি ব্লকে যোগদান করে। তখন থেকে কোরিয়া দুটি ভিন্ন নাম যথা উত্তর ও দক্ষিণ তথা দুটি ভিন্ন অথনৈতিক ব্যবস্থাতে চলতে শুরু করে।
বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির অবস্থা আসলে কেমন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুব কঠিন। কেননা, দেশটি কখনো তাদের বাণিজ্যের পরিসংখ্যান জানায় না। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় চীনের সঙ্গে। ২০১৪ সালে উত্তর কোরিয়ার মোট বাণিজ্যের ৭৪ শতাংশই হয়েছে চীনের সঙ্গে। উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু প্রতিবেশী বিশ্বশক্তি চীন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বড় সহায়তাকারী ও বৃহৎ বাণিজ্য সহযোগীও চীন। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত কোরিয়া ট্রেড-ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সির হিসাব অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া চীনে কয়লা, খনিজদ্রব্য, পোশাক ও কিছু খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করে। আর চীন থেকে আমদানি করে পেট্রোলিয়াম গ্যাস, ইস্পাত, যন্ত্রাংশ, গাড়ি ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী। দক্ষিণ কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র উত্তরের পরমাণু পরীক্ষার পর তাদের শাস্তি দিতে যতই তৎপর হোক, চীন যে তা মেনে নেবে না, তা স্পষ্ট।
এদিকে বছর খানেক আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, শক্তি প্রদর্শন করে নতুন অস্ত্র পরীক্ষা থেকে উত্তর কোরিয়াকে বিরত রাখতে উত্তর কোরিয়ার উদ্দেশে একটি নৌবহর পাঠানো হয়েছে। ট্রাম্পের এ বক্তব্যের পরই দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার দিতে থাকে। পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কায় পড়ে গোটা বিশ্ব।
এ প্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান সাং রিয়ল জানিয়ে দিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া যদি বুঝতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে তাহলে, তা ঠেকাতে প্রয়োজনে নিজেরাই পরমাণু হামলা করবে।  রিয়ল দাবি করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যায়, তাহলে প্রথম দিন থেকেই তার দেশও পূর্নাঙ্গ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাবে এবং সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক ভিত্তিতে এই কার্যক্রম চলতেই থাকবে বলেও জানান তিনি। তবে, একই দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর শক্তির পরীক্ষা না নিতে উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করে দেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। তিনি বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অ্যামেরিকা কৌশলগত কারণে যে ধৈর্য্য এতোদিন দেখিয়ে এসেছে তা আর দেখানো সম্ভব হবে না।
তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করে, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস কার্ল ভিনসন ও বহরের অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ উত্তর কোরিয়ার দিকে যাচ্ছে না, বরং উল্টো দিকে যাচ্ছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, উত্তর কোরিয়ার দিকে না যাওয়ার বিষয়টি ‘ইচ্ছাকৃত ছলচাতুরি’ কিনা তা পরিষ্কার নয়। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে ভয় দেখানোর পরিকল্পনা করার পর সম্ভবত পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়েছে অথবা কোনো যোগাযোগ ব্যর্থতার কারণে এমন হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভাব্য পারমানবিক যুদ্ধের যে হুমকি দিয়েছে উত্তর কোরিয়া সে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পিয়ংইয়ং এর মিত্র বলে পরিচিত চীন। দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র লু কাং বলেছেন, উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি করে এমন যে কোন ধরনের কর্মকান্ড বা কথাবার্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তর কোরিয়ার কয়েকদিন ধরে চলা হুমকি পাল্টা হুমকির প্রেক্ষিতে  চীনের কাছ থেকে এমন মন্তব্য এলো। শুধু চীন কেন, বর্তমানে কেউই চায় না যে কোনো যুদ্ধ শুরু হয়ে যাক। বিশেষত, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক যুদ্ধের যে নির্মমতা ও ভয়াবহতা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে, এর পুনরাবৃত্তি হোক- শান্তিকামী মানুষ তা প্রত্যাশা করে না। তাই চীনের আবেদন, ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি।’

মুলত চীনের আবেদনের পর উত্তর কোরিয়ার সাথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৈঠক করে। দক্ষিন কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়। কিন্ত কোন একটা জায়গায় গিয়ে সম্পর্ক আর ঠিক থাকে নি। যে যার মতো আবারও অবস্থান নিয়ে রয়েছে।

এখন কোন পথে এগোচ্ছে আমেরিকা? আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় অঞ্চলে গত কয়েক দশকের অস্ত্রের খেলার পরও কি নতুন করে আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র খুলবে যুক্তরাষ্ট্র? একেকটি দেশ ও অঞ্চল বিধ্বস্ত হয়েছে, চিরদিনের জন্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আবার কোনো যুদ্ধেই পুরোপুরি জিততে পারেনি দেশটি। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত যুদ্ধের বাইরে গিয়ে সমাধান খুঁজে নেওয়া। কিন্তু চলমান সামরিক মহড়া, অস্ত্র বিক্রি ও  নানা উসকানিতে এটা আদৌ সম্ভব হচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। নতুন করে যোগ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান দ্বন্দ্ব। তেমে নেই তুরস্ক ও সিরিয়া।
তবে প্রবাদ আছে, রাজায় রাজায় লড়াই হয় উলু খাগড়ার প্রাণান্ত। বর্তমানে সে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আর উত্তর কোরিয়ার যে পেশী প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল তাতে অস্বস্তিতে ভুগছিল পুরো বিশ্ব। এটি থামতে না থামতে ভারত – পাকিস্তান, তুরস্ক-সিরিয়া লেগে গেছে।

বিশেষত আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের মানুষ এইসব যুদ্ধাযুদ্ধিতে নানা আশংকা বোধ করেন। কারণ, বেশিরভাগ ছোট দেশই বৃহৎ রাষ্ট্রের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছে যুদ্ধ নামের এই খেলার মধ্য দিয়েই। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে না ডরিয়ে পারে? এর কারণ হলো, শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে ছোট দেশগুলোর যুদ্ধোত্তর আত্ম-ভবিষ্যৎ চিন্তা করে যুদ্ধে না জড়িয়ে উপায় থাকে না। এভাবেই দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। এবার কি তবে তিন নম্বরটি ঘটতে চলেছে?###১৪.১০.১৯

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.