কাশ্মীর নিয়ে ভারত -পাকিস্তান মুখোমুখি। কাশ্মীরে বর্তমানে কি অবস্থা বিরাজ করছে তা জানার জন্য মুখিয়ে আছে সারা বিশ্ব। ভারত -পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত নিয়ে একাধিকবার যুদ্ধ হলেও এবারের বিষয়টি কেউ হালকাভাবে নিচ্ছে না। ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মির নিয়ে বড় ধরনের কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে কিনা তা নিয়ে সারা বিশ্বে চলছে জল্পনা কল্পনা। ভারত-পাকিস্তানের কার অবস্থা কি রকম..এ নিয়ে পাঠকদের জানার জন্য কয়েক সিরিজের প্রতিবেদন প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের সংবাদ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন বিষয়সহ পুরো বিষয়টি তুলে এনেছেন নির্বাহী সম্পাদক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম…প্রকাশিত হলো ৪র্থ পর্ব
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী এফ-১৬ বিমান দেয়া না দেয়াকে নিয়ে গত দু দশকেরও বেশী সময় যাবৎ চলে আসছে নানা টালবাহানা। একসময় এশিয়ায় দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিল পাকিস্তান। এশিয়ায় ইসলামাবাদের অপর ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের পাশাপাশি অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্রের বেশীর ভাগই যোগান দিত যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ভারতের বেশীর ভাগ আধুনিক সমরাস্ত্র আসত রাশিয়া থেকে। সময়ের সাথে সাথে সেই পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দু’ দেশের সম্পর্ক কখনও হয়েছে মধুর আবার কখনো বৈরী। সম্পর্কের খানিকটা অবনতি ঘটলেই যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্রের সরবরাহ স্থগিত কিংবা বন্ধ হয়ে যেতেও দেখা গেছে।
পাকিস্তানে পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমান সহায়তা কর্মসূচী চালুর ঘোষণা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো পরপরই যুক্তরাষ্ট্র মাঝপথে বন্ধ হয়ে থাকা বহুল আলোচিত এফ-১৬ বিমানের জন্য ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের টেকনিক্যাল সহায়তা কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দেন। পাকিস্তানের নিকট সব মিলিয়ে বর্তমানে ৭৬টি এফ-১৬ জঙ্গী বিমান রয়েছে।এর আগে গত বছরের জানুয়ারীতে সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠিকমত সহযোগিতা করছেনা অভিযোগ এনে সকল ধরণের সামরিক সহায়তা স্থগিত রেখেছিল মার্কিন প্রশাসন। ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের ভুখন্ডে আল কায়েদা গোষ্ঠির প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন কমান্ডোরা গোপন অভিযান চালিয়ে হত্যা করে। এসময় প্রেসিডেন্ট ছিল বারাক ওবামা । হিলারী ক্লিনটন ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ঐ ঘটনা থেকেই দীর্ঘদিনের মিত্র দেশ দুটির মধ্যেকার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। লাদেন হত্যা ঘটনার কিছুদিন আগে থেকে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ( সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি)’র পাকিস্তানী এজেন্ট রেমন্ড ডেভিসকে কেন্দ্র করে দুদেশের সম্পর্কে টানাপোড়ন চলছিল। ডেভিস গুলী চালিয়ে ২ পাকিস্তানি নাগরিকসহ অপর এক ব্যক্তিকে গাড়ী চাপায় নিহত করার সাথে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হয়। হত্যা মামলা ছাড়াও ডেভিসের বিরুদ্ধে এসময় ছদ্মনামে পাকিস্তানের উপজাতীয় ও সীমান্ত এলাকায় পূর্ব অনুমতি ছাড়া গোয়েন্দা তৎপরতার অভিযোগ আনে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র ডেভিসকে কূটনৈতিক হিসেবে মর্যাদার দাবী জানালে ইসলামাবাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী তাকে কূটনৈতিক মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে দু’দেশের সম্পর্কে ছিড় ধরতে শুরু করে। ওসামা বিন লাদেন হত্যা ঘটনায় দ্রুত দেশটির মধ্যে সম্পর্কে অবনতি ঘটতে শুরু করে। পাকিস্তানের যুক্তি ছিল মিত্র দেশকে না জানিয়ে সে দেশে অভিযান চালানো দেশটির সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননাকর। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য সহায়তা এবং দেশটির তরফ থেকে ফরমায়েশ পাঠানো অস্ত্রসমূহ একপ্রকার বিক্রী কিংবা সরবরাহ কমতে শুরু করে। ২০০৪ সালে যেখানে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ পাকিস্তানকে ‘নন ন্যাটো এলাই’ ঘোষণা করেছিল সেই মর্যাদাও দ্রুত নীচে নেমে আসে। পরবর্তীকালে বেনজির ভুট্টোর স্বামী প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারী এবং প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের আমলের দীর্ঘ সময়ে এ সম্পর্ক আর উন্নতি লাভ করেনি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এ দুই রাজনীতিকের নামে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। জারদারীকে মিষ্টার টেন পার্সেন্ট হিসেবে ব্যঙ্গ করা হয়। সরকারী বড় বড় চুক্তিনামায় তিনি শতকরা ১০ ভাগ ঘুষ নেন বলে তাকে মিষ্টার টেন পার্সেন্ট নাম দিয়েছে অভিযোগকারীরা। অপরদিকে পানামা পেপারে নওয়াজ শরীফের দুর্নীতি এবং সেদেশের আদালতে দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরীফকে অভিযুক্ত করা হয়েছে রাজনীতি থেকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আসলে এদের দুজনের আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিষেধাজ্ঞায় থাকা পাকিস্তানের জন্য তেমন কিছুই করতে পারেনি। অভিযোগ রয়েছে, দেশের উন্নতির চাইতে এ দুজন নিজেদের পকেট ভারি করার তালে ছিলেন।
ভারতের সংগ্রহে মার্কিন সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র
২০১৮ সালে ভারত দুর্গম পাহাড়ী সীমান্তে হেলিকপ্টারে বহনযোগ্য ১৪৫ টি এম-৭৭৭-এ৭ আলট্রা লাইট হুইটজার কামান ৭৫ কোটি ডলার মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেতে শুরু করে। চালানের প্রথম ২টি কামান ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই ভারত পৌঁছে। পাকিস্তান ও চীন সীমান্তে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দ্রুুত মোতায়েন করা হবে এসকল হুইটজার কামান। মার্কিন ও ব্রিটিশ বিএই সিস্টেমস এর নির্মাতা। অত্যাধুনিক এ কামানের পাল্লা ৩০ কিলোমিটার। পাকিস্তানের নিকট কামান বহনযোগ্য হেভী লিফট হেলিকপ্টার না থাকায় দেশটি এ নিয়ে চিন্তিত। তাদের কাছে থাকা চীনের জেড-৯ এতটা ভার বহন করতে পারেনা। মার্কিন অপর মিত্র দেশ ইসরাইল থেকেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অস্ত্রশস্ত্র আসতে শুরু করে ভারতে। দিল্লী ইসরাইল থেকে ফ্যালকন এ্যাওয়াকস গোয়েন্দা বিমান, বরাক ক্ষেপণাস্ত্র, স্পাইক ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক রাডার প্রযুক্তি, মনুষ্যবিহীন বিমান ক্রয় করেছে। আরও অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায়।
ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে বিদ্যমান সামরিক সম্পর্কের বিষয়টি বিশ্লেষণ করে বৃটেনের দি ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাতে বড় ভূমিকা রাখছে ইসরাইল’ শিরোনামে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি মতামত লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহের উপর বিশ্লেষণ লিখে পাঠক মহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। তবে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাম্প্রতিক পাকিস্তান অভিযান তার দৃষ্টি এড়ায়নি। এক বিম্লেষণে তিনি তুলে ধরেছেন প্রায় ২,৫০০ মাইল দূরে থেকে তেলআবিব কীভাবে সহযোগিতা করছে নতুন দিল্লীকে। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের ভূখন্ডে জয়স-ই-মুহাম্মদ ‘সন্ত্রাসীদের’ ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমা ফেলায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যে উল্লাস প্রকাশ করেছে সেই বোমাগুলো আসলে ইসরাইলের তৈরি রাফায়েল স্পাইস-২০০০ নামের ‘স্মার্ট বোমা’। জিপিএস দ্বারা পরিচালিত সেই বোমাগুলো এসেছে ইসরাইল থেকে।
নেগেভ মরুভূমিতে ইসরাইলের সঙ্গে ভারতীয় ‘বিশেষ কমান্ডোদের’ যৌথ মহড়ায় অংশ নেওয়ার ভিডিওচিত্র রয়েছে- সে কথাও জানান তিনি। বলেন- সেই মহড়ায় অন্তত: ১৬ জন ভারতীয় ‘কমান্ডো’ অংশ নিয়েছিলেন। জনবহুল এলাকায় কীভাবে অভিযান চালাতে হয় তা পরখ করতে আয়োজন করা হয়েছিলো সেই মহড়া।তবে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের এই সখ্যতার বিষয়ে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন বলেও মন্তব্য রবার্ট ফিস্কের। ব্রাসেলসের এক গবেষক শৈরি মালহোত্রা ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ‘হারেৎজ’-এ এক প্রতিবেদনে গত বছর লিখেছেন, “ভারত-ইসরাইলের (সুদৃঢ় সামরিক) সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে বিজেপি এবং লিকুদ পার্টির রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে।” সেই গবেষকের মতে, ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে মুসলমানদের হত্যা করছে তা দেখে অনুপ্রাণিত ভারতের ‘ইন্টারনেট হিন্দুরা’। ইন্টারনেট ব্যবহার করে যারা সেই খবর নিয়মিত রাখছেন তারাই মূলত ইসরাইলের ব্যাপক ভক্ত। তারাও যেন চান সেই একই কায়দায় পাকিস্তানকে ঘায়েল করা হোক।
কারলেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিবেক দেহেজিয়ার ইচ্ছা- ভারত, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে একটি ‘ত্রিশক্তি’ জোট গড়ে উঠুক। তবে তার এই ধারণাটিরও বিরোধিতা করেন মালহোত্রা। তার মতে- ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠুক বাস্তবতার নিরিখে, কোনো আদর্শগত ভিত্তির ওপর ভর করে নয়। কেননা, এই দুটি দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে গায়ের জোরে পরের জমি দখল করে রাখার।
সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বলেন, ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের সখ্যতার কারণে ইসরাইল থেকে যেসব অস্ত্র ভারতে আসছে সম্প্রতি সেগুলোর কিছু ব্যবহার করা হয়েছে পাকিস্তানের ভেতরে থাকা ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে। ফ্রান্স থেকে স্করপিয়ন সাবমেরিন, জার্মানী থেকে ট্যাংক ইঞ্জিন ও সাবমেরিন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মহাকাশ গবেষণা সরঞ্জামসহ প্রযুক্তি সংগ্রহ করেছে। ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া থেকে ভারত ইতিমধ্যেই আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এস-৩০০ ক্রয় করে মোতায়েন করেছে পাক সীমান্তে। ৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে আরও নতুন ভার্সন এস-৪০০ মোতায়েন শুরু করতে যাচ্ছে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে। তবে এস-৪০০ নিয়ে তুরস্কের বেলায় যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারতের বেলায় সেরকম পদক্ষেপ নেবে কিনা এটা ভবিষ্যৎে দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন সামরিক বিশ্লেষকরা। ভারত দাবি করছে ওয়াশিংটন তার বেলায় কড়া পদক্ষেপ নেবেনা। চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র এ মূহুর্তে ভারতকে নিষেধাজ্ঞায় ফেলবেনা মনে করছে নয়াদিল্লী। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন মনোভাব পাল্টাতে কতক্ষণ এটা আঞ্চলিক পরিস্থিতিই যুক্তরাষ্ট্রের মত পাল্টাতে পারে। (চলবে)