-- বিজ্ঞাপন ---

কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধের হুমকির মুখে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উৎকন্ঠা  পর্ব-৩

0

 মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম: কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে পরমাণু বোমা নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার  হুমকি দিয়েই চলেছে। এ নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্বেগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে দুদেশই বড় দেশগুলির সমর্থন পেতে কূটনৈতিক তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছে।পরিস্থিতির ভয়াবহতা চিন্তা করে চলতি সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ক্রিস হোলেনের নেতৃত্বে একটি দল। ভারতও পাকিস্তানের কাশ্মীরের অবস্থা স্বচেক্ষে পরিদর্শনে আসেন। সিনেটর ক্রিস হোলেনের নেতৃত্বে একটি দল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে যেতে চাইলে সেখানে যেতে দেয়নি ভারত সরকার। পরে তারা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর সফর করেন এবং অবিলম্বে ভারতের কাশ্মীরে কার্ফু প্রত্যাহারসহ নাগরিক মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানান। মার্কিন সিনেটেও এব্যাপারে বিল উত্থাপন করার প্রক্রিয়ার মুখে অবশেষে ভারত জানিয়েছে কাশ্মীরে কার্ফুসহ বিভিন্ন কড়াকড়িতে শিথিলতা আনা হচ্ছে শিগগীরই। এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বর্তমানে চীনে রয়েছেন । চীন পাকিস্তানের দু:সময়ের বন্ধু যাকে ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ড’আখ্যা দেন দু’দেশই।  সাথে গেছেন দেশটির সেনাবাহিনী প্রধান কামার জাভেদ বাজওয়াও সহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও। এদিকে দুদিন পরেই  ১১-১২ অক্টোবর ভারতের মোদীর সাথে এক অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে মিলিত হতে ভারত আসছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং । সামরিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা এ সফরকে কাশ্মীর প্রশ্নে উত্তেজনা কমাতে দুদেশকে সমঝোতার টেবিলে আনতে পর্দার অন্তরালে উদ্যোগেরই অংশ বলে মনে করছেন। যেকোন মূহুর্তে বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে আশংকায় দুদেশই নিজ নিজ সশস্ত্র বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে তৎপর। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গত ২৭ সেপ্টেম্বর দেয়া ভাষণে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দেয়ার পর ভারতের পক্ষ থেকে দ্রুত অত্যাধুনিক সামরিক সাজ-সরঞ্জাম ক্রয়ে তৎপর হতে দেখা যায়।

 

আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে দু’দেশ তৎপর

এ প্রেক্ষাপটে নিদ্দিষ্ট সময়ের আগেই ভারত ফ্রান্সের কাছ থেকে ৩৬ টি ‘রাফাল’ জঙ্গী  বিমানের চালানের প্রথমটি গ্রহণ করেছেন  স্বয়ং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। গত ৮ অক্টোবর মঙ্গলবার ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ফ্লোরেন্স পার্লের হাত থেকে প্রথম বিমানটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। ভারতের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা  ‘রাফাল’জঙ্গী বিমানকে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে  গেম চেঞ্জার হিসাবে দেখছেন। ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে এবং অন্যান্য অংশে যুদ্ধের আগে প্রস্তুতি হিসেবে সামরিক মহড়া জোরদার করেছে বলেই দৃশ্যমান। দুদেশই গত এক মাস যাবত মহড়ার পর মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে এবং এখনও অব্যাহত রেখেছে।বিভিন্ন সময়ে মার্কিন ও পশ্চিমা দেশের অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞায় পাকিস্তানের লাভই হয়েছে। দেশটি পশ্চিমা দেশগুলোর উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে শুরু করে। মার্কিন এফ-১৬ বিমান সরবরাহের ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তান জেদ করে অবশেষে চীনের সাথে যৌথভাবে নিজেদের তৈরী প্রথম জঙ্গী বোমারু বিমান জেএফ-১৭ থান্ডার জঙ্গী বোমারু বিমান তৈরী  করেছে। পাকিস্তান দাবী করে এই জেএফ-১৭ মার্কিন এফ-১৬ বিমান থেকেও  অতি কার্যকর।

 

বিশ্লেষকরা সেই প্রমাণটি পেয়েছেন গত ২৭ ফেব্রুয়ারী ভারতের সাথে কাশ্নীর সীমান্তে সংঘর্ষের সময়। পাকিস্তান দাবী করেছিল তাদের জেএফ-১৭ থান্ডার বিমানই ভারতের মিগ-২১ বিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তানে নামিয়ে এবং ভারতীয় পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করে। ভারত বলেছিল পাকিস্তানের মার্কিন সরবরাহকৃত এফ-১৬ জঙ্গী বিমান ঐ হামলায় অংশ নেয় এবং ভারতের মিগ-২১ বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার আগে ডগফাইটে পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানকেও ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়। অবশ্য পরে ভারতের ঐ দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে জেএফ-১৭ বিমান অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। কামরায় অবস্থিত পাকিস্তান এ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স (পিএসি)এ এপর্যন্ত ১০০টিরও বেশী বিমান তৈরী করেছে দেশটি। চীনের সাথে যৌথভাবে তৈরী সফল এ জঙ্গী বিমানের ৫৮ ভাগই পাকিস্তানে তৈরী করা হয়। নাইজেরিয়া ও মায়ানমারে এ জঙ্গী বিমান রফতানি করেছে পাকিস্তান। অপরদিকে ভারত নিজেদের হিন্দুস্থান এ্যারোনেটিকস লি: এ তৈরী ‘তেজাহ’জঙ্গী বিমান এখনও রফতানি দূরে থাক পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারেনি  অর্থ্যাৎ  আলোর মুখ দেখেনি বলা চলে।

 

ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের গোপণ অস্ত্র নিজ দেশে তৈরী জঙ্গী বিমান জেএফ-১৭ থান্ডার–যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক

যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট  এর মতে ভারতের সাথে আগামী যুদ্ধে পাকিস্তান-চীন যৌথ তৈরী এই জেএফ-১৭ থান্ডারই হবে ভারতের বিরুদ্ধে দেশটির গোপণ অস্ত্র।  পশ্চিমা  নিষেধাজ্ঞার কারণে আরেক সফল প্রকল্পের নাম পাকিস্তানের তৈরী মেইন ব্যাটল ট্যাংক (এমবিটি)  ‘আল খালিদ’। ২০০১ সালে পাকিস্তানের হেভি ইন্ডাষ্ট্রিজ টাক্সিলায় চীনের সাথে যৌথভাবে তৈরী ৪৬ টনের এই এমবিটি ‘আল খালিদ’   এপর্যন্ত ৩১০টি তৈরী করেছে সফলতার সাথে। এক হিসাবে দেখা গেছে, পাকিস্তানের নিকট ইউক্রেন থেকে ক্রয় করা  টি-৮০ ইউডিসহ বিভিন্ন মডেলের  ২,৭৩৫টি ট্যাংক রয়েছে। সাঁজোয়া যান রয়েছে ৩,০৬৬টি, আর্টিলারী বহরে রয়েছে ৩,৭৪৫টি  কামান। তম্মধ্যে ২৫০টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এম-১০৯এ৫ ১৫৫মিমি ও এ-১০০ই ৩০০মিমি স্বয়ংক্রিয় হুইটজার কামান। তুলনামূলকভাবে ভারতের ‘অর্জুন’নামের  ট্যাংক  সফলভাবে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারেনি। এখনও অর্জুন ট্যাংকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। পাকিস্তান ‘আল খালিদ’ ট্যাংক ছাড়াও পুরোনো মডেলের চীনের টি-৫৯  ট্যাংককে আধুনিকায়ন করে ‘আল জারার’ ট্যাংক তৈরী করেছে। ক্ষেপণাস্ত্র তৈরীতেও পাকিস্তান ভারতের চাইতে এগিয়ে। পাকিস্তান ‘হাতফ’শ্রেণীর মিসাইল রয়েছে স্বল্প থেকে দূরপাল্লার। এছাড়া রয়েছে, ‘বাবুর’  ক্রুজ মিসাইল, ‘আবদালী’ব্যালাস্টিক মিসাইল, ‘শাহীন’ শ্রেণীর স্বল্প থেকে দূরপাল্লার পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র। পাকিস্তানের সবকটি ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ভারতে মুসলিম শাসনামলের বীর যোদ্ধদের নামকরণে। ‘বাবুর’ক্ষেপণাস্ত্রের নাম দেয়া হয়েছে ভারতে মুসলিম বীর সেনাপতি মোগল সম্রাট  বাবরের নামকরণে। ভারতে একটি স্বাধীন হিন্দু রাজ্য কায়েমের জন্য  রাজপুত রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে  ১২০ জন রাজপুত সর্দার, ১ লক্ষ ২০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য, ১ হাজার হস্তিবাহিনীসহ বিশাল বাহিনী  মুসলিম সম্রাট বাবরের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাহিনী ধূলিস্যাৎ করার প্রত্যয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বাবুরের উঁচু মনোবলে বলীয়ান ক্ষুদ্র বাহিনীটি রাজপুত বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ভারতে মোষল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। পাকিস্তান সেই বীর সেনাপতির নামে ক্ষেপণাস্ত্রের নামকরণ করেছে ‘বাবুর’।

 

ঘাস লতা পাতা খেয়ে হয়েও পরমাণু বোমা বানানোর অঙ্গীকার করেছিল পাকিস্তান

এখানে বলা প্রয়োজন, পাকিস্তান-ভারত ইতিপূর্বে তিনবার নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে ৩-১৬ ডিসেম্বর, এর আগে ১৯৬৫ সালের ৬-২২ সেপ্টেম্বর কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এবং ১৯৪৭ সালের ২১ অক্টোবরও  কাশ্মীর নিয়ে। তবে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরপরই তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারত পরমাণু বোমা বানাচ্ছে এমন পরিকল্পনা শোনার পর প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন, ভারত যদি পরমাণু বোমা বানায় তাহলে পাকিস্তানও ঘাস,পাতা এমনকি উপোষ থেকে হলেও পরমাণু বোমা বানাবেই। এদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার এ দু দেশের পরস্পর পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশ দুটির উপর সামরিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

 

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আগে থেকেই জানত যে, পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানাচ্ছে এজন্য সেদেশের সিনেটের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান ল্যারি প্রেসলার ইসরাইলের সমর্থক ইহুদি লবির চাপে পাকিস্তান যাতে পরমাণু শক্তির অধিকারী না হয় সেজন্য শুরু থেকেই চাপে রাখার জন্য শুধু পাকিস্তান কেন্দ্রিক একটি বিল তৈরী করে ১৯৮৪ সালের ২৮ মার্চ। এর নাম দেয়া হয় প্রেসলার সংশোধনী বিল। এই বিল কংগ্রেসে উত্থাপিত ও পাস হয় ১৯৮৫ সালের আগস্টে যা ‘প্রেসলার এমেন্ডমেন্ট বিল’ নামে পরিচিত। এই বিলের সার হল পাকিস্তান কোন পরমাণু বোমা বানাচ্ছেনা কিংবা তার হাতে এ জাতীয় কোন বোমার কোন সরঞ্জাম নেই এমর্মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সই করলেই তবেই পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া হবে। এই আইন প্রয়োগ করে বহুবার পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম বিশেষ করে এফ-১৬ জঙ্গী বিমান ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী আটকে দেয়া হয়। এত কিছুর পরেও পাকিস্তানকে দমানো যায়নি অবশেষে দেশটি ড. আবদুল কাদের খানকে দিয়ে দেশটি পরমাণু শক্তির অধিকারী হয়েছে।(চলবে)

## ০৯.১০.২০১৯ইং।

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.