কাজী আবুল মনসুর::সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত জুড়ে সেনা সমাবেশ জোরদার করেছে তুরস্ক। সিরিয়ার অভ্যন্তরে তৎপর গেরিলা ও মার্কিন মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর আগে তুরস্ক এই পদক্ষেপ নিল। এরই মধ্যে সাঁজোয়া যান নিয়ে সিরিয়া সীমান্তে তুরস্কের সেনা টহল বেড়েছে। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে, ৯ টি সাঁজোয়া যান এবং একটি বাস ভর্তি সেনা আঁকাকেল সীমান্তে পৌঁছেছে। গত শনিবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান সিরিয়ার অভ্যন্তরে তৎপর কুর্দি গেরিলাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর নতুন অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সিরিয়ায় তৎপর কুর্দি গেরিলাদেরকে তুরস্ক নিজের সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি মনে করে।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ অভিযানে মার্কিন বাহিনীর কোনও সমর্থন বা সম্পৃক্ততা থাকবে না। ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যরা অবস্থান করবে না। স্টিফেন গ্রিশাম বলেন, আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানে বন্দি বিদেশি যোদ্ধাদের নিজেদের হেফাজতে নেবে তুরস্ক। সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে ইতোমধ্যেই সিরিয়া সীমান্তে তুরস্কের সাঁজোয়া যান মোতায়েনের ছবি ও ভিডিও তুর্কি সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ওই অভিযানের ঘোষণা দেওয়ার পরই এ প্রস্তুতি শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। তুর্কি-সিরিয়া সীমান্ত এলাকার সুরক্ষায় কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আঙ্কারা। আল জাজিরা এ খবর দিয়েছে। তার মানে তুরস্ক আবারও দমন-পীড়নের রাস্তায় নামছে। যেমনটি নেমেছিল এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর পর।
এখন এরদোগান বেশ শক্তিশালী। বিগত দু’তিন বছর আগেও এরদোগানের চেয়ার ছিল নড়বড়ে। কামাল আতাতুর্কের দেশ তুরস্ক। আর এ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। অনেকের মতে, তিনি একজন হিপোক্রেট নেতা। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদেও ফাসিঁ নিয়েও এরদোয়ানের হম্বি-তম্বি কম ছিল না। প্রযুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনমতে রক্ষা পেয়েছেন। সম্ভবত আমেরিকান সিআইএ এরদোয়ানকে বেশ হাল্কাভাবে নিয়েছিল। অন্যথায় তার উৎখাত ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরদোয়ান মুখে গণতন্ত্রেও বুলি আওড়ায়। কিন্ত তার দলে আদৌ গণতন্ত্র আছে কিনা এ নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে নানা ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। কিন্ত জনগনের বড় একটি অংশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় মাঝে মাঝে বেচেঁ যান এরদোয়ান। তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বময় ক্ষমতা প্রয়োগ করে তুরস্কে চলছে দমন-পীড়ন অভিযান।
বিগত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে এরদোয়ান শুরু করেছেন ‘শুদ্ধি অভিযান’। প্রথম শুদ্ধি অভিযান শুরু হয় সামরিক বাহিনীতে। এরপর পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, গণমাধ্যম, শিক্ষাসহ সব বেসামরিক খাত শুদ্ধি অভিযানের আওতায় আসে। সামরিক বাহিনীর ৯৯ জেনারেলসহ ২৮৩৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ২৭৪৫জন বিচারককে। চাকরি হারিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫৭৭ জন ডিন, ২১ হাজার শিক্ষক, ১৫শ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। সবমিলিয়ে ইতিমধ্যে ৫০ হাজারের বেশী মানুষ চাকরি হারিয়েছেন; এদের কেউ স্থায়ীভাবে আর কেউ ‘সাময়িক’। এছাড়া লাইসেন্স বাতিল হয়েছে ২৪টি রেডিও এবং টেলিভিশনের।
তুরস্কের রাজনীতি ও সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত এবং সেই বিভক্তি গত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিভক্তিকে সাধারণত এভাবে দেখা হয় যে একদিকে আছে ইসলামপন্থী নির্বাচিত একেপি; অন্যদিকে আছে দেশের অন্য দলগুলো, যাদের পশ্চিমা গণমাধ্যম ‘সেক্যুলার’ বলে বর্ণনা করে। তুরস্কের সবগুলো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্র্মীরা সেনা অভ্যুত্থানের বিপক্ষে রাস্তায় নেমে এসেছিল। সংকটকালে দেশের বিরোধী দলগুলো সরকারের পাশে ছিল। অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হওয়ার আরো একটি কারণ ছিল এই যে, সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম বিশাল তুর্কি সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যের সমর্থন এই অভ্যুত্থানে ছিল না। ছিল না বলেই এই অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তুরস্কের সাধারণ মানুষ প্রবল সেনা-বিরোধী। তাদের সেই সেনা-বিরোধী মনোভাবই রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে আপাতত ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখল!
এরপরও ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে প্রশাসনে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এতে সেনাবাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন ও বিচার বিভাগের লোকজন একের পর এক সরকারি চাকরি হারাচ্ছেন। প্রতিপক্ষকে নিষ্ক্রিয় বা নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমতা ও নিজের দলের রাজনৈতিক আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন এরদোয়ান। যদিওবা দেশটির স্থিতিশীলতার জন্য এই অভিযান গুরুতর ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। এছাড়া এর ফলে শুধু তুরস্কের গণতন্ত্রই দুর্বল হবে না, জাতি-রাষ্ট্র হিসেবেও তুরস্ক দুর্বল হয়ে পড়বে। খালি হওয়া পদগুলোতে ‘পছন্দের লোক’ নিয়োগ করার সময় অযোগ্য-অদক্ষ লোকরা যে প্রবেশ করবে না, সেটার নিশ্চয়তা এরদোগানও দিতে পারবেন না।
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর চাকরিচ্যুত হওয়ার খবর শুনে আত্মহত্যা করেছেন তুরস্কের একটি জেলার উপ-গভর্নর নেজমি আকমান। বিরোধীদেরকে এরদোয়ান এমনভাবে ‘নির্মূল’ করছেন, যাতে মনে হয় প্রতিপক্ষ লোকেরা ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে এসেছেন। তারা কেউ ওই মাটির সন্তান নন। তারা ‘বিপথগামী’, তাই তাদের সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের অধিকার নেই। তারা তাদের ক্ষমতা ভোগের শত্রু, তাই ‘গণতন্ত্রেরও’ শক্রু। এভাবে গণ-অপসারণের বর্বরোচিত পদক্ষেপ জোরালো সমালোচনার মুখেও পড়েনি, এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নির্বাচিত ‘স্বৈরশাসককে’ও ভবিষ্যতে একই পথে যেতে উৎসাহিত হবে।
এদিকে তুরস্কের বিগত বছরগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একেপি ও এরদোয়ানের সরকার গত কয়েক বছরে একটি কঠোর কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছে। ২০১৩ সালে তার পার্টির বিরোধিতা করার জন্য তিনি ১৭ জন বর্ষীয়ান সেনা কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন জেলে পাঠিয়েছেন। এছাড়াও কয়েকশো সরকারি অফিসার, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতা তার রোষের শিকার হয়েছেন। গেজি পার্কে সবুজ ধ্বংস করে নির্মাণকাজের বিরোধিতাকে কড়া হাতে দমন করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছেন। শপথ করেছেন টুইটারকে মুছে দেবেন।
এরদোয়ান দুইবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তুরস্কের শাসনতন্ত্র তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি প্রেসিডেন্ট হন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি শাসনতন্ত্র সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতিতে রূপান্তর করে ফেলেন। অনেকের অভিযোগ তিনি এখন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছেন। বুদ্ধিজীবী মহল এখন চেষ্টা করছেন তার বিরুদ্ধে একটা সফল গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত করার। উদারপন্থী কোনও বুদ্ধিজীবীরই সমর্থন এরদোয়ানের প্রতি নেই।
জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এরদোয়ানের বিলাস-আয়োজনও। এরই মধ্যে তিনি পাহাড়ের ওপর প্রেসিডেন্ট হাউস তৈরি করেছেন। এটি পরিসরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভবন ‘হোয়াইট হাউসের’ চেয়ে বড়। এক হাজার কক্ষ বিশিষ্ট। ৯১৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে এ প্রসাদটি তৈরি করতে। এটাকে অনেকে ভালো চোখে দেখেনি। অনেকে বলেছেন ‘সুলতান এরদোয়ানের’ রাজ প্রাসাদ। ইস্তাম্বুল এবং আনকারার বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ আইএস-এর প্রতি এরদোয়ানের দুর্বলতা রয়েছে। আইএস ইরাকের তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন করে প্রতিদিন নাকি তুরস্কের ওপর দিয়ে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে। তুরস্ক দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। তাছাড়া এরদোয়ান ও তার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিগত সময়গুলোতে বিরোধীদের নির্বিচারভাবে দমনের কাজে নেমেছে এরদোয়ান সরকার। তুরস্ক সরকার ভিন্নমত প্রকাশের পথ কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি বিরোধীদের মালিকানাধীন গণমাধ্যম জোর করে বা কৌশলে সরকারের সমর্থকদের দখলে তুলে দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে বিদেশি সাংবাদিকেরা প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন অথবা তাদের জোর করে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এরদোগানের বিরুদ্ধে বিগত সময়ে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল তা ব্যর্থ হওয়ার ফলে যদিও বাইরে থেকে মনে হচ্ছে যে তুর্কি সামরিক বাহিনীর মূল নেতৃত্ব প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অনুগতই রয়েছে, তবু ভেতরের বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় লিখেছেন- কেউ যদি মনে করে সামরিক অভ্যুত্থান দমন করা একটা মুহুর্তের ব্যাপার, যার পর থেকে তুর্কি সেনাবাহিনী সুলতানের বাধ্য-অনুগতই থেকে যাবে, তাহলে বিরাট ভুল করা হবে। তিনি আরও লিখেছেন, এবারের অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বটে, কিন্তু তুরস্কের ইতিহাসের ইঙ্গিত হলো ভবিষ্যতের অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা সফল হতে পারে।
ছয় লাখ আশি হাজার সদস্য বিশিষ্ট তুরস্কের সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংস্কৃতির আবহাওয়ায় গড়ে উঠেছে। তাদেরকে রাতারাতি ‘ইসলামী আদর্শে’ ধাবিত করতে পারবেন না এরদোয়ান। এমনও হতে পারে যে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে সম্মিলিত বাহিনীর দ্বিতীয় অভ্যুত্থান মোকাবেলা করতে হবে প্রেসিডেন্টকে। যা মোকাবেলা করার ক্ষমতা এরদোয়ানের নেই। এরদোয়ানকে বুঝতে হবে তাকে এ ব্যর্থ অভ্যুত্থান তাকে বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে কোন ধরনের ভুল হলে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাবেন এরদোয়ান।
এছাড়া অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ানের দল, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নিয়ে মাঠে নেমেছে; এটাও বাড়াবাড়ি। এ নিয়ে গোপনে সক্রিয় প্রতিরোধ করতে পারে পশ্চিমা বিশ্ব। অভ্যুত্থান প্রতিরোধের প্রথম আহবান আসে আনকারা এবং ইস্তাম্বুলের মসজিদের মাইক থেকে। এ আহবান সারারাত অব্যাহত থাকে। এ বিষয়টি পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ভালো চোখে দেখবে না; এটা নিশ্চিত।
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অভ্যুত্থানকে ‘আল্লাহর উপহার’ হিসেবে মনে করেছেন। কারণ এর মাধ্যমে তিনি বিরোধী শক্তিকে ‘শেষ’ করে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। শান্তি, সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কোনো ‘ছাড়’ দেবেন না বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন। অথচ ‘দুর্যোগ’ পরবর্তী সময়টা ভালোভাবে সামাল দিতে এরদোয়ানের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরী জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। অন্যথায় ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় যোগ হতে পারে তুরস্ক!###