চট্টগ্রামের উন্নয়নে বর্তমান সরকার গৃহীত বৃহৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বড় প্রকল্প ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’। সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পের বন্দর অংশ নিয়ে নকশাগত জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার পর অবশেষে এর মূল নকশায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উচ্চতর পর্যায়ের প্রকৌশলীদের দফায় দফায় বৈঠকের পর এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা হয়েছে। প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট উভয় সংস্থার উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম দেশের প্রধান বন্দর কেন্দ্রিক নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে বিবেচিত। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত শিল্পাঞ্চল ও নির্মীয়মান ইকনমিক জোনের এ নগরী দেশের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। কোনপ্রকার যানজট ছাড়াই যাতে বিনিয়োগকারী দেশী-বিদেশী শিল্পোদ্যেক্তারা চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে সোজা মূল শহরে ৩০ মিনিটে পৌঁছুতে পারে চট্টগ্রামের উন্নয়নে গৃহীত বড় বড় প্রকল্পসমূহের মধ্যে সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ অন্যতম ‘এলিভেটেড এক্্রপ্রেসওয়ে’ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। চট্টগ্রামের তথা দেশের সর্ববৃহৎ সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ের কাজকে মূল নকশা অনুযায়ী ৬ টি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশ দিয়ে যাওয়া বারেকবিল্ডিং-সল্টগোলার ২,৯০০ মিটার ফ্লাইওভারের চার লেনের অংশ।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম থেকে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে কোন প্রকার ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি না হয় সে কারণে এই অংশটির ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে প্রকল্পের সাথে জড়িত উদ্ধর্তন কর্মকর্তা প্রকৌশলীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে। ইতিপূর্বে এনিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ও সিডিএ’র মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেহেতু দেশের সিংহভাগ পণ্য আমদানী রফতানী হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে। ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ প্রকল্পের কারণে বন্দরে পণ্যবাহী যান চলাচলে কোন প্রকার যানজট যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সিডিএ’কে বিষয়টি জানানো হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বন্দর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের আন্তর্জাতিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, যেহেতু এটি বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর ও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এ বন্দরে আন্তর্জাতিক আইএসপিএস (ইন্টারন্যাশনাল শীপ এন্ড পোর্ট ফেসিলিটি সিকিউরিটি) কোড অনুযায়ী পণ্য চলাচলে কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে সে বিষয়ে গুরুত্বআরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে কোন প্রকার ব্যাঘাত ঘটলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এসকল বিষয়গুলি মনিটর করে বন্দরের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ সহ কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এসকল বিষয়গুলি মেনে চলা হচ্ছে কিনা সেজন্য উভয় পক্ষের আলোচনার পর ফ্লাইওভারের লে-আউট/ডিজাইন বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) এর তত্বাবধানে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালককে অন্তর্ভুক্ত করে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান প্রকৌশলীকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটি কাজ শুরু করেন। গত সপ্তাহের সর্বশেষ বৈঠকে উভয় সংস্থা মূল নকশা পরিবর্তন করতে উভয় সংস্থা সম্মত হন তবে আরও কয়েক দফা বৈঠকের পর এ নকশা পরিবর্তন চূড়ান্ত করা হবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) কমোডোর খন্দকার আকতার হোসেন বলেন,‘দেশের প্রধান আমদানী-রফতানীর বন্দর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে পণ্যবাহী যান চলাচলে যাতে কোন প্রকার ট্রাফিক জ্যাম না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই আমরা এগুচ্ছি। এজন্য মূল নকশায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ’র সাথে বৈঠক করে আমরা এর একটি সুন্দর সমাধানের দিকে বেশ ভালভাবেই এগুচ্ছি।’
অতীতে যানজটের কারণে প্রায়শ:ই এসব শিল্প বিনিয়োগের সাথে জড়িতরা অনেকেই বিমানের নির্দ্ধারিত ফ্লাইট ধরতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। চট্টগ্রাম শহরের মূল কেন্দ্র থেকে বিমান বন্দরের ১৬-১৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যানজটের কারণে ঘন্টার পর ঘন্টায় আটকা পড়তে হয়। চট্টগ্রামে বিমান বন্দরে কোনপ্রকার যানজট ছাড়াই পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে সরকার বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জন্য এ বৃহৎ প্রকল্পটি হাতে নেন। মূলত: চট্টগ্রামবাসীর এ সমস্যাটিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছায় প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (সিডিএ) এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৩,২৫০ কোটি ৮৩ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম শহরের লালখানবাজার হতে শাহ-আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘এলিভেটেড এক্সপেসওয়ে’ নামের এ প্রকল্প ২০১৭ সালের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেক সভায় অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭ ইং জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুনে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ম্যাক্স-র্যানকেন জয়েন্ট ভেনচ্যুর নামক নিয়োগ দেয়া হয়।
বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘ হয়ত আর দু’একটি মিটিং এর পর আমরা মূল নকশাটিতে পরিবর্তন আনব। চট্টগ্রাম বন্দর যেহেতু দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এর কর্মকান্ডে কোন প্রকার ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে বন্দর অংশের কাজে আমরা হাত দেব ।’
সিডিএ’র প্রকল্প পরিচালক মো: মাহফুজুর রহমান বলেন,‘ অন্যান্য অংশের কাজ পুরোদমে চলছে, বর্তমানে সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠঘর পর্যন্ত অংশে পাইলিং এর কাজ হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৫০টি পাইলিং হয়েছে।’
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (সিডিএ)’র মাধ্যমে বাস্তবায়িত এ প্রকল্পটির কাজ শহরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধাপে ভাগ করা হয়েছে।ছয়টি ধাপে বিভক্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল ফ্লাইওভারের কাজের অংশগুলি হচ্ছে, লালখানবাজার-দেওয়ানহাট(১৩০০ মিটার চার লেন), দেওয়ানহাট-বারেকবিল্ডিং(২০০০ মিটার চার লেন মূল ফ্লাইওভার), বারেকবিল্ডিং-সল্টগোলা(২৯০০ মিটার চারলেন মূল ফ্লাইওভার),সল্টগোলা-সিমেন্টক্রসিং( ৩১৫০ মিটার চারলেন মূল ফ্লাইওভার),সিমেন্টক্রসিং-কাঠঘর(২১৫০ মিটার চারলেন মূল ফ্লাইওভার),কাঠঘর-ভিআইপি রোড(২৩৫০ মিটার চারলেন মূল ফ্লাইওভার এবং সী বীচ থেকে ভিআইপি রোড ৮৫০ মিটার দুইলেন ফ্লাইওভার নির্মাণ)। কবে নাগাদ বন্দর অংশে হাত দেয়া হবে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী রাফিউল আলম বলেন, ‘ খুব শীগগীরই আমরা নকশা পরিবর্তন সংক্রান্ত ব্যাপারে চূড়ান্ত বৈঠক করবো।’