চাঁদে নামার শেষ মুহূর্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ভারতের চন্দ্রযান-২। এতে এক প্রকার মুষড়ে পড়েন ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) বিজ্ঞানীরা। চন্দ্রযানটি কক্ষপথ ছেড়ে চাঁদে নামতে শুরু করার পর থেকেই গ্রাউন্ড স্টেশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষে আর কোনো বার্তা পাঠাচ্ছে না। রাত প্রায় ২টার দিকে চাঁদের মাটিতে নামার কথা ছিল। কিন্তু এই সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও আর তথ্য মেলেনি। সফলতা দেখার জন্য ইসরোতে হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, টিভি পর্যায় ছিল কোটি চোখ। ভারতের স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত ১.৩৮ মিনিটে অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু হয় চন্দ্রযান-২ এর। চাঁদের মাটি থেকে তখনও ২৮ কিলোমিটার দূরে ল্যান্ডার বিক্রম। ধীরে ধীরে তার গতি কমানো শুরু হয়। ইসরোর বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করে, চারটি ধাপে নামবে বিক্রম নামবে চাঁদের মাটিতে। ১৫ মিনিট ধরে চলবে এই অবতরণ। এ-ও জানানো হয়, সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছে। তার পর আরও কয়েক মিনিট। বিক্রম তখনও ২১০ মিটার/সেকেন্ড গতিবেগে চাঁদের দিকে ছুটছে। তার পরেই হোঁচট। শেষমুহুর্তে সংকেত পাঠানো বন্ধ করে দেয় বিক্রম। প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে প্রথম দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় ছিল ভারত। তবে শেষমেশ মিশন সফলের বার্তা দিতে পারেনি ইসরোর বিজ্ঞানীরা। ৯৭৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।
ইসরো প্রধান কে সিভান জানিয়েছেন, চন্দ্রপৃষ্টের ২.১ কিমি আগে থেকে চন্দ্রযান-২ এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এদিন পূর্ব পরিকল্পনা মতো রাত ১:৩৮ মিনিটে অবতরণ প্রক্রিয়া শুরু করে বিক্রম। হার্ড ব্রেকিং সামলে ফাইন ব্রেকিং পর্ব শুরু হতেই ছন্দপতন ধরা পড়ে ইসরোর দপ্তরের জায়ান্ট স্ক্রিনে। থেমে যায় ল্যান্ডার বিক্রমের ক্রমবর্ধমান গতি। সেই সময় বেঙ্গালুরুতে ইসরোর দপ্তরে হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। ইসরো প্রধান তাকে গিয়ে বিষয়টি জানানোর পর নিচে নেমে আসেন তিনি। পরে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সাহস যোগান। তবে এখনই আশা ছাড়ছেন না বিজ্ঞানীরা। কারণ, ল্যান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও তা হয়তো ইতিমধ্যেই চাঁদের মাটিতে নেমে পড়েছে। কিন্তু, তা সফল না ক্র্যাশ ল্যান্ডিং তা জানতে উদগ্রীব বিজ্ঞানীরা। যত শিগগিরই সম্ভব যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত ৬০ বছরে চাঁদের মাটিতে পা রেখেছে রাশিয়া, আমেরিকা, চীন। চতুর্থ দেশ হিসেবে চলতি বছরেই ইসরাইলের নামার কথা ছিল। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। ভারতের এই চন্দ্রাভিযান অনেক দিক থেকেই ছিল অভিনব। তার মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ গোলার্ধে অবতরণের পরিকল্পনা। এখন পর্যন্ত যতগুলো দেশ চাঁদের মাটিতে পদার্পণ করেছে, তারা সকলেই নেমেছে চাঁদের উত্তর গোলার্ধের বিভিন্ন জায়গায়। এই প্রথম কোনো দেশ হিসেবে ভারত চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে নামার পরিকল্পনা করেছিল। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে প্রথম চেষ্টায় মঙ্গলযানকে লালগ্রহের কক্ষপথে পাঠিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ইসরো। এরপরে চাঁদের দক্ষিণ অংশে নামার স্বপ্ন দেখেছিল এবং দেশবাসীকে দেখিয়েছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
এ ঘটনায় হতাশায় মুষড়ে পড়ে ভারতের বিজ্ঞানীরা। তবে ভারত এ প্রকল্প থেকে পিছপা হবে না জানা যায়। নরেন্দ্র মোদিকে বিজ্ঞানীদের সান্তনা দিতে দেখা যায়। ভারতীয় অনেক গণমাধ্যমে হতাশার পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের ভেঙ্গে না পড়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাকাশযান চন্দ্রযান-২ তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। প্রথমটি অরবিটার; যার ওজন ২ হাজার ৩৭৯ কেজি এবং পে লোডস রয়েছে ৮টি, দ্বিতীয়টি ল্যান্ডার বিক্রম; ওজন ১ হাজার ৪৭১ কেজি, পেলোডস রয়েছে চারটি এবং সর্বশেষ অংশ রোভার প্রজ্ঞান, যার ওজন ২৭ কেজি; পে লোডস আছে দুটি।
গত ২ সেপ্টেম্বর অরবিটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ল্যান্ডার বিক্রম। ভারতের ভারী লিফট রকেট জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-থ্রিতে চড়েগত ২২ জুলাই ৯৭৮ কোটি টাকার চন্দ্রযান-২ চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল।
কয়েক ধাপে পৃথিবীর কক্ষপথে থেকে বেরিয়ে, সেটি প্রবেশ করে চাঁদের কক্ষপথে। শনিবার ভোররাতে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামার কথা ছিল ল্যান্ডারের। ভোর ৬টার দিকে সেই ল্যান্ডার থেকে বেরিয়ে আসার কথা ছিল রোভার প্রজ্ঞান। শুক্রবার দিবাগত রাতে চন্দ্রযান-২ এর চন্দ্রপৃষ্ঠে নামার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ইসরোর চেয়ারম্যান কৈলাসাভাদিভো শিবান বলেন, এই অভিযানের সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক চলছিল। ২ দশমিক ১ কিলোমিটার পর্যন্ত চন্দ্রযানের স্বাভাবিক কার্যক্রমের তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ল্যান্ডারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় অভিযান থমকে গেছে। তবে চন্দ্রযান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। ##