--- বিজ্ঞাপন ---

মহিমান্বিত রজনী শবেবরাত

0

♦ এহসান বিন মুজাহির ♦

মহান আল্লাহ তায়ালা ইমানদারদের আত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষের জন্য দিনক্ষণ, স্থান, কাল ও যুগ হিসেবে অনেক বরকতময় দিবস-রজনী ও ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ দান করেছেন। ইবাদতের এসব উর্বর সময়কে বান্দা যথাযথভাবে ঐকান্তিকতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারলে সামান্য সাধনা, ক্ষুদ্র পরিশীলন ও অনুশীলন দ্বারা প্রশান্তির বারিধারায় সিক্ত হয়ে হাসিল করতে পারবেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। এমনই একটি রজনী হলো পবিত্র শবেবরাত।

২১ এপ্রিল রোববার রাতে বাংলাদেশে পবিত্র লাইলাতুল বরাত পালিত হবে। শবেবরাত শব্দটি ফারসি।শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী। এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিসে শবেবরাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্যরাত বলা হয়েছে। আমাদের দেশে এ রাতটি শবেবরাত নামে অধিক পরিচিত।

শবেবরাত একটি পুণ্যময় রজনী। তবে এই রজনীর ফজিলত ও আমল নিয়ে আলেমদের মধ্যে ইদানীং বিভিন্ন ধরনের মতানৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার কারণে শবেবরাত নিয়েও ধর্মপ্রাণ মানুষ বিভ্রান্তির শিকার। কেউ করছেন বাড়াবাড়ি আবার কেউ করছেন ছাড়াছাড়ি। অর্থাৎ প্রথম দল শবেবরাত নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে শবেবরাতকে শবে কদরের কাছাকাছি নিয়ে যান। কেউ আবার শবেকদর থেকে বেশি গুরুত্ব দেন। বিপক্ষের দল শবেবরাতকে রীতিমতো অস্বীকার করেন। তারা শবেবরাতের কোনো ফজিলতকে মানতেই রাজি নন।

আরেকদল আছেন যারা শবেবরাত নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে না, আবার শবেবরাতকে অস্বীকারও করেন না। তারা শবেবরাতকে পুণ্যময় রজনী হিসেবে নফল ইবাদত-বন্দেগিসহ বিভিন্ন নফল আমলের মাধ্যমে বরাতের রজনীতে জাগ্রত থেকে আমল করেন। এটিই হলো উত্তম ও সঠিক পন্থা।

কারণ শবেবরাত শবেকদরের সমতুল্য দূরে থাক, মর্যাদা এবং ফজিলতে শবেকদরের কাছাকাছিই নয়। শবেকদর ও শবেবরাতের মাঝে অনেক পার্থক্য। পবিত্র কোরআন শবেকদরকে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেছে। এ রাতেই পবিত্র কুরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয়েছে। তাই শবেবরাতকে শবেকদরের সমতুল্য বা কাছাকাছি মনে করা রীতিমতো বাড়াবাড়ি। আর শবেকদরের মতো শবেবরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব না থাকলেও শবেবরাতকে অস্বীকার করা কিংবা বিদআত বলারও সুযোগ নেই। শবেবরাতের ফজিলত ও আমল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তবে শবেবরাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যেমন ঠিক নয়, তেমনিভাবে তা অস্বীকার করাও সঠিক নয়।

শবেবরাত কী

হজরত রাসূলুল্লাহ’র (সা.) ভাষায় শবেবরাত হলো ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫তম রজনী। এ রাতের ফজিলত বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শাবানের ১৫তম রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। মুশরিক ও পরস্পর বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। -সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং: ৩৮৩৩, শুআবুল ইমান, হদিস নং: ৬৬২৮

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যখন শাবানের ১৫তম রাত আসবে, তোমরা এ রাতে নামাজ পড়ো এবং পরবর্তী দিনে রোজা রেখো। -রায়হাকি হাদিস নং : ৩৮২৩

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন। আর শবেকদরে তা নির্দিষ্ট দায়িত্বশীলদের অর্পণ করেন। -তাফসিরে কুরতুবি ১৬/১২৬)

হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন মহান আল্লাহ এই রাতে দুনিয়ার প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়ে দুনিয়াবাসীর ওপর তার খাস রহমত নাজিল করেন। কালব গোত্রের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়েও অধিক সংখ্যক বান্দাকে তিনি ক্ষমা করেন। -সুনানে তিরমিজি ১ম খণ্ড, হাদিস নং ৭৩৯, পৃষ্ঠা ১৫৬

শবেবরাতে করণীয়

শবেবরাত মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য বিশেষ উপহার। তাই এ রাত সম্পর্কে আমাদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। রাতটি ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটাতে হবে। এ রাতের নির্ধারিত কোনো আমল না থাকলেও বিশেষ কিছু আমল করা যেতে পারে। যেমন নিজের যাবতীয় গোনাহের জন্য তওবা করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

নিজের মনের নেক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ও মৃতদের মাগফিরাতের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, সালাতুস তাসবিহ, জিকির-আযকার, দোয়া-দরুদ তওবা-ইসতিগফার, দান-সদকা, উমরি ক্বাজা নামাজ, কবর জিয়ারত, দান সদকাহসহ নফল আমলের মাধ্যমে রাত গুজার করা।

এ রাতের নফল নামাজের নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই, বরং অন্যান্য নফল নামাজের মতো দুই রাকাতের নিয়ত করে সূরা ফাতেহার পর যে কোনো সূরা মিলিয়ে যত ইচ্ছা পড়া যেতে পারে।

এ রাতে রাসূল (সা.) চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। আয়েশা সিদ্দিকাকে (রা.) নিদ্রা থেকে জাগ্রত করেননি এবং পরবর্তীকালেও কবর জিয়ারত করার কথা বলেননি। মসজিদে গিয়ে সমবেতভাবে ইবাদতও জরুরি নয়। যেসব ইবাদত নামাজ জামাতে এবং সমবেতভাবে আদায় করার প্রচলন রাসূল (সা.) থেকে প্রমাণিত, তা জামাতে আদায় করা। বাকিগুলো একাকী করা।

আল্লাহ তায়ালা নফল ইবাদতকে একাকিত্বে আদায় করাই বেশি ভালোবাসেন। ইখলাসের সঙ্গে স্বল্প আমল ঐকান্তিকতাহীন অধিক আমল থেকে উত্তম। সম্ভব হলে সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগি করে পরদিন অর্থাৎ ১৫তম দিনে নফল রোজা রাখার চেষ্টা করা, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। মনে রাখা দরকার, সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করা সুন্নত, ওয়াজিব, ফরজ কোনো আমল নয়। তবে ফজরের নামাজ পড়া ফরজ এবং জামাতে পড়া অপরিহার্য। অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যে, রাতভর নফল ইবাদত করে ফজরের নামাজ যেন কাজা না হয়।

শবেবরাতে বর্জনীয়

শবেবরাতের নামে রাস্তাঘাটে আতশবাজি, পটকাবাজি, ঘর আলোকসজ্জা, রাতে মসজিদে অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা, মরিচলাইট, তারাবাতি, আধুনিক নয়ানাভিরাম বর্ণিল বাতির ঝাড়ে দিগদিগন্ত পল্লাবিত করা, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, কবরে পুষ্প অর্পণ, রাস্তা-হাটবাজারে যুবকদের আড্ডা, অশূচি প্রতিযোগিতা এসব কাজ গর্হিত ও শরিয়ত পরিপন্থী। এগুলো অবশ্যই বর্জনীয়। কারণ কিছু কাজ অপচয়ের শামিল, আবার কিছু কাজ ইবাদতের একাগ্রতা বিনষ্ট করে।

লেখক: প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, শ্রীমঙ্গল মৌলভীবাজার

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.