--- বিজ্ঞাপন ---

সাংবাদিকতায় ‘নুসরাত’রা কতটুকু নিরাপদ?

0

আমি সাধারণত শিক্ষা গবেষণা বিষয়ক লেখা ছাড়া কখনো অন্য বিষয়ে লেখার চেষ্টা করেনি। তবে আজ যে বিষয়টি নিয়ে আমি লিখতে বসেছি, তার জন্য প্রথমেই পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যদিও এই বিষয়ে আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই, তবে গত চৌদ্দ বছর ধরে সাংবাদিকতায় যে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা রয়েছে সেই জায়গায় থেকে কয়েক লাইন পাঠকদের কাছে তুলে ধরলে অন্যায় হবে কি না তা জানি না। সময়ের প্রেক্ষাপটে আমার কাছে যা মনে হয়েছে, তা লেখা জরুরি। আর বিবেকের তাড়নায় এই লেখাটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

প্রথমে আসি গত ৬ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত একটি খবর নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ফেনীর সোনাগাজীতে যৌন হয়রানীর পর যে মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারা হলো, সেটি নিয়ে বিডিনিউজের শিরোনাম ছিল ‘মাদ্রাসা অধ্যক্ষের নামে শ্লীলতাহানির মামলা, ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা’ এই খবরে বলা হয়েছে, ফেনীতে শ্লীলতাহানির মামলা তুলে না নেওয়ায় এক মাদ্রাসা অধ্যক্ষের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। গুরুতর দগ্ধ ওই ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।

সংবাদটির কোথাও ‘ভুক্তভোগীর নাম, বাবার পরিচয় তুলে ধরা হয়নি। একই দিন দৈনিক প্রথম আলো তাদের অনলাইন সংস্করণের শিরোনাম করেছে, `পরীক্ষাকেন্দ্রে ছাত্রীর গায়ে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা’ সেই খবরেও তারা সংবাদে ভুক্তভোগীর নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিল। পেশাদার সাংবাদিকতা মূলত এটাইকে বলা হয়। যে সংবাদের নাম বা ছবি, ভুক্তভোগীর ‘সম্মানহানীর’ কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেই সংবাদে তা এড়িয়ে চলা ‘ভালো সাংবাদিকতার গুণ’। সেই কথায় বলা হয়েছে , ২০১৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সুরক্ষার ৮১ ধারায়। সেখানে বলা হয়েছে, There is a prohibition on reporting any matters relating to any case or proceeding involving a child. In any case under trial before the Children’s Court where a child is involved in the case or as a witness, no photograph or description of the child shall be published in any print or electronic media or through the internet which may directly or indirectly identify the child unless it is apparent to the court that such publicity will not be harmful for the interest of the child in which case the court may permit the publication of the child’s photograph, description, news or report অথাৎ শিশু আইনের অধীনে বিচারাধীন কোনো মামলা বা বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী এমন কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না যার মাধ্যমে শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে তা আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর এই অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অনধিক এক বছর কারাদণ্ড কিংবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়দণ্ড হতে পারে। কোনো কোম্পানি, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এই বিধান লঙ্ঘন করলে সেই কোম্পানি, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন অনধিক দুই মাসের জন্য স্থগিত রাখাসহ সেটিকে অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। আগের আইনে বিশেষ অবস্থা বিবেচনায় আদালত নাম-পরিচয় প্রকাশের অনুমতি দিতে পারলেও নতুন আইনে সেই বিধান রাখা হয়নি। সুতরাং, কোনোক্রমেই শিশু আদালতের বিচারকাজ এবং বিচারকাজে জড়িত শিশুদের নাম পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না নতুন আইনটি বলবৎ হলে।

শুধু আমাদের দেশের আইনই নয়, ইউনেস্কো প্রেণিত আইনেও প্রায় এক ধরনের কথা বলা হয়েছে দেশে এমন আইন থাকার পরও আমরা প্রতিদিনই সংবাদ প্রকাশে স্বেচ্ছাচারিত করে আসছি। সংবাদের নীতিমালার বাহিরে এসে নিজেদের ‘পাঠকপ্রিয়তা’ দেখাতে মুখরোচক সংবাদ করে যাচ্ছি। তেমনি একটি সংবাদ ছিল, সদ্য মারা যাওয়া নুসরাত জাহান রাফিকে নিয়ে দৈনিক মানব জমিনের ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির সংখ্যাটি। প্রকাশিত খবরে তারা শিরোনাম করেছিল, প্রেম প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায়…! প্রতিবেদনে সূচনাতে বলা হয়েছে, ফেনীতে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় নুসরাত জাহান রাফি (১৬) নামে এক দাখিল পরীক্ষার্থীর চোখে চুন জাতীয় দাহ্য পদার্থ ছুড়ে মেরেছে বখাটেরা। আর এমন সংবাদ হয়ে গেল নুসরাত নামের একটি মেয়ে তার পরিবারের কাঁটা। দুই বছর আগের ওই সংবাদটিতে শুধু মেয়েটির নাম প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেখানে বলা হয়েছে, আহত রাফি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরছান্দিায়া গ্রামের মুছা মানিকের মেয়ে।

কী অবাক কাণ্ডরে বাবা, ধাম ধাম করে মেয়ের নাম, বাপের নাম, গ্রাম সব লেখা হয়ে গেল। একবার ভুলেও ভাবলাম না, এই সংবাদের প্রভাব কতটা ভয়ানক হতে পারে? যে মেয়েটি মারা গেল, সেই নুসরাতের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দীতে সেই মেয়েটিকে বলতে শোনা গিয়েছিল, চুনের পানি নিক্ষেপের ঘটনায় পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, প্রেমের প্রস্তাব সাড়া না দেয়ায়…. এমন খবর তার জীবনের কলঙ্ক। আর এই কলঙ্কের সুযোগ নিয়েছিল সিরাজ। ঠিক তাই, আপনার যখন কোন জায়গা কেটে যাবে, ঠিক তখনই ওই জায়গাতে বেশি বেশি আঘাত লাগবে। তেমনি নুসরাতের জীবনে ঘটে যাওয়া ওই কৈশোরের ঘটনার সংবাদটি তার জন্য হয়ে গিয়েছিল চরম দূর্বলতা। যে দূর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা।

২০১৭ সালের ওই ঘটনায় নুসরাত চট্টগ্রামের পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল। সেই সময় সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিনহাজুর রহমান এবং ওসি হুমায়ুন কবীর, নুসরাতের উপর চুন নিক্ষেপ কারী বখাটে যুবককে অবশ্যই আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জানা গেল, ওই চুন নিক্ষেপকারী ছিলেন, বখাটে নূর উদ্দিন। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার তো দূরের থাক পুলিশ সেই সময় কিছুই করেননি। এরপর মেয়েটি দাখিল পরীক্ষায় পাস করে, আলিমে পড়াশুনা শুরু করলেন। সিরাজ উদ দ্দৌলার মাদরাসায় আসার পর, প্রথম বর্ষ থেকে রাফির প্রতি লোলুপ দৃষ্টি দিতেন বলে ‘নুসরাতের ভিডিওতে দেখতে পেলাম। ভিডিওতে নুসরাতকে বলতে শুনলাম, দাখিলের সময়ে ঘটে যাওয়া চুনের পানি নিক্ষেপের ঘটনাটি সিরাজ নুসরাতকে স্মরণ করে দিয়ে, তার সাথে থাকার প্রস্তাব দেয়। আর চুন নিক্ষেপকারী ছিলেন নূর উদ্দিন। যে আগে থেকে সিরাজের মাদরাসায় পড়াশুনা করতেন। সিরাজ সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে।

মেয়েটির নামসহ সেই সময় স্থানীয় সাংবাদিকরা, যে সংবাদটি করলেন, তা সাংবাদিকতার কোন নীতির মধ্যে পড়েছিল? গ্রাম, বাবার নাম ও ভুক্তভোগীর নামসহ এমন সংবাদ নুসরাতকে সমাজে যেভাবে পরিচয় করে দিয়েছিল, তাতে সামাজিকভাবে মেয়েটি ও তার পরিবার অন্যের কাছে ‘সম্মানহানী’ কারণ হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে, মেয়েটি গত দুই বছর নিজেকে অপরাধী মনে করে, সিরাজের কু-প্রস্তাব যেন আরও একটি ‘অসম্মানের’ কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সেই ব্যপারে সচেতন ছিলেন। স্থানীয় সাংবাদিক ও পত্রিকা হাউজের এমন সম্পাদকীয় নীতিমালা কতটা ভয়ানক হতে পারে, নুসরাতের ঘটনা তার প্রমাণ।

শুধু নুসরাতের ঘটনা সংবাদপত্রে নাম-ধামসহ প্রকাশ করে সংবাদপত্রগুলো নিজেদের ‘দৈন্যতা’ দেখায়নি, সেই সাথে দেখিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তাও। সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতের যে ভিডিওটি ‘জবানবন্দী’ হিসেবে নেয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়েছেন তা ইতিরকম আইনপন্থি বলেই মনে হচ্ছে। মামলাধীন বিষয় নিয়ে পুলিশ যদি কোন কিছু রেকর্ড করতে চায়, তবে তা আদালতের সম্মতিক্রমে নেয়া সম্ভব বলে জানতাম। আমার এই জানা ভুলও হতে পারে। তবে সরকারি উদ্দেশ্যে নেয়া এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তা শুধু ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা’ নয় ২০১৩ সালের ওই আইনের চোখে তা অপরাধ। তাছাড়া দুই বছর আগেই যদি নূর উদ্দিনের শাস্তি হতো, তাহলে কী সিরাজরা এভাবে সাহস পেত না।

একটি মেয়ে গত দুই বছর ধরে নিজেকে সামলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যেয়ে যারা পিছিয়ে দিয়েছিল, তাদের মধ্যে আমাদের ভুল সাংবাদিকতাও একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে সাংবাদিকতার খেসারত দিতে হয়েছে নুসরাত ও তার পরিবারকে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ফাঁক গলিয়ে নূর উদ্দিন-সিরাজদের চোখে নুসরাতরা হয়ে গিয়েছিল ‘দুর্বল শিকার’।

আমরা যে সাংবাদিকতায় প্রতিদিন নুসরাতদের নাম প্রকাশ করে, ভুক্তভোগীদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি, তাতে নুসরাতদের উপকারের পরিবর্তে অপকারই বেশি হচ্ছে। এটাকে আমি কখনোই ‘সাংবাদিকতার ব্যাকারণ বলে মনে করি না। যদিও বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব দেশের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণকারী তথ্য মন্ত্রণালয়ের। সময় থাকতে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত। প্রত্যেক হাউজেরই নিজস্ব সাংবাদিকতার নীতিমালা থাকলেও মৌলিক সাংবাদিকতায় একই রুপ হওয়া উচিত। ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে আমাদের আরও বেশি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সাংবাদিকতা যেন নুসরাতদের সারা জীবনের অপমানের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। হীনমন্যতায় না ভোগায়।

লেখক: এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.