--- বিজ্ঞাপন ---

সরেজমিন আরব আমিরাত -১ আইন কানুন কড়া, গাড়ীর দাম কম, মধ্যরাতেও সরগরম থাকে অলি-গলি

0

 

 

 

আরব আমিরাতে প্রথম যাওয়া। সাতটি প্রদেশ নিয়ে ‘ইউনাইটেড আরব আমিরাত’ বা ইউএই। প্রদেশগুলো হলো আবুদাবি, দুবাই, ফুজাইরাহ, রাস আল কায়মা, শারজাহ, আজমান এবং উম্মুাল কাওয়াইন। এদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী হচ্ছে আবুদাবি, এরপর দুবাই। আরব আমিরাতের রাজধানী আবুদাবি হলেও দুবাই বহুলাংশে জনপ্রিয়। চট্টগ্রাম থেকে আরব আমিরাতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা সাধারনত পছন্দ করেন বাংলাদেশ বিমান, এয়ার এরাবিয়া ও ফ্লাই দুবাই। চট্টগ্রামের মানুষেরর বেশি পছন্দ এয়ার এরাবিয়ার ফ্লাইট। আসা যাওয়ার বিমান ভাড়া ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এ বিমানটিতে একটিই ক্লাস যা সবার জন্য প্রযোজ্য। তবে ব্যতিক্রম একটাই তা হলো কিছু খেতে হলে কিনে খেতে হবে। এটি একটি বাণিজ্যিক বিমান হিসেবে পরিচিত। বিমানের ভেতরে অনেক কিছুই খাওয়ার বা কেনার আছে। স্কাই ক্যাফে নামের খাওয়ার মেনুও সবার হাতের কাছে থাকে। যে যার মতোন করে কিনে খান। বাঙ্গালিদের বেশিরভাগই দেশ থেকে কিছু না কিছু খেয়ে যান। কারন চড়া দামের খাওয়াগুলো বেশির ভাগ শ্রমজীবী বাংলাদেশিরা এড়িয়ে চলে। বেশিরভাগ মানুষ দুবাই বিমান বন্দরের চেয়ে শারজাহ বিমান বন্দও বেছে নেন। কারন এতে তুলনামূলক খরচ কম। দুবাই বিমান বন্দরের ব্যস্ততার কারনে শারজাহ এদেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি পছন্দেও এয়ারর্পোট।

আকাশ পথেও বুঝি জোয়ার ভাটা আছে। এ জোয়ার ভাটা হচ্ছে বাতাসের বেগ। যেটার উপর নির্ভর করে বিমানের গতি। বিমানটি কোন পথ দিয়ে যাচ্ছে তা বিমানের ভেতর থেকে বুঝা গেলেও আকাশ পথে নানা ঝামেলার কারনে বিমানেরর ল্যান্ডিং এ অনেকক্ষেত্রে সময় লেগে যায় বেশি। বিমানে উঠার আগে শুনেছিলাম সাড়ে ৪ ঘন্টা মতোন লাগবে, সেখানে লেগে গেলো ৬ ঘন্টা। তবে একটি বিষয় বেশ ভালো মনে হলো তা হচ্ছে শারজা বিমান বন্দরে নেমে দ্রুত কাস্টম পার হয়ে যাওয়া। তাদের কাজের গতি দেখে মনে হলো দুর থেকে আসা মানুষগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদেয় করা। তাদের ব্যবহারও অমায়িক। হাসি মুখে সব কিছু সম্পন্ন করা। যা দেখে আমাদের দেশের কাস্টমস এর বিরক্তিকর আচরনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

শারজাহ আর আজমান পাশাপাশি প্রদেশ। নিজেদের এরা স্বতন্ত্র প্রদেশ মনে করলেও মুদ্রা ‘দেরহাম’। প্রশাসন আলাদা। আইন কানুন বেশ কড়া। সুপরিসর রাস্তা। শুক্রবার বন্ধ থাকে সব কিছু। হোটেল থেকে ভোরে ফজরের আজান শুনা যায়। মাইকে সুমধুর কন্ঠে আজানের ধ্বনি অনেকটা আমাদের দেশের মতোন মনে হলো। আজমান এ জুমার নামাজের ব্যতিক্রম হলো এরা খুতবার পর পরই মুনাজাত করে নেয়। জুমার জামাতের নামাজে আলহামদু সুরা পড়ার পর শেষ মূহুর্তে আমাদের দেশে ‘আমিন’ শব্দটির উচ্চারন সাধারনত আমরা নিরবে বলি। এরা বলেন সরবে। এখানকার মসজিদগুলোর নিমার্নশৈলি চমৎকার। মসজিদের সংখ্যাও কম নয়। প্রায় প্রতিটা মসজিদে বিশাল আকারের গম্ভুজ দেখা যায়। নিমার্নশৈলির কারনে মসজিদগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি নেই। যে যার মতোন করে সেরে নেন। শুক্রবারে রাস্তাায় গাড়ি তেমন থাকে না বললেই চলে। তবে খোলার দিনে ট্রাফিক হলেও তা তাদের রাস্তার পরিকল্পিত লাইনের কারনে বিরক্তকর মনে হয় না। রাস্তায় গাড়ি চলাচল পথ এমন যে কোন এলাকায় কত গতিতে গাড়ি চলবে সব নির্ধারন করা আছে। ইচ্ছে করলেই কেউ অতি জোরে বা আস্তে গাড়ি চালাতে পারবে না। পেছন থেকে কোন কারনে হঠাৎ করে গাড়ির হরণ বাজার আওয়াজ শুনলে মনে হবে সামনের জনের কারনে বিরক্ত প্রকাশ। গাড়ি পার্কিং খুজে সঠিক জায়গায় পার্ক করতে হবে। যতক্ষন জায়গা খুজে পাওয়া না যায় ততক্ষন আপন গতিতে ঘুরতে হবে। অবশ্য বেশি ঘুরা লাগে না। কোথাও মেশিনে টাকা দিয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট করতে হয়।

এখানে গাড়ির দাম এত সস্তা যে বলার মতো না। আমাদের দেশে রিকন্ডিশনড যে সব গাড়ি কিনতে ২০/২২ লাখ টাকা লাগে এখানে তা ৩/৪ লাখ টাকায় পাওয়া যায়। তার একমাত্র কারন আমাদের দেশের মতোন হরেক রকমের বাস ট্যাম্পু নেই। প্রাইভেট কার আছে। গাড়িতে উঠতে হলে দরদাম চলে না। সিগন্যাল দিলেই যেখানে যেতে চান নিতে বাধ্য। তবে বাঙ্গালিদেও বড় অংশই এখানে নিজস্ব গাড়ী ব্যবহার করেন। সহজে কিনতে পাওয়া যায় গাড়ী। ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলেই এক জনের গাড়ী অন্য চালালেও কোন অপরাধ নজরে পড়েনি। সহজ বাস বা ট্রেন সার্ভিস না থাকায় নি¤œ আয়ের মানুষদের চলাফেরা বেশ কঠিন। এখানে ট্রেন লাইন নির্মান বেশ ব্যয়বহুল। দুবাই – আবুদাবিতে মরুভুমির উপর রেল লাইন নিার্মন করতে গিয়ে কোন কোন প্রদেশ অর্থ সঙ্কটে পড়েছে বলে নজির রয়েছে। গাড়ী চালানোর ক্ষেত্রে এখানে ‘পান থেকে চুন খসলেই জরিমানা’! এ বিষয়টি আমাকে বেশ অবাক করেছে। বেশিরভাগ বাংগালি যারা এখানে অনেকদিন ধরে আছেন প্রায় সবার গাড়ী আছে। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে এদের নিয়মের বাইরে গেলেই জরিমানা। রাস্তাাগুলোতে ক্যামেরা এমনভাবে ফিট করা আছে ফাকিঁর কথা চিন্তা করাও দুরহ। অনেক সময় বছরে গাড়ির দামের চেয়ে জরিমানা বেশি হয়ে যায়। মাছ ধরার ফাদেঁর মতো গাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের ফাদঁ নজরে পড়ার মতো। বছর শেষে গাড়ির কাগজ রিনিও করতে কড়ায় গন্ডায় সব পরিশোধ করতে হবে, যা থেকে পালানোর কোন পথ নেই। আমাদের দেশ থেকে যারাই আসবেন তাদের এ বিষয়টি সম্পর্কে যানা অনেক জরুরী। এখানকার গাড়ীগুলোর চালকের আসন বাম দিকে। আমাদের দেশে ডান দিকে। গাড়ির ভেতরে সামনে যারা বসেন বেল্ট বাধা বাধ্যতামূলক। গাড়ি চালানো অবস্থায় চালকের মোবাইলে কথা বললে কড়া জরিমানা। রাস্তাায় ইমার্জেনসি সাইডে গেলেই খবর আছে। সঠিক সময়ের মধ্য গাড়ির কাগজ রিনিও করতে হবে অন্যথায় সব কিছু অটোমেটিক বøক হয়ে যাবে। কোন ঘুষের কারবার নেই। মোবাইলে জরিমানা বা কাগজের হালনাগাদ তথ্য এসে যাবে। এখানের রাস্তাগুলোর প্রতিটির সাইডে রয়েছে আলাদা লেন, লাল রংয়ের এ লাইনে দ্রুত গতির এম্বুলেন্স বা জরুরি প্রয়োজনে কিছুক্ষনের জন্য অবস্থান করতে পারবে। লাইন চিহ্নিত গাড়ির লাইনটি সাধারন মানুষের ব্যবহারের বাইরে। ভুল রাস্তায় কোন কারনে গাড়ি চলে গেলে যেনতেনভাবে পেছনে আসার সুযোগ নেই। সামনে ইউ টার্ন আছে। ঘুর পথে সঠিকভাবে আসতে হবে। সামনের মার্ক আর সাইনবোর্ড দেখে সহজে চলাচল করা যায়। রাস্তাগুলো সুপরিসর আর সোজা। এক লাইনে আপনি নিদির্ষ্ট গতিতে সহজে চলতে পারেন। দ্রæত গতিতে চলে দুরে যাওয়ার গাড়িগুলো। পদ্ধতিগত কারনেই দ্রæত চলা গাড়িগুলো দুঘর্টনার শিকার হয় না। দুরের রাস্তা হোক বা কাছের রাস্তা। কোথায় সমস্যা হলে চোখের পলকে উদ্ধারকারি চলে আসবে। ট্রাফিক ব্যবস্থা অত্যাধুনিক, তাই এখানে দুর্ঘটনার হার তেমন নেই বললে চলে। তবে শহরের মধ্যে দ্রæত গতিতে চলা রোধ করার জন্য গাড়ী চালকদের আইনি কাঠামোর মধ্যে রাখতে জরিমানাও বেশি। বিশেষ কওে পথচারি পারাপারের যে জেব্রা ক্রসিং তাতে ভুলক্রমে যদি গাড়ি উঠে যায় তাহলে নির্ঘাত গুনতে হবে একবারে বাংলাদেশি টাকায় ২০ হাজার টাকারও বেশি জরিমানা! দিন রাত ২৪ ঘন্টা একই পদ্ধতিতে একই নিয়ম কানুনের মধ্যে গাড়ী চলে। মধ্য রাতে ফাকাঁ হলেও নিয়ম কানুন একই থাকে। ইচ্ছে করলেই ফাকাঁ রাস্তায় স্বাধীনভাবে কিছু করা যাবে না।

এ দেশের ব্যবসায়ী বা আরব যারা চাকরীতে নিযুক্ত নেই তারা বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেন। রাত যত গভীর হয় ততই যেন এ দেশের মানুষের চোখ ফোটে। মধ্য রাত পর্যন্ত দোকান-পাট, শপিং মল, খাবার দোকান খোলা থাকে। বোধহয় দিনের বেলায় অতিরিক্ত গরমের কারনে এ অভ্যাসটি গড়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে এখানে অনিয়মই যেন নিয়ম। দিনের চেয়ে রাতের অলি -গলি বেশ সরগরম থাকে। খাবার দোকান রয়েছে প্রায় সবখানে। বাংগালী হোটেলও নেহায়েত কম নয়। পাকিস্তানী হোটেলের আধিপত্য নজরে পড়ার মতোন। আজমান ও শারজাহ এলাকায় বাংলাদেশের চট্টগ্রামের লোকই বেশি। চট্টগ্রামের লোকেরা সবাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। তবে যারা ৮ -১০ বছর ধরে রয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আরবি ভাষায় দক্ষ। অনেকে বছরে বেশ কয়েকবার দেশে যাতায়াত করেন। তবে শ্রমিকদের বেশিরভাগই দু’বছর পর দেশে যাবার সুযোগ পায়। অফিসগুলোতে ভারতীয়দের প্রাধান্য থাকায় তারা বাংগালীদের কাজ কর্ম কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেয়। উচ্চপদেও স্থানগুলোতে বাঙ্গালীদের স্থান অপ্রতুল। বেশিরভাগ বাঙ্গালী হয় ছোট ব্যবসা, অন্যথায় কর্মী হিসেবে নিয়োজিত। আরব আমিরাতের ৭ প্রদেশেই বাঙ্গালীদেও একই চিত্র। আবুদাবি ও দুবাই এর তুলনায় আজমান, শারজাহ ও রাস-আল-কায়মাতে বসবাসের খরচ তুলনামূলকভাবে কম। তাই বেশিরভাগ বাঙ্গালি যারা পরিবার নিয়ে থাকেন তারা এসব এলাকা বেছে নেন। উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারনে যে প্রদেশে যেতে তেমন সময় লাগে না। বাঙ্গালীরা পরিশ্রমি বলে সুনাম রয়েছে। এখনো আরব আমিরাতের সাত প্রদেশে যেভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে তাতে আরও বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালীর স্থান হবে। সরকার যদি বাঙ্গালী শ্রমিকদের ভিসা খুলতে পারে তাহলে আরব আমিরাত থেকে বিপুল পরিমান রাজস্ব আয় অসম্ভব নয়।

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.