--- বিজ্ঞাপন ---

কোন পথে সৌদি আরব? 

0

দীর্ঘদিন ধরে সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে সৌদি আরব। দুই শতক ধরে ওহাবিজমের মতো কট্টর ইসলামী ধ্যানধারণা প্রচলিত দেশটিতে। সেখানে এখন পরিবর্তনের সুর। কিছুদিন আগেই নারীরা গাড়ি চালানোর অধিকার পেয়েছেন। রেড সি’তে পর্যটকদের জন্য বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে। অর্থ্যাৎ নারীরা সেখানে বিকিনি পরতে পারবেন, থাকবে উন্মুক্ত বার। পরিবর্তনের এমন সুর কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়।

এসব কিছুর মূলে রয়েছেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি দেশটিকে উদারপন্থী মুসলিম দেশে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তার দেশকে আমূল বদলে দিতে চান। অবশ্য সৌদি যুবরাজের এই উদারপন্থি মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করছেন অনেকে। একে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হটানোর কৌশল ভাবছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার বলছেন, এটা দেশে বিনিয়োগের আকর্ষণের কৌশল।এত দিন সৌদি আরবের অর্থনীতি তেল দিয়ে চলেছে। ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় এখন পর্যটন, প্রযুক্তি, বাণিজ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে হাত বাড়াতে চাইছে দেশটি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে চাইছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মরুভূমিকে নতুন শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মূলত তেলভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রূপান্তর, নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি ও বিনিয়োগ বাড়াতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, উদারপন্থী ইসলামে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা সৌদি আরবের বাজার পরিকল্পনার একটি অংশ। তাদের মতে, শুধু ঘোষণা দিয়েই চরমপন্থা থেকে হুট করে বের হয়ে আসতে পারবে না দেশটি। এমন পদক্ষেপে সৌদি আরবে উল্টো অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। রাজধানী রিয়াদে আয়োজিত তিন দিনের অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে প্রায় দুই হাজার বিদেশি বিনিয়োগকারী উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে ৩২ বছর বয়সী যুবরাজ আরও বলেন, ‘আমরা একটি স্বাভাবিক জীবন চাই। এমন একটি জীবন চাই যেখানে ধর্মের ভাষান্তর হবে সহনশীলতা ও আমাদের দয়ার ঐতিহ্য। সৌদি জনগণের ৭০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে এবং কোনো উগ্রবাদী আদর্শের সঙ্গে বুঝতে বুঝতে আমরা জীবনের বাকি ৩০টি বছর নষ্ট করতে পারি না। আমরা উগ্রপন্থাকে আজ, এখনই ধ্বংস করব। খুব শিগগিরই আমরা উগ্রপন্থার অবসান ঘটাব।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোহাম্মদ বিন সালমান মূলত সৌদি আরবের তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই তরুণ সম্প্রদায় ধর্মীয় দিক থেকে বয়স্কদের মতো গোড়া নয় এবং বর্তমান উচ্চ বেকারত্ব হারের মূল ভুক্তভোগী তারা। এদিকে ৫ নভেম্বর রাতে ইয়েমেন সীমান্তের কাছে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে এক সৌদি প্রিন্স নিহত হন। নিহত প্রিন্স মানসুর বিন মুকরিন সৌদি আরবের আসির প্রদেশের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্ঘটনার সময় হেলিকপ্টারটিতে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন।

সৌদি সংবাদমাধ্যম বলছে, নিয়মিত অনুসন্ধানী সফর শেষে ফেরার সময় স্থানীয় সময় গতকাল রাতে প্রিন্স মানসুর ও সঙ্গী কর্মকর্তাদের নিয়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। এর কারণ এখনো জানা যায়নি। নিহত প্রিন্স মানসুর বিন মুকরিন আরেক সাবেক যুবরাজের ছেলে। তার বাবা মুকরিন বিন আবদুল আজিজ বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সৎভাই। ২০১৫ সালে বাদশাহ হওয়ার পর সালমান তার সৎভাই মুকরিন বিন আবদুল আজিজকে যুবরাজ পদ থেকে সরিয়ে দেন।ঘটনাটি এমন সময় ঘটল, যখন সৌদি আরবে দুর্নীতিবিরোধী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালালসহ ১১ যুবরাজ ও চার মন্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষ। বরখাস্ত করা হয়েছে নৌবাহিনীর প্রধানকে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীও গ্রেফতার হয়েছেন। দুর্নীর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে ১৯৯ জন। সৌদি আরবে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি ডলারের দুর্নীতি হয়েছে বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সৌদ আল-মোজেব। এসব ঘটনার মধ্যেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ আকস্মিক সফরে সৌদি আরব যান। তিনি এমন একসময় রিয়াদে গেলেন, যার কিছুদিন আগেই সেখানে বসে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন লেবাবনের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। সেই সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগে আটক হয়েছেন সৌদি রাজপরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এ ছাড়া লেবানন, ইয়েমেন ইস্যুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরিতা প্রকট হয়েছে।

এর আগে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ নতুন একটি দুর্নীতি দমন কমিটির ঘোষণা দেন। এই কমিটির প্রধান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। নতুন এই কমিটিকে তদন্ত, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাদশাহর জারি করা ডিক্রিতে বলা হয়, দুর্নীতির মূলোৎপাটন ছাড়া সৌদি আরব টিকতে পারবে না। ধারণা করা হচ্ছে, শাসনব্যবস্থায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেই এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর পেছনে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যকে ছাপিয়ে আরও কিছু রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, যুবরাজ সালমান দেশের রাজনীতিতে যে সংস্কার করতে চান, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দুর্নীতির অজুহাতে তার বিরোধীদের শক্তিশালী পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। গ্রেফতার হওয়া প্রিন্সদের মধ্যে দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা প্রিন্স মিতেব বিন আবদুল্লাও রয়েছেন। দেশটির ক্ষমতাধর ন্যাশনাল গার্ডের মন্ত্রীর পদ থেকে তাকে সরিয়ে প্রিন্স খালেদ বিন আয়াফকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে আসলে ৩১ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানেরই নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এত দিন সৌদি রাজপরিবারের অন্য একটি শাখার নিয়ন্ত্রণে ছিল এই মন্ত্রণালয়। প্রিন্স মিতেব হলেন প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর ছেলে। একসময় তাকেই সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে মনে করা হতো।

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবা সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ ২০১৫ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এর আগ পর্যন্ত বহির্বিশ্বে বর্তমান যুবরাজকে খুব কম লোকই জানতেন। তার ক্ষমতায় আরোহণ মূলত শুরু হয় তিন বছর আগে থেকে। এরই মধ্যে তিনি বেশ কিছু উচ্চাকাক্সক্ষী সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। সৌদি আরবে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা রক্ষণশীল ঐতিহ্যকে ভাঙার চেষ্টা করছেন তিনি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি কিছু খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমিয়ে এনেছেন। গত জুন মাসে সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে নিজের সন্তান মোহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ ঘোষণা করেন বাদশাহ সালমান।

এরই মধ্যে প্রিন্স মোহাম্মদকে দেশটির জনগণ ‘ডি ফ্যাক্টো’ নেতা হিসেবে মনে করছেন। রদবদলের ফলে পুরো দেশের সব নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ পেলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এই যুবরাজ। তবে তিনি বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। এ বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে রক্ষণশীল সৌদি সমাজে প্রথার বিরুদ্ধে হাঁটতে শুরু করেন যুবরাজ। এরপর থেকে আরও নানা ধরনের সংস্কার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু আবেগী এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞ এই যুবরাজের সফলতার সম্ভাবনা কতটা? সৌদি যুবরাজ যে ঘোষণা দিয়েছেন, আদৌ তা বাস্তবায়ন করা হবে কি না-তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। সৌদি আরবে রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠী খুব প্রভাবশালী। দেশটির প্রশাসনেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আর সামাজিক প্রতিপত্তির কথা না বললেও চলে। যুবরাজের সাম্প্রতিক বক্তব্য এই গোষ্ঠীর জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ থেকে নতুন বিরোধ সৃষ্টি হবে, নাকি সত্যিই বদলে যাবে সৌদি আরব? উত্তরের জন আপাতত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.