--- বিজ্ঞাপন ---

যে কারনে আলোচিত সাংবাদিক ফ্রেডরিক ফরসাইথ

0

কাজী আবুল মনসুর :

মিলার একজন সাংবাদিক। বাড়ী জার্মানী। অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। পুলিশের সাথে তাঁর বেশ খাতির। একদিন বন্ধু কার্ল ব্রান্ডট তাঁকে জানালো ‘এক বুড়ো ইহুদী গ্যাস প্রয়োগে আত্মহত্যা করেছে। রেখে গেছে একটি ডায়রি। সলোমন টিউব নামের এই মানুষটি যে সব করুণ চিত্র দেখেছে তার বর্ননা ছিল ডায়রিতে। হিটলারের সময়ে এস এস বাহিনী খ্যাত একটি বাহিনীর প্রধান ছিলেন রশম্যান। রশম্যানের যাবতীয় নির্যাতনের কাহিনী ছিল ডায়রিতে। ১৯৪৩ ও ৪৪ সালের জার্মানীর রিগাতে রশম্যানের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে লাখো মানুষ। কাউকে মাথায় গুলি করে, কাউকে ফাঁসি দিয়ে আবার কাউকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে রশম্যান। রাশিয়া যখন রিগা’র দখল নিল তখন মুক্তি মেলে অনেকের। পাওয়া যায় রশম্যানের হত্যাযজ্ঞের চিত্র। যে চিত্র দেখে শিউরে উঠেছিল সাধারণ মানুষ। এ রশম্যানের নির্যাতনের চিত্রটি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিল সলোমন টিউব। এত মানুষ হত্যার পর এক পর্যায়ে আত্মগোপন করে রশম্যান। ডায়েরি পড়ার পর সেই রশম্যানকে খোঁজার দায়িত্ব নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মিলার। এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর সত্য কাহিনী নিয়ে বৃটেনের সাংবাদিক ফ্রেডরিক ফরসাইথ লিখেছেন তাঁর স্মরনীয় একটি উপন্যাস ‘দ্য ওডেসা ফাইল’। প্রকাশের পর থেকে যে বইটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সারা বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় তোলপাড় হয়, সাংবাদিক ফ্রেডরিক ফরসাইথ নিজেই শিরোনাম হন। সাংবাদিকরা কোন সংবাদের পেছনে ছুটে কি পরিমান ঝুঁকি নিতে পারেন তার বিস্তারিত বর্ননা আছে ওডেসা ফাইলে। বইটি প্রকাশের পর শিকাগো বৃটেন পত্রিকা লিখেছে..‘দ্য ওডেসা ফাইল খুবই সুচিন্তিত, গবেষণালদ্ধ এবং সুগঠিত একটি উপন্যাস। এটি দারুণ তথ্যসমৃদ্ধ…বির্তকিতও বটে’। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ‘গল্পটা বোমার মতোই..পাঠক সাসপেন্স আর উদ্বিগ্নতার মধ্যে পাতা ওল্টাতে থাকবে। দৃশ্য থেকে দৃশ্যে এই উদ্বিগ্নতা আর থৃল ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে..। ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, ‘এই কাহিনী বাস্তবতা থেকে নেয়া, তাই পাঠককে আরো বেশি রোমাঞ্চিত করে। আর ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন লিখেছিল ‘এটি ফরসাইথের আরেকটি জাদুকরী কাজ’। ইংল্যান্ডের কেন্ট এর অধিবাসী সাংবাদিক ফরসাইথ। ১৯৩৮ সালের ২৫ আগষ্ট তাঁর জম্ম। তরুণ বয়সে জঙ্গী বিমানের পাইলট হিসেবে কাজ করার পর সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। অত্যন্ত মেধাবী এ সাংবাদিক একের পর এক বই লিখে বিশ্বে আলোচিত হন। ১৯৬১ সালে রয়টার্স আর ১৯৬৫ সালে কাজ করেন বিবিসি’তে। বিবিসিতে প্রচারিত নাইজেরিয়ান সিভিল ওয়ার ডকুমেন্টারি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বইগুলোর মধ্যে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত দ্য ডে অব দি জ্যাকেল এবং দ্য ওডেসা ফাইল শ্রেষ্ট। তাঁর উপন্যাস দ্য ডে অব দি জ্যাকেল অবলম্বনে রচিত হয় হলিউডের তিনটি চলচিত্র। এরপর ১৯৭২ সালে তার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উপর ভিত্তি করে দ্য ওডেসা ফাইল ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। একজন সফল সাংবাদিকের সর্বশ্রেষ্ট র্কীতি এ উপন্যাসটি।‘… সন্ধ্যাবেলা দলগুলো যখন ধুকতে ধুকতে অবসন্ন পায়ে ফটকের ভেতর ঢুকতো তখন রশম্যান আর কিছু সাঙ্গোপাঙ্গো প্রবেশমূখে দাঁড়িয়ে এলোপাতাড়ি চেক করতো। হঠাৎ কোন একজন নারী বা শিশুকে ডেকে হুকুম করতো ফটকের একপাশে নগ্ন হয়ে দাঁড়াতে। যদি এক টুকরো রুটি বা আলু পাওয়া যেতো তাদের শরীরের কোথাও, তো তাদের সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে সবাইকে মার্চ করিয়ে টিন স্কোয়ারে দিকে এগিয়ে যেতে দিতো হাজিরার জন্যে। সবাই সারি বেঁধে দাঁড়ালে রশম্যান দৃপ্তভঙ্গিতে এগিয়ে আসতো। পেছনে পেছনে এস এস রক্ষীদের পাহারায় ওই হতভাগা মানুষগুলো, হয়তোবা তারা দশ বারো জন। তাদের মধ্যে যারা পুরুষ তারা গিয়ে উঠতো ফাঁসির মঞ্চে, কাঠের চারকোনা চেয়ারে বসে গলায় ফাঁসির দড়ি পরে অপেক্ষা করতো কখন তার হাজিরা শেষ হবে। তারপর রশম্যান এগিয়ে যেতো সেই ফাঁস গলায় লাগিয়ে থাকা সারিবদ্ধ লোকগুলোর দিকে। উচু চেয়ারে বসে থাকা লোকগুলোর মুখের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে হঠাৎ চেয়ারে লাথি মেরে সেটা সরিয়ে দিতো। লোকটা হ্যাচকা টানে ফাসিঁর দড়িতে ঝুলে পড়তো। সামনা সামনি মুখের দিকে চেয়ে কাজটা করতে ভালোবাসতো রশম্যান, যাতে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটা তার মুখ দেখতে পায়।…ক্যাম্পের ভেতরে খাবার নিয়ে আসতে গিয়ে যদি কোন বন্দিনী ধরা পড়তো, তবে তার চোখের সামনে প্রথমে পুরুষ অপরাধীগুলোকে ধরে ধরে ফাঁসিতে লটকাতো..এমন সব বর্ননায় ভরপুর বইটি।ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বইটির বাংলা অনুবাদ করে সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজলভ্য করেছেন।’ ঠিক বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের মতো রশম্যানও জড়িত ছিলেন যুদ্ধাপরাধে। জার্মানীর রিগাতে ছিল তার যাবতীয় কুকীর্তির আস্তানা। উপন্যাসের সাংবাদিক মিলার একটু একটু করে খুঁজতে গিয়ে দেখতে পায় রিগায় যেসব যুদ্ধাপরাধী ছিলো তাদের মধ্যে মাত্র তিন জনের সশ্রম কারাদন্ড হয়েছে। আর মূল নায়ক রশম্যানের কোন সাজা হয়নি। অথচ যে কিনা হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের হত্যাকারী। সূত্র ধরে এগিয়ে যায় মিলার। সম্মুখীন হন নানা বাধা বিপত্তির। কারণ ওডেসা’রা ছিলো শক্তিশালী। ১৯৬৪ সালে জার্মানীর বন শহরের বিচার মন্ত্রনালয়ে এক অজ্ঞাত প্যাকেজ এসে পৌছায়। হাতে গোনা অল্প কয়েকজন অফিসারই কাগজের তালিকাটি দেখেছিলো। ঐ প্যাকেজটাই আসলে ‘দ্য ওডেসা ফাইল’। যার অর্থ এসএস এর সাবেক সদস্যদের সংগঠন। যারা ছিলেন সংগঠিত। যে কারনে রশম্যানকে খুঁজতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েন মিলার। মুখোমুখি হন রশম্যানের। কিন্ত দুর্ভাগ্য রশম্যান তাকে মেরে আহত করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দক্ষিন আমেরিকা হয়ে আর্জেন্টিনা পাড়ি জমান রশম্যান। কিন্ত এরই মধ্যে তার অভিযানে প্রকাশিত হয়ে যায় ওডেসা ফাইলের যুদ্ধাপরাধীদের নাম। চাপের মুখে সরকার তাদের ধরতে শুরু করে অভিযান।’ সাংবাদিক ফ্রেডরিক ফরসাইথ শুধু ওডেসা ফাইল লিখে সংবাদের শিরোনাম হননি। এ সাংবাদিক ১৯৭৪ সালে লিখেন দ্য ডগ্স অব ওয়ার, দ্য শেপার্ড, দ্য ফোরথ প্রোটোকল, দ্য নিগোশিয়েটর, দ্য ডেভিল্স অলটারনেটিভ, দ্য ফার্স্ট অব গডসহ বেশ কয়েকটি বহুল আলোচিত উপন্যাস।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.