--- বিজ্ঞাপন ---

উপমহাদেশে কড়া নাড়ছে আল কায়েদা

0

কাজী আবুল মনসুর  :

আল কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরির আবারো একটি ভিডিও বার্তা প্রচারিত হয়েছে। প্রকাশিত ভিডিও বার্তায় জওয়াহিরিকেই দেখা যাচ্ছে। কাশ্মীরকে ভারতের শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং জম্মু কাশ্মীর রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন যুদ্ধে যাওয়ার আহ্বান রয়েছে জওয়াহিরির ভিডিও বার্তায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা পৃথিবীর সব মুসলিমের কর্তব্য— এমন বার্তাও দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে আল কায়দার প্রকাশ করা ভিডিয়োয়।। বার্তা প্রচারের পর সতর্ক সবাই। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র ভারতবর্ষ। এর আগেও একবার জাওয়াহিরি বার্তা দিয়েছিলেন। ওসামা বিন লাদেনের শীষ্য আয়মান আল জাওয়াহিরি উপমহাদেশে প্রথম ভিডিও বার্তায় উল্লেখ করেন, মায়ানমার, বাংলাদেশ, আসাম, গুজরাট, কাশ্মির, আহমেদাবাদে মুসলমানদের উপর অন্যায়-অবিচার চলছে। তাদেরকে এ শোষন থেকে মুক্ত করতে ‘আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ গঠন করা হবে। এবার তিনি কাশ্মির নিয়ে লেগেছেন।

আয়মান আল জাওয়াহিরি মূলত একজন চিকিৎসক। মিশরে তার জন্ম। আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর জাওয়াহিরির নাম প্রকাশ্যে আসে। তবে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর জঙ্গি এ সংগঠনটির অবস্থা তুলনামূলকভাবে আগোছালো হতে থাকে। বিশেষ করে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আল কায়েদার জঙ্গিদের বেশ বেগ পেতে হয়। বিন লাদেনের পর মুল নেতৃত্ব মোল্লা ওমরের হাতে তুলে দেয়া হলেও আল জাওয়াহিরির উপস্থিতিও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্ত সিরিয়া ও ইরাকে আল কায়েদার বিপরীতে আইএস (ইসলামিক স্টেট) এর সরব উপস্থিতির কারণে জাওয়াহিরির নেতৃত্ব বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে।

এ অবস্থায় ভারতের ১৮ কোটি মুসলমানকে টার্গেট করে অনেকটা আকস্মিক এ ভিডিও বার্তার কারণে জাওয়াহিরি আবারও আলোচনায় আসেন। ভিডিও বার্তায় তিনি মোল্লা ওমরের নেতৃত্বের উপর অবিচল আস্থা রাখার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম ‘আল কায়েদা’।

‘মখতব আল খিদমার’ নামের একটি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সংগঠন ছিল। ওসামা বিন লাদেন এ সংগঠনের পেছনে খরচ করেন কোটি কোটি টাকা। ৮৮ সালের দিকে মখতব আল খিদমার এর উগ্রপন্থী সদস্যদের দিয়ে গঠন করা হয় ‘আল কায়েদা’। এই আল কায়েদাকে সংগঠিত করার পেছনে আমেরিকান সরকারই এক সময় কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে। ৭৯ সালের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন হলে আমেরিকা বসে থাকতে পারেনি। কারণ আফগানিস্তানের বারবাক কায়মাল সরকার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পোষ্য পুত্র বলে খ্যাত বারবাক কায়মাল সরকারকে ধংস করতে আমেরিকা শুরু করে নিজেদের কার্যক্রম। যে করেই হোক আফগানকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্ঠা করেছিল তারা। কারণ আমেরিকা মনে করেছিল, আফগানিস্তানে সোভিয়েত সরকার মানে পুরো ভারতবর্ষে সোভিয়েত আধিপত্য। এ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলের উপর থেকে আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ হারাবে। তাই আফগান সরকার ধ্বংসের খেলা শুরু করে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তারা যোগাযোগ শুরু করে আমেরিকান সিআইএ’র সাথে।

আইএসআই ও সিআইএ মিলে শুরু করে আফগান সরকার ধ্বংসের মিশন। কাকে দিয়ে এ মিশন শুরু করা যায়। উভয়ের কাছে এ সময় প্রিয় লোক হিসেবে নাম আসে ওসামা বিন লাদেনের। কারণ ওসামা বিন লাদেন এ সময় আমেরিকার ঘনিষ্ট মিত্র। কে এই ওসামা বিন লাদেন? তার পুরো নাম ‘ওসামা বিন মুহাম্মদ বিন আবাদ বিন লাদেন’। ১৯৫৭ সালের ১০ মার্চ সৌদি আরবে জন্ম। লেখাপড়া করেন জেদ্দার ফয়সল বিশ্ববিদ্যালয় ও কিংস আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত ওসামা বিন লাদেন পারিবারিকভাবে কোটিপতি। যুবা বয়সে তার সাথে ফিলিস্তিনি মৌলবাদী নেতা শেখ আবদুল্লা আজমের বেশ সখ্য গড়ে উঠে।

শেখ আবদুল্লা আজম মূলত একজন ধর্মীয় উগ্রবাদী নেতা। তাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন লাদেন। শেখ আজমের প্রতিষ্ঠিত মখতব আল খিদমার অন্যতম পৃষ্টপোষক ছিলেন লাদেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর লাদেনের দিকে আমেরিকান সিআইএ’র নজর পড়ে। লাদেনকে আমেরিকার ঘনিষ্ট মিত্র হিসেবে আফগান মুসলিমদের সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত থেকে মুক্ত করতে সহযোগিতা চাওয়া হলে লাদেন রাজি হয়। সৌদি আরবের রাজকীয় হাল ছেড়ে যুবক লাদেন আমেরিকান টাকা ও অস্ত্রের কাছে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের সময় লাদেন আমেরিকার হয়ে মাঠে নামেন আফগান মুক্ত করতে।

অত্যাধুনিক অস্ত্র আর নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয় আল কায়েদার সদস্যদের। আইএসআই ও সিআইএ’র সহযোগিতায় আফগানিস্তানে বসে লাদেন রুশ বাহিনীর সাথে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে যান। অত্যাধুনিক অস্ত্রেও যোগান বাড়তে থাকে। মেশিনগান, স্টিঞ্জার মিশাইলসহ নানা ভারী অস্ত্র লাদেনের হাতে আসতে থাকে। এক সময় লাদেন অনেকটা দানব হয়ে উঠে। সৌদি আরব ও আফগানিস্তানে বসে লাদেন তার অভিযানগুলো চালাতে থাকে। ওসামা বিন লাদেনের নাম ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গিগোষ্ঠির মাঝে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আগ্রাসনের কয়েক বছর ধরে যখন রুশ বাহিনীর উপর একের পর এক জঙ্গি হামলা চলছিল তখন সমাজতন্ত্রেও পতনের হাওয়া বইতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর আমেরিকার সব হিসেব নিকেশ পাল্টে যায়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে লাদেনকে তারা দানব বানিয়েছে সে লাদেনই তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠে। ১৯৮৮ সালে লাদেন তার নিজ দল ‘আল কায়েদা’র ঘোষণা দেন। ১৯৯০ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করে তখন ওসামা বিন লাদেন কুয়েত মুক্ত করতে ১ লাখ প্রশিক্ষিত মুজাহিদ প্রস্ত্তত বলে জানান। কিন্ত সৌদি সরকার কুয়েত মুক্ত করতে লাদেনকে পাত্তা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়ালে লাদেন বড় ধরনের ধাক্কা খায়। লাদেনের সাথে আমেরিকার দুরত্ব বাড়তে থাকে। পরবর্তিতে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে লাদেন আমেরিকার চক্ষুশূল হয়ে উঠে।

আমেরিকার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলে লাদেন স্থায়ী বসবাসের জন্য আফগানিস্তানে চলে আসেন। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে আল কায়েদাকে শক্তিশালী করতে থাকেন। শুরু হয় আল কায়েদার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। আফগানিস্তানের তোড়োবোড়ো পাহাড়ে বসে আল কায়েদার বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে লাদেন। তার সংগঠনের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। আমেরিকা লাদেনের এ উত্থানকে প্রথমদিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। লাদেন আফগানিস্তানে আসন গেড়ে বসার পর আফগানরা তার পতাকাতলে সংগঠিত হতে থাকে।

একদিকে পাকিস্তান অন্যদিকে আফগানিস্তান জুড়ে আল কায়েদার জয় জয়কার শুরু হয়। লাদেন আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে শুরু করে। আমেরিকানদের খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। লাদেনের কারণে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আমেরিকান আধিপত্য খর্ব হতে থাকে। নববই দশক থেকে লাদেন আমেরিকা বিরোধী হয়ে উঠে। তালেবান আর আল কায়েদা মিলে লাদেনের সাম্রাজ্য বাড়তে থাকলে আমেরিকার টনক নড়ে। ২০০১ সালে সর্বপ্রথম লাদেনের ঘাটি তোড়োবোড়ো পাহাড়ে আমেরিকা বড় ধরনের বোমা হামলা চালায়। অল্পের জন্য বেচেঁ যান লাদেন। এ সময় আহত লাদেনের চিকিৎসা করেন আয়মান আল জাওয়াহিরি। মূলত এ সময় থেকে চিকিৎসক আয়মান আল জাওয়াহিরির সাথে লাদেনের ঘনিষ্টতা হয়।

২০০১ সালের হামলার প্রতিশোধ নিতে একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার অনুমোদন দেন লাদেন। লাদেনের নির্দেশে ভয়ানক এ হামলা চালানো হয়। নিহত হয় তিন হাজার মানুষ। এ ঘটনার পর সারা বিশ্বে লাদেন ও আল কায়েদা সন্ত্রাসবাদের প্রতীক হয়ে উঠে। মুসলিম দুনিয়া জুড়ে তার নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ে। আল কায়েদা মুল সংগঠন হিসেবে থেকে বিভিন্ন দেশে বেশ কিছু শাখা সংগঠন দাড়িয়ে যায়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয় না। পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে আল কায়েদার শাখা সংগঠন ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ফলে গোষ্ঠি ও জাতিগত দ্বন্দ্বের কারণে দেশটির অবস্থা নাজুক হয়ে যায়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.