--- বিজ্ঞাপন ---

রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয়… মার্কিন হুমকিকে পাত্তা দেয়নি তুরস্ক

0

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম

।। রাশিয়া থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমস) সংগ্রহ করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তুরস্কের উপর। যেমনটি ধারণা করা হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ১৭ জুলাই তুরস্কের উপর প্রথম নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন। চুক্তি থাকা সত্বেও তুরস্ককে উচ্চ প্রযুক্তির ১০০ এফ-৩৫ লাইটনিং-২ স্টীলথ রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম জঙ্গী বোমারু বিমান দেয়া হবেনা। অথচ আংকারা শুরু থেকেই এ বিমান তৈরী প্রকল্পের অন্যতম শরিক দেশ। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের পার্টনার দেশ হিসেবে ১৪০ কোটি ডলারও দিয়েছে দেশটি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন কতিপয় সিনেটরের দাবীর মুখে হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকান দলীয় সিনেটরদের সাথে বৈঠক করে আরও ভবিষ্যৎ নিষেধাজ্ঞা কি হতে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা রয়েছে জানিয়েছে মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা। ন্যাটো জোটে একমাত্র মুসলিম দেশ এবং অতি মাত্রায় পশ্চিমা ঘেঁষা ও মিত্র দেশ বলে পরিচিত তুরস্ক কি আরো নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়বে?

ন্যাটো জোট থেকে বাদ পড়বে না নিজেই জোট ত্যাগ করে অন্য কোন জোটের সাথে যুক্ত হবে এ প্রশ্ন বিশ্বের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। প্রথম সারির থিংক ট্যাংকগুলোর বিশ্লেষকরা এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। তুরস্কের জনসংখ্যা ৮ কোটি ৩৪ লক্ষ ৩০ হাজার (ওয়াল্ড পপুলেশন রিভিউ,২০১৯) এর ৯৯.৮০ ভাগ অর্থ্যাৎ বলতে গেলে শতভাগই মুসলিম। দীর্ঘদিন যাবৎ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে লেগে থাকা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এ তুরস্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে এর একটা বিশ্লেষনধর্মী চিত্র তুলে ধরা গেল।

তুরস্ক কেন এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকল?

তুরস্ক বহুদিন থেকেই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিল। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের নীপিড়নের মুখে সেদেশ থেকে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু তুরস্কে আশ্রয় নেয়। ২০০৯ সালের দিকে আংকারা যুক্তরাষ্ট্রের নিকট সেসময় ৭.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের প্র্যাট্রিয়ট পিএসি-৩ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটারি ক্রয়ের কথা বলে। তৎকালীন ওবামা
প্রশাসন ন্যাটো জোটের অন্যান্য দেশকে দিলেও তুরস্ককে এ প্যাট্রিয়ট অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আংকারা বহুবার দেনদরবার কররেও আমেরিকা দেশটিকে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধের সময় নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় তুরস্ক ন্যাটোর অপরাপর সদস্য দেশ থেকে ধার করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার উপরই নির্ভরশীল ছিল। এ অবস্থার মুখে তুরস্ক তীক্ত অভিঞ্জতার স্বাদ পায় মেলে সালের দিকে। সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখে ২০১৫ সালে কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ জার্মানি তুরস্কে মোতায়েন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেয়। জার্মানি পরে অজুহাত দেখায় যে, প্যাট্রিয়ট মোতায়েনে তার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যাহার করেছে তারা। জার্মানির ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেয়ার ফলে তুরস্কের আকাশসীমা একপ্রকার অরক্ষিত হয়ে পড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনাই তুরস্কের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্রসংগ্রহ গড়ে তোলার অন্যতম টানিং পয়েন্ট। এসময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসিপ তায়িপ এরদোয়ান দৃঢ়ভাবে সংকল্প করেন যে, তুরস্ক আর পরনির্ভর না থেকে যে কোন উপায়ে নিজস্ব একটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তের দিক থেকে ক্রমাগত হুমকি, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল, গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান নিয়ে ন্যাটোর অপর দুই দেশ গ্রীস ও সাইপ্রাসকে ঘিরে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ যুদ্ধ উত্তেজনা, সীমান্ত জুড়ে কুর্দী বিদ্রোহীদের চোরাগুপ্তা হামলার মুখে তুরস্ক নিরূপায় হয়ে নিজেকে রক্ষা করতে বাধ্য হয়ে রাশিয়ার দ্বারস্থ হয় তুরস্ক।এর কিছু আগে চীনের কাছ থেকে এফটি-২০০০ কিউ-৯ কেনার চেষ্টা চালালে তুরস্ককে ন্যাটো মিত্রদের বিরোধিতার মুখে সে চেষ্টাও বিপলে যায়। মূলত: যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিতে অস্বীকার করার পরপরই দেশটি রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমস ক্রয় করতে আগ্রহী হয়। ২০১৬ সালের শেষের দিকেই তুরস্ক রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত রোস্টেক সাথে এস-৪০০ ‘ট্রায়াম্প’ ( ন্যাটো নাম এসএ-২১ ‘গ্রোলার’ )আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার আগ্রহ দেখালে রাশিয়াও গোপনে রাজি হয়। নানা জল্পনা কল্পনার মুখে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে উভয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ চুক্তির কথা প্রকাশ করে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত রোস্টেক কর্পোরেশন প্যাট্রিয়টের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ২.৫ বিলিয়ন ডলারে ৪ ব্যাটারি ( রাশিয়ায় ডিভিশন) এস-৪০০ তুরস্ককে সরবরাহ করার চুক্তি করে। শুধু তাই নয় রাশিয়া তুরস্ককে এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়ে ৫৫ ভাগ ঋণের ব্যবস্থা রাখে চুক্তিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ মুুহুর্তে তুরস্ককে প্যাট্রিয়ট দিতে রাজী হয় তবে শর্ত দেয় রুশ এস-৪০০ ক্রয় বাতিল করতে হবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একরোখা মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি এ প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, মার্কিন প্রস্তাবে যৌথভাবে উৎপাদনের কোন ব্যবস্থা নেই, ঋণের সুবিধাও নেই। সবমিলিয়ে রুশ প্রস্তাবই দেশটির জন্য উত্তম একতা তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে আলাপকালে জানান। ২০১৯ সালের মে’তে তুরস্ক একদল সামরিক বিশেষজ্ঞকে রাশিয়ায় পাঠায় এস-৪০০ চালানোর ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিতে । এ ব্যবস্থা তুরস্কে চালু হতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ লেগে যাবে বলে ধারণা করা হচেছ। সর্বশেষ রুশ তাস বার্তা সংস্থার খবরে জানা যায়, রাশিয়া এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র তুরস্কে যৌথভাবে তৈরীর প্রস্তাব নিয়ে তুর্কী প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছে। শুধু তা-ই নয় যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ বোমারু বিমান না দিলে বিকল্প রাশিয়ার অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমান এসইউ-৩৫ দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে।


এস-৪০০ নিয়ে এত হৈচৈ কেন?

রাশিয়ায় নির্মিত এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমস হচ্ছে মানুষ ও মানুষ্যবিহীন সকল লক্ষ্যবস্তু যেমন ইউএভি (মানুষ বিহীন বিমান), ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সনাক্ত করে ধ্বংস করতে সক্ষম বিশ্বের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সেরা। ২০০৭ সালে এস-৪০০ তৈরি করে রাশিয়া। একসঙ্গে ৪৮টি শত্রু ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করে মাটিতে নামাতে সক্ষম এই আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এ ছাড়া, যে সব অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানকে রাডারে ধরা যায় না, সেগুলিকেও চিহ্ণিত করতে পারে এই এস-৪০০।
এ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা৪০০ কিলোমিটার এবং ৩০ কিলোমিটার উঁচুতে যে কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। একই সাথে ৭২টি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম পাশাপাশি ১৬০টি লক্ষ্যবস্তুকেও একই সাথে সনাক্ত করতে পারে এ সিস্টেমস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র মাত্র ৩৬ টি টার্গেটে আঘাত হানতে পারে এবং একইসাথে ১২৫ টি লক্ষ্যবস্তুকে সনাক্ত করতে সক্ষম। সম্প্রতি রাশিয়ায় সাফল্যের সাথে পরীক্ষা চালিয়েছে এইএস-৪০০ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত ৪০এন৬ই ক্ষেপণাস্ত্র। যা ৬০০ কিলোমিটার দূরবর্তী লক্ষ্যকে সনাক্ত করে ৪০০ কিলোমিটার পাল্লার মধ্যেই ধ্বংস করতে পারে। অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ১৮০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় করে ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে ধ্বংস করতে পারে। সে তুলনায় রুশ এস-৪০০ আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মার্কিনীদের প্যাট্রিয়টের চাইতে এগিয়ে আছে।১৯৯৯ সালে অস্ত্রখান অঞ্চলের কাপুস্তিন বিমান প্রশিক্ষণ এলাকায় এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা প্রথমবারের মতো প্রদর্শন করা হয়। আর ২০০০-এর দশকে এর সবচেয়ে আধুনিক সংস্করণের মহড়া দেখানো হয়। এটি বাহিনীতে যুক্ত করা হয় ২০০৭ সালের এপ্রিলে।এস-৩০০পিএমইউ২ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কমপ্লেক্সে তৈরি হয় এস-৪০০।এই বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে একটি কমব্যাট কন্ট্রোল পোস্ট, আকাশের টার্গেট চিহ্নিত করার জন্য একটি তিন স্তরের জ্যাম- প্রতিরোধী রাডার, ছয়-আট বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কমপ্লেক্স (১২টি পর্যন্ত ট্রান্সপোর্ট-লাঞ্চার, একটি বহুমুখী ব্যবহার্য রাডার), একটি টেকনিক্যাল সাপোর্ট সিস্টেম, একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরিবহন যান, একটি ট্রেনিং সাইমুলেটর।এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ৬০০ কিলোমিটার দূরের টার্গেট শনাক্ত করতে পারে। এর টেকটিক্যাল ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের পাল্লা পাঁচ কিলোমিটার থেকে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বলা হচ্ছে, বিশ্বের সবচাইতে ব্যয়বহুল রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম মার্কিনীদের অত্যাধুনিক এফ-৩৫ স্টিলথ বিমানও সনাক্ত করতে সক্ষম রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এদিকে, এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আরেক চুক্তিভুক্ত দেশ হচ্ছে ভারত। চুক্তি অনুযায়ী সেদেশে এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পৌঁছুতে বছর চারেক সময় লাগবে। ভারতের বিমান বাহিনী প্রধান বি এস ধানোয়া এস-৪০০-কে ‘গেমচেঞ্জার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা হামলাকারী যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন চিহ্নিত করে তাকে পালটা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম। এর পাল্টা ৪০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ্, ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত আনতে সক্ষম। যার অর্থ হল, পাকিস্তানের প্রায় সবকটি বিমান ঘাঁটি, চিনের বেশ কয়েকটি বিমান ঘাঁটি ভারতের নাগালের মধ্যে চলে আসবে। ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান বি এস ধানোয়া দীর্ঘ ও মধ্যম পাল্লার এই বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে বিমান বাহিনীর শক্তি অনেক বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন। এটি স্টিলথ বিমান ও আকাশে থাকা অন্য যেকোনো লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত হানতে পারবে বলে তিনি বলেন।
ভারতের প্রাক্তন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মনমোহন বাহাদুর বলেছেন, এটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্রব্যবস্থা। এটি ভিন্ন ভিন্ন চার স্তরের বিমান প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে।

রাশিয়ার এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় সংক্রান্ত বিরোধের জেরে তুরস্ককে এফ-৩৫ ফাইটার জেট সরবরাহ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বিবাদের জেরে তুরস্কের কাছে এফ-৩৫ লাইটনিং স্টিলথ জেট ফাইটার সাথে সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি এবং সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। মূলত তুরস্কের দুই রেজিমেন্ট রাশিয়ান এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বিতর্ক এবং বিবাদের জেরে মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্কের কাছে তাঁদের উচ্চ প্রযুক্তির এফ-৩৫ লাইটনিং স্টিলথ জেট ফাইটার সরববরাহ বন্ধের এটিই কঠিন পদক্ষেপ। যদিও জঙ্গী বিমানটির নির্মাতা মার্কিন জায়ান্ট লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন ২০১৮ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের হাতে প্রথম ১টি ইউনিট এফ-৩৫ জেট ফাইটার তুলে দেয়। এরপর আরও ৪ টি এফ-৩৫ তুরস্কের নামে তৈরী করা হয়। তাছাড়া জুলাই ২০১৮ থেকেই এ্যারিজোনায় মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে তুরস্কের বেশ কিছু পাইলট রুটিন মাফিক এফ-৩৫ পরিচালনার প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছিল।

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সুবিশাল এফ-৩৫ প্রজেক্টের তুরস্ক অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইতিপূর্বে তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালের শেষের দিকে এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটার তুরস্ককে সরবরাহ করতে বাধা প্রধান বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি বিলে স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু তা সত্বেও এফ-৩৫ যৌথ প্রোগ্রাম অফিস বলেছিল যে, এটি বিদ্যমান পরিকল্পনা এবং চুক্তি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তুরস্কে এফ-৩৫ সরবরাহ কার্যকর করা হবে। তবে মার্কিন কংগেসের চার সিনেটর আঙ্কারার এরদোয়ান প্রশাসন রাশিয়ান এস-৪০০ সিস্টেম ক্রয় চুক্তি বাতিল করতে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত তুরস্কের হাতে এফ-৩৫ তুলে দেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আরেকটি দ্বি-দলীয় বিল কংগ্রেসে উপস্থাপন করে যা পাস করিয়ে নেয়।
তুরস্ক পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ লাইটনিং স্টিলথ ফাইটার জেট এর অংশীদার দেশ হওয়া সত্বেও শেষ পর্যন্ত মাত্র চারটি ইউনিট তুরস্কের নামে তৈরী হলেও সেগুলি মার্কিনীদের কাছে রয়েছে ১৭ জুলাই’র নিষেধাজ্ঞার ফলে আটকা পড়েছে। এবং নতুন করে আর কোন বিমান দেশটির জন্য তৈরীর পথও বন্ধ হয়েছে। এর আগে পেন্টাগন জানিয়েছিল, যদি আঙ্কারা রাশিয়ান এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় বাতিল করার প্রতিশ্রুতি না দেয়, তাহলে তুরস্ককে এফ-৩৫ প্রজেক্ট থেকে সরিয়ে দেয়া হবে এবং এবং এফ-৩৫ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে। পেন্টাগণ বলছে, রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা চালু হলে সে দেশের উচ্চ প্রযুক্তির এফ-৩৫ বিমানের গোপণ ডাটা রাশিয়া সংগ্রহ করে নেয়ার সুযোগ পাবে।  ন্যাটো জোটের অন্যতম সামরিক অংশীদার এবং মিত্র হওয়ার সুবাদে তুরস্ক পর্যায়ক্রমে আগামী ১০ বছরে মোট ১০০টি এফ-৩৫এ স্টিলথ জেট ফাইটার ক্রয়ের পরিকল্পনা করেছিল। তাছাড়া এই প্রজেক্টের অন্যতম প্রযুক্তিগত সহায়তাকারী অংশীদার হওয়ায় এফ-৩৫ এর ফিউজলেস, ল্যান্ডিং গিয়ার এবং উচ্চ প্রযুক্তির ককপিট ডিসপ্লের বেশ কিছু গুরত্বপূর্ণ অংশ তৈরী করছে তুরস্কের একাধিক এভিয়েশন ইন্ড্রাস্টিজ হাবগুলো। মাল্টিন্যাশন এফ-৩৫ প্রজেক্টে তুরস্ক ১.২৫ বিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যেই বিনিয়োগ সম্পন্ন করেছে। তবে এ প্রজেক্ট তুরস্কের অবিচ্ছেদ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও, মার্কিন কর্মকর্তারা সম্প্রতি রয়টার্স সংবাদ সংস্থাকে জানায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাল্টিন্যাশন ট্রিলিয়ন ডলারের এফ-৩৫ প্রজেক্টটি তুরস্কের যন্ত্রাংশ সরবরাহ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়াও কার্যকরভাবে অগ্রসর হতে পারে। যদিও এক্ষেত্রে প্রকল্পটির ব্যয় আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা করা হয়েছে।

তুর্কী নিরাপত্তা বিশ্লেষক : মুসলিম দেশ হওয়ায় এ বিমাতাসুলভ আচরণ

আংকারার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা তুরস্কের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অধিকাংশ দেশের আচরণকে দেশটি মুসলিম দেশ হওয়াতেই এটা করা হচ্ছে বলে বলছেন। গত ১৬ জুলাই তুর্কী দৈনিকে আবদুল্লাহ মুরাদোগ্লু মন্তব্য করে বলেন, ট্রাম্প যাতে মিত্র দেশ হিসেবে বিশেষ ক্ষমতাবলে (সিএএটিএসএ-কাটসা) আইনে মুসলিম দেশ তুরস্ককে ছাড় না দেন এজন্য মার্কিন প্রশাসনে ইহুদি-খ্রিষ্টান-এভেনজেলিক্যাল লবি বেশ তৎপর রয়েছে। মার্কিন প্রশাসনে ইহুদি লবি চাননা মুসলিম দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেন শক্তিশালী না হয়। প্রশাসনে ২ নং ব্যক্তি মাইক পেন্স হচ্ছে নিজে একজন এভেনজেলিক্যাল মতাবলম্বী । মার্কিন প্রশাসনে ইহুদি-খ্রীষ্টান জোটের প্রতিনিধি বলে পরিচিত পেন্স তুরস্কের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পক্ষে। ন্যাটো জোটের আরো ৩ টি দেশে আগে থেকেই রাশিয়ার আগের সংস্করণ এস-৩০০( ন্যাটো নাম এসএ-১০ ‘গ্রাম্বল’) আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। দেশগুলো হল, গ্রীস, বুলগেরিয়া ও স্লোভাকিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিংবা অপর কোন পশ্চিমা দেশ ঐ সকল দেশে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আপত্তি তোলেনি। গ্রীস ১৯৯৮ সালে সাইপ্রাস থেকে পাওয়া এস-৩০০ ক্রীট দ্বীপে তার আকাশ প্রতিরক্ষা মজবুত করেছে। কেবল তুরস্কের বেলায় বলা হচ্ছে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত উচ্চ প্রযুক্তির এফ-৩৫ বোমারু বিমানের ডাটা হ্যাক হবে। রুশরা মার্কিন প্রযুক্তি নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করবে। অথচ অন্য ন্যাটো সদস্য গ্রীস, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশের বেলায় কোন উচ্চবাচ্য হয়নি। তুরস্কের বিশ্লেষকরা এটাকে বিমাতাসুলভ আচরণ বলছেন। এদিকে ১২ জুলাই রাশিয়া থেকে বিমানে করে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমস এর প্রথম চালান আসার পর যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটের তুর্কি বিরোধী জোট দেশটির উপর আরো নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে চাপ দিচ্ছে।


২০১৬ সালে এরদোয়ানকে গুলেনের অনুসারীদের দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাতের চেষ্টা চালানো হয়। সে অভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র বলে পরিচিত পশ্চিমা দেশগুলোর মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তুরস্কে রক্তক্ষয়ী ওই অভ্যুত্থানের অন্যতম হোতা ফতেহুল্লাহ গুলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়ে সেদেশে রয়েছে। আংকারার তরফ থেকে তাকে ফেরত দিতে বার বার দাবী জানালেও যুক্তরাষ্ট্র নীরব রয়েছে। বরং তুরস্কে বহু মানুষকে হত্যায় জড়িত সন্ত্রাসী দল সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দীদের অস্ত্র সজ্জিত করে যাচ্ছে। এরদোয়ান বিরোধী অভ্যুত্থানে মদদ দাতা ন্যাটো জোটের অন্যান্য দেশ জার্মানী, গ্রীস এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার সাথে জড়িতদের সেসব দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে তুরস্কের প্রতি বৈরী আচরণ অব্যাহত রেখে চলেছে।

মুসলিম ঘেঁষা ভূমিকা রাখায়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলায় সোচ্চার হওয়ায় তুরস্কের বৈদেশিক নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। প্যালেইস্টাইনীদের উপর ইসরাইলের ক্রমাগত নির্যাতনে যখন আরব দেশগুলো নীরব তখন তুরস্ক গাজায় ইসরাইলের বর্বর হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। জেরুজালেমকে ইসরাইলের ভবিষ্যৎ রাজধানীর সমর্থন দেয়া এবং সেখানে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার প্রতিবাদও জানায় তুরস্ক অন্যদের চাইতে জোরালোভাবে। গাজায় ২০০৭ থেকে অবরুদ্ধ মানবিক সাহায্য নিয়ে ত্রাণবাহী ‘মাভি মারমারা’ নামের জাহাজের নেতৃত্বে কয়েকটি ত্রাণ জাহাজের একটি বহর পাঠায় তুরস্ক । ২০১০ সালের ৩১ মে ঐ জাহাজে ইসরাইলের কমান্ডো হামলায় ১৬ জন তুর্কী ত্রাণকর্মী নিহত হন। রোহিঙ্গা মুসলিম ইস্যুতে বাংলাদেশকে জোর সমর্থন জানায় তুরস্ক সরকার। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট ফোনে বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার সমর্থনের কথা জানান। এবং তিনি ঐ বছরের ৭ সেপ্টেম্বর তুর্কী ফাস্ট লেডি এমিন এরদোয়ানকে বাংলাদেশে বিশেষ দূত হিসেবে মায়ানমার সরকার কর্তৃক বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে পাঠান। পরে তুরস্ক রোহিঙ্গা বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপনে প্রধান ভুমিকা রাখে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শিকার লক্ষ লক্ষ মুসলিম নারী শিশু যখন ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের রাস্তায় রাস্তায় আশ্রয়ের আশায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছিল তখন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ৩০ লক্ষ সিরিয়ার শরণার্থীকে আশ্রয় দেন। সেদেশে তাদের নাগরিকত্বও দেয়ার উদ্যোগ নেন। চীনে উইগর মুসলমানদের উপর নির্যাতনে প্রতিবাদমুখর হয় তুরস্ক। তুরস্কে এতদিন প্রকাশ্যে নারীরা হিজাব পুরুষরা দাঁড়ি রাখতে পারতনা তথাকথিত সেক্যুলার নীতির কারণে। এরদোয়ান সেসকল বাধা উঠিয়ে নেন এবং দেশে বড় বড় মসজিদ নির্মান ও সংস্কার করেন। তুর্কী ফাস্ট লেডি এরদোয়ান নিজেই হিজাব পরেন। রমজানে রোযা রাখা ধর্মকর্ম পালন ইত্যাদি আগের যেকোন সময়ের চাইতে তুর্কী মুসলমানদের বেশী মাত্রায় দেখা যায়। ২০০৩ সালে এরদোয়ান প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর দু’দশক ধরেই তুরস্কে ব্যাপকভাবে পশ্চিমা চালচলন বদলে ইসলামিক কায়দাকানুন মেনে চলায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত মার্চের প্রথম দিকে ইস্তাম্বুলে উসমানি মুসলিম শাসনামলের বিখ্যাত ক্যামলিকা মসজিদটি আরও বর্ধিত করে উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। প্রায় ২ কোটি ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার ব্যয়ে মসজিদটিকে পুন:নির্মাণ করার নির্দেশ দেন তিনি। ২০১৩ সালে শুরু হয়ে এর পুন:নির্মাণ কাজ। বর্তমানে এ মসজিদে ৬৩ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের পশ্চিমা ধাঁচ থেকে সরে তিনি তুরস্কের অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরায় উদ্যোগী হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দল এ.কে. (জাস্টিস এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি) এবং তাঁর ইসলাম ঘেঁষা নীতিতে পশ্চিমা দেশগুলো বরাবরই অখুশী।
এ ব্যাপারে কুয়ালালামপুরে মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমর-বিদ্যা বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে বলেন, বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি এবং পারবে বলেও তারা এখন আর বিশ্বাস করেনা । অথচ একই সময়ে তুরস্ক দেখছে যে তাদের পাশ কাটিয়েছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে এক এক করে ইইউ জোটে নেয়া হয়েছে। ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, “কেন তাদের নেওয়া হয়নি তার কারণ স্পষ্ট করে বলা না হলেও তুরস্ক বিশ্বাস করে মুসলিম প্রধান দেশ বলেই তাদেরকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।”

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.