--- বিজ্ঞাপন ---

বিশ্বব্যাপি যুদ্ধের নামে চলছে ভয়ানক অস্ত্র বাণিজ্য

0

দুনিয়াজুড়ে চলছে নানা অস্থিরতা। যুদ্ধে জড়িয়ে বা জড়িয়ে পড়ার আশংকায় কিছু দেশ অস্ত্র আমদানির পরিমাণ বাড়িয়েছে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের কারণে সৌদি আরব অস্ত্র কিনছে। পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সমুদ্রে চীনের রণসজ্জা অস্ত্র ব্যবসা বাড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ভূউত্তেজনা বৃদ্ধির পাশাপাশি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হওয়ায় অস্ত্র রপ্তানি বাড়ছে বলে ধরে নেয়া হয়। আর এতে স্বভাবতই সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী হিসেবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

স্নায়ু যুদ্ধ অবসানের পর থেকে যেকোন পাঁচ বছর মেয়াদের তুলনায় ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশী অস্ত্র ব্যবসা হয়েছে। এই সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর প্রতি বেশী জোর দেয় এবং এক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপমুখী হয়। স্টকহম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানায়, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র রফতানির প্রায় ৪৩ শতাংশ এশিয়া ও ওশেনিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে করা হয়। আগের ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল মেয়াদের তুলনায় এটি ৭.৭ শতাংশ বেশি ছিল।
২০১৫ সালে সারাবিশ্বে মোট ৮০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি হয়েছে, আগের বছর যার পরিমাণ ছিল ৮৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রই ৪০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি। সরবরাহকারীদের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ফ্রান্স বিক্রি করেছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র; যা ২০১৪ সালের তুলনায় ৯ বিলিয়ন ডলার বেশি।
উন্নয়নশীল দেশগুলোই ছিল অস্ত্রের মূল ক্রেতা। এর মধ্যে কাতার সবচেয়ে বেশি, ১৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে ২০১৫ সালে। মিশর ১২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে চুক্তি করেছে। পিছিয়ে নেই সৌদি আরবও, গত বছর তারা এ খাতে ব্যয় করেছে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অস্ত্র কেনার তালিকায় এরপরের দেশগুলোর নাম দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরাক।
অন্যদিকে বিক্রির তালিকায়, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সের পর আছে রাশিয়া ও চীনের নাম। পরের স্থানগুলোতে আছে সুইডেন, ইতালি, জার্মানি, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েল। রাশিয়া গত বছর ১১ দশমিক এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে; এর বেশিরভাগ কিনেছে ভেনিজুয়েলা। ২০১৪ সালে অস্ত্র বিক্রি খাতে রাশিয়ার আয় ছিল ১১ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। চীন গতবছর বিক্রি করেছে ছয় বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, যা তাদের ২০১৪ সালের আয়ের দ্বিগুণ।
নেটো জোটের বন্ধু দেশগুলো অস্ত্র উৎপাদনে তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে; এর মধ্যে জার্মানি উন্নততর নৌ সরঞ্জাম আর যুক্তরাজ্য আধুনিক যুদ্ধবিমানের উৎপাদন বাড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাজারজাত করছে। অবশ্য বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব বজায় থাকায় অস্ত্র কেনাবেচায় একটি বড় অংশ বাকিতে চলছে। অভ্যন্তরীণ বাজেট ঘাটতিতে উদ্বিগ্ন অনেক দেশই নতুন অস্ত্র কেনার ইচ্ছা বাদ দিয়েছে বা কমিয়ে এনেছে। কিছু কিছু রাষ্ট্র কেবল বিদ্যমান অস্ত্রের আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষণ ও পরিসেবা সহায়তার মধ্যেই তাদের সামরিক বাজেট সীমাবদ্ধ রেখেছে। তবে এশিয়ায় বেড়েছে অস্ত্রের আমদানি।
ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরও অস্ত্রের বাজারে বড় অঙ্কের প্রবৃদ্ধি আসবে। অস্ত্রের বাজারে সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক হিসেবে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। বড় ক্রেতা হিসেবে এগিয়ে রয়েছে সৌদি আরব, ভারত, চীন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। সম্প্রতি শিয়া ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যে হামলা চলছে, তাতে এ জোটকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো। সংস্থা জানায়, বিশ্বের ৯৬ দেশে যায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র। এ দেশগুলোর কাছে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রি করে এবং কখনো কখনো সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়।

এদিকে সামরিক অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে ভারতকে পিছনে ফেলে শীর্ষে উঠে এসেছে সৌদি আরব। ইয়েমেন এবং সিরিয়াতে যে যুদ্ধ চলছে, মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশই সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইরানের সঙ্গেও এই দেশগুলির সম্পর্ক বেশ উত্তপ্ত। তাই অস্ত্রের চাহিদা সেখানে বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে নিজেদের অস্ত্র আমদানির পরিমাণ ২১২ শতাংশ বাড়িয়েছে সৌদি আরব।
স্টকহোমের আন্তর্জাতিক শান্তিবিষয়ক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধাস্ত্র কিনেছে সৌদি আরব। তার পরেই রয়েছে ভারতের স্থান। যদিও তার আগের বছর অস্ত্র আমদানিতে ভারতই শীর্ষে ছিল। দ্বিতীয় স্থানে ছিল সৌদি আরব। ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, শুধু ভারত বা সৌদি আরব বলে নয়, আরও কিছু দেশ অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে অস্ত্র কিনতে মোট ৩ হাজার ১৬১ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে সৌদি আরব। সেখানে ভারত কিনেছে ৩ হাজার ৭৮ মিলিয়নের অস্ত্র। যদিও তার আগের বছর ৩ হাজার ৪৮৭ মিলিয়ন ডলার খরচ করে অস্ত্র আমদানিকারী দেশের তালিকায় ভারত শীর্ষে উঠে এসেছিল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় সেনার আধুনিকীকরণে ২৫ হাজার কোটি ডলার খরচের পরিকল্পনা নিয়েছেন। চীন এবং পাকিস্তানের মতো দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই ভারতকে অস্ত্র আমদানিতে জোর দিতে হচ্ছে। গোটা এশিয়ায় চীন আধিপত্য বিস্তার করার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা ভারতকে বাধ্য করছে নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা দ্রুত বাড়ানোর পথে হাঁটতে।
এদিকে সমরাস্ত্র আমদানিতে ভারতের চিরবৈরী পাকিস্তানও একধাপ পিছিয়ে দশে রয়েছে। ২০১৫ সালে অস্ত্র ক্রয়ে মোট ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে পাকিস্তান। ভারতের আর এক প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনও কিন্তু অস্ত্র আমদানি অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করা দেশগুলোর তালিকার চতুর্থ স্থানে ছিল চীন। ১ হাজার ২১৪ মিলিয়ন ব্যয় করে সপ্তম স্থানে তারা নেমে গেছে।
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর দু’দেশ এখন যুদ্ধংদেহী অবস্থায়। অন্যদিকে, বরাবরের মতো পাকিস্তানের পাশে রয়েছে চীন। আবার কিছু দেশ আছে যারা ভারত-পাকিস্তান দু’দেশকেই অস্ত্র সরবরাহ করে। এসব দেশ হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, ইউক্রেন ও ব্রাজিল। অথচ পাকিস্তান এবং ভারত হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশী দেশ। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারত আমেরিকার সমর্থন পেয়ে থাকে। অন্যদিকে, কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তানকে সঙ্গী হিসেবে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের অন্যতম দুই প্রধান অস্ত্র রফতানিকারক দেশ ফ্রান্স ও রাশিয়া ভারত-পাকিস্তানে অস্ত্র রফতানির দিকটাই প্রধানত বিবেচনায় নেয়। তবে অন্য প্রধান অস্ত্র রফতানিকারী দেশগুলো দু’দেশকেই অস্ত্র দিতে আগ্রহী নয়।
দ্য স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তুরস্ক, সার্বিয়া, চীন ও জর্ডান শুধু পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়। এসব দেশ ভারতকে অস্ত্র দিতে রাজি নয়। অন্যদিকে, ইসরাইল, কানাডা, স্পেন, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, পোল্যান্ড, কিরগিজিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া শুধু ভারতকে অস্ত্র দেয়; পাকিস্তানকে দেয় না।
এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ১৪ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। আনুমানিক সাত কোটি ডলারের এআইএম-৯এক্স সাইডউইন্ডার ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাত কোটি ডলারের এজিএম-৬৫জি-২ মারভিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের অনুরোধে এসব ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয় বলে জানিয়েছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে এ অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই নেবে না উত্তর কোরিয়া। শক্তি বাড়াতে উত্তর কোরিয়ার পাল্টা উদ্যোগ কি হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.