--- বিজ্ঞাপন ---

…এই রেনেসা হিরোরাই হয়ত একদিন গড়বে নতুন বাংলাদেশ

0

রেফায়াত কবির শাওন ##

হিটলার নাকি সময় নষ্ট হয় দেখে জার্মানীতে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করেছিলেন। জানিনা মনের অজান্তে আমি কোন হিটলারি জমানায় প্রবেশ করে ফেলেছি কি না। এই বিশ্বকাপে একটা খেলাও পুরো দেখার সুযোগ হয় নি। ক্রিকেট নিয়ে একটা জ্বর ভাব আমাদের বাড়িতে ছোট বেলা থেকেই ছিল। আমার বাবা পাঁচদিনের টেস্ট ম্যাচ অসম্ভব আগ্রহ নিয়ে রেডিওতে শুনতেন। অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশে বসে রেডিওতে শোনার মধ্যে কি আনন্দ পেতেন আল্লাহ মালুম। সে যুগে বিটিভি যেসব ম্যাচ দয়া করে দেখাত তাই শুধু দেখতে পারতাম। আমার এখনো মনে আছে আটাশি, বিরানব্বইর বিশ্বকাপের প্রতিটি খেলা শুরুর আগে বিটিভির সুন্দরী উপস্থাপিকা শামিমা আখতার বেবি তাঁর মাদকতাপূর্ণ কন্ঠে বলতেন, “স্টার টিভির প্রাইম স্পোর্টস চ্যানেল থেকে, এশিয়া সেট এক উপগ্রহের সাহায্যে, তালিবাবাদ উপগ্রহ ভু কেন্দ্রের মাধ্যমে এখন আমরা আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি …………….…” । ঘোষনার পরই সুন্দরী উপস্থাপিকাকে ছেড়ে পর্দায় আসত মাঠ।

একান্নবর্তীর পরিবারে বাবা চাচা ভাইবোনদের বিশাল দল আমাদের ড্রইংরুমে জড়ো হয়ে একসাথে খেলা দেখা হত। ভাল খেলা থাকলে স্কুল কলেজে যেত না কেউ। চাকুরিজীবিরা ছুটি নিতেন কখনো কখনো। তবে সবচেয়ে বড় অত্যাচারটা হত আমার মায়ের উপর। সাত – আট ঘন্টার খেলা। একটু পরপরই সবার জন্য তাঁকে চা নাস্তা দিতে হত। আর প্রিয়দল জিতলেতো কথাই নেই। বাবার সিদ্ধান্ত হত, ভালমন্দ রান্না হবে। সবাই খাবে। সে যদি খেলার ফলাফল মাঝরাত গড়িয়ে ভোর রাতেও আসে।

সরকার বাহাদুর স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচারের অনুমতি দিলে আমাদের খেলা দেখার সুযোগ বাড়ে। প্রথমদিকে বাড়িতে ডিশ এন্টেনা কিনে বিদেশি চ্যানেল দেখতে হত। ব্যাপারটা ব্যয়বহুল ছিল। মামাত ভাই, জহিরুল আলম দোভাষ, বর্তমানে সিডিএ’র চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করছেন, কিনে ফেললেন ডিস এন্টেনা। আমাদের আর পায় কে। ভাল খেলা যদি বিটিভি না দেখায়, চল মামার বাড়ি। দিনরাত খেলা দেখা আর খাওয়া দাওয়া।

ক্যাবলটিভি ঘরে ঘরে পৌছানোয় সহজ হল খেলা দেখা। কমেন্ট্রি, বিশ্লেষণ তখনও ইংরেজ আর অস্ট্রেলিয়দের দখলে। চ্যানেল নাইনের ধবধবে সাদা চুলওয়ালা রিচি বেনোর কমেন্ট্রি শুনতে যেমন ভাল লাগত, তেমনি ভাল লাগত তাঁর সদাহাস্যময় চেহারা দেখতে। টনি গ্রেগের ছন্দময় ধারাবর্ণনার সাথে জেফ্রি বয়কটের আক্রমনাত্মক মন্তব্য। গ্রেগের মৃত্যু আর বয়কটের ক্যান্সার ক্রিকেট ধারা বর্ণনা যে ক্ষতি হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। এই দলে আস্তে আস্তে যোগ দিলেন উপমহাদেশের সূনীল গাভাস্কার, রবি শাস্ত্রি, রমিজ রাজা, ওয়াসিম আক্রাম আর আমাদের আতাহার আলি খান। কমেন্ট্রি বক্সে বসে ভাষায় জোর জবরর্দস্তি প্রবাদ প্রবচন ব্যবহার করায় নভোজত সিং সিধুর কমেন্ট্রি এন্টারটেইনিং হলেও ক্রিকেট বিশ্লেষনে তিনি খাপ খাওয়াতে পারেন নি। তাই বোধহয় তিনি এখন কমেডিয়ান হয়েছেন। হারসা ভোগলে ক্রিকেটার হিসেবে বিখ্যাত না হলেও, কমেন্ট্রি জমান বেশ। তাঁর সুবাদে মাঠের খেলার পাশাপাশি, ভেনুর আশপাশটাও দেখেছি । তবে এ কালের ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেন ভিন্ন মাত্রা এনেছেন।

শুধু টিভিতে নয় সেযুগে আমাদের চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে হত নিয়মিত ক্রিকেটের আয়োজন। উৎসব সাদামাটা হলেও উৎসাহ ছিল ব্যাপক। ক্রিকেট ক্রিকেটাররা তখনো অর্থের উপর ভাসছেন না। অধিকাংশ ক্রিকেট তারকা পেট চালাতে অন্য পেশায়ও কাজ করতেন। এখনও মনে আছে অরুন লালের চিকিৎসায় সহযোগিতার জন্য শারজায় ক্রিকেট আয়োজন। আজকালতো ক্রিকেটে মাঠের তারকার সাথে রঙ মঞ্চের তারকারাও যোগ দিয়েছেন। আইপিএল বিপিএলের সুবাদে অর্থে ভাসছে ক্রিকেট, তবে রঙ তামাশায় এর নান্দনিকতাটা অটুট আছে কি না প্রশ্ন।

নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যান মার্ক গ্রেটব্যাচের হাত ধরে একদিনের ক্রিকেটে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন চলাকালে আক্রমনাত্মক ব্যটিং এর সুচনা। তাঁর রচিত এই পদ্ধতি কাজে লাগান পাকিস্তানের সাইদ আনোয়ার – আমির সোহেল, শ্রীলংকার জয়সুরিয়া কালুভিথারনা যা ৯২, ৯৬ বিশ্বকাপ জিততে তাদের দেশকে সাহয্য করে।

সমস্যায় পরলাম গ্রেটবেচের নিউজিল্যান্ডকে নাকি ক্রিকেটের আদিভুমি ইংল্যান্ডকে সাপোর্ট করব। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায়, ইংল্যান্ডের দিকেই টানছে মনটা। তাছাড়া ক্রিকেটের পাদপিঠ লর্ডস, ওভালে কিঞ্চিত আতিথেয়তা পেয়েছি এখনও এক বছর হয়নি।

ইংল্যান্ডকে সাপোর্ট করতে অনেকের আপত্তি, চায়ের কাপে ঝড় তুলে বলবে দুশো বছরের উপনিবেশিক শাষনের কথা। আরে বাবা, যে চায়ের কাপটা তোমার হাতে সে চা’ও এই দেশে এনেছিল বৃটিশ উপনিবেশ, সঙ্গে ক্রিকেট। তবে বৃটিশ ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ যে মাঝে মাঝে মোড়লগিরি করে তাতে আমিও কষ্ট পাই। তাছাড়া বর্নবাদের কারণে যখন দক্ষিন আফ্রিকা বিশ্ব ক্রিকেটে নির্বাসিত, তখন বৃটেন তাদের সাথে খেলে একপ্রকার জাতিবিদ্বেষে উৎসাহই দেয়। এই যখন মনের অবস্থা তখন ফেসবুকের একটি পোস্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। এবারের এই ইংলিশ দলে ক্যাপটেন থেকে শুরু করে সেরা এগারোর পাঁচজনই ইমিগ্রান্ট। ইংরেজি ভাষা যেমন পৃথিবীর সব ভাষা সাহিত্যের মাল মশলাকে নিজের করে নিয়ে সমৃদ্ধ, ইংল্যান্ডের এই ক্রিকেট দলও সেই উদারতায় সমৃদ্ধ, বর্ণবাদের বিভেদ ভুলে এক। আর এই নব প্রজন্মের বিশ্ব নাগরিকদের হাত ধরেই ক্রিকেট বিশ্বকাপের ঘরে ফিরে আসা। আশা করি, অতি লোভি ব্যবসায়ী আর জুয়াড়িদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে ক্রিকেটের নব যাত্রা এই ইংল্যান্ড থেকেই শুরু হবে আবার।

একসময় ব্রাজিল আর্জেন্টিনার ফুটবলের মত, ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা থাকলেও বিভক্ত হয়ে পরত পুরো দেশ। এখন আর তেমন হয়না, আমরাই যে খেলি। একটা নতুন প্রজন্ম এসেছে দেশে, এরা খেলায়, রাজনীতিতে দুই পক্ষের অচ্ছেদ্য চক্র ভাঙতে চায়। এরা নিজেদের সক্ষমতাকে বড় করে দেখতে চায়। এই রেনেসা হিরোরাই হয়ত একদিন গড়বে নতুন বাংলাদেশ। হোকনা ক্রিকেটকে ঘিরেই সেই পথ চলার শুরু।###

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.