--- বিজ্ঞাপন ---

বিলাতে কয়েকদিন ….(১)– উড়াল পর্ব

0

রেফায়াত কবির শাওন##

বাংলাদেশ বিমানের বিমানবালারা অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মত বয়েসে তরুনী নন, সাজপোষাকে শালীন, চেহারায় চলনে মাতৃত্বের ছাপ স্পষ্ট। সানশাইন গ্রামার স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র – ছাত্রীদের নিয়ে বিমানে উঠার পরপরই সেবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। বিমানের পেছনের কেবিনের অনেকগুলো সিট খালিই ছিল। আমাদের বিশজনের দল প্রত্যেকে তিনটি করে সিট দখল করে আয়েশে যাত্রা করলাম লন্ডনের উদ্দেশ্যে। মাইকে ঘোষণা দিল আমাদের দূ’বার খাবার দেয়া হবে, বাস্তবে পেলাম অনেকবার। দেশের কিছু বাচ্চা শিক্ষাসফরে লন্ডন যাচ্ছে দেখে কেবিন ক্ররা বেজায় খুশি। কিছুক্ষণ পরপরই এসে জিজ্ঞেস করছেন কিছু লাগবে কিনা। আগবাড়িয়ে বলছেন “স্যার, দূপুরেতো আপনি আমাদের চিকেন দেয়া মিলটা খেয়েছেন, এবার মাটনটা একবার চেখে দেখুন।” একজন বিমানবালা এসে জানতে চাইলেন আমাদের সফরের বিস্তারিত, বলে গেলেন ছোট বাচ্চারা অপরিচিতদের কাছে তাদের প্রয়োজন না ও বলতে পারে। আমরা যেন বাচ্চাদের কোন সমস্যা তাঁদের জানাতে দ্বিধা না করি।

বিমানের সার্ভিস নিয়ে মানুষের কম্প্লেন এর শেষ নেই। ঢাকা বিমানবন্দরে তার কিছুটা রেশ পেয়েছিলাম রেনডম চেক এর নামে যাত্রীদের লাগেজ খুলে অযথা সময় নষ্ট করা দেখে। স্কেনারে সন্দেহজনক কিছু দেখা না গেলেও নাকি যাত্রীদের ব্যাগ খুলে চেক করা নিয়ম, ক্ষমা চাওয়ার স্বরে ব্যাখ্যা করলেন বোর্ডিং কার্ড দেয়ার দায়ি্ত্বে নিয়োজিত অতি স্বজ্জন বিমান কর্মকর্তা। তাহলে কোটি টাকার স্ক্যানার বসানোর দরকারটা কি। ফেরার পথে হিথরোতে দেখেছি, কারো লাগেজে সন্দেহজনক কিছু স্ক্যানারে দেখা গেলে তা ব্যাখ্যা করে তবে খোলা হয় লাগেজ। যাইহোক, এ দূঃখ কেটে গেলো বিমানে উঠে, কর্মিদের আন্তরিকতায়, সেবায়। এক ঘন্টা দেরিতে উড়াল দিলেও, প্রায় দেড়যুগ পুরোন সুপরিশর বোয়িং 777 – 300 বিমানের পাইলটদের সূদক্ষ পরিচালনায় যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছে।

যারা নিয়মিত প্লেনে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ান তাঁদের কাছে এগারো ঘন্টার বিমানভ্রমন বিরক্তকর, রীতিমত সময় নষ্ট। আমার কাছে প্রতিটি মূহুর্ত উত্তেজনার, আনন্দের। সময় না কাটলে আপনি কিছু পড়তে পারেন, গান শুনতে পারেন, মুভি দেখতে পারেন তবে লন্ডন যাত্রার প্রায় পুরোটা সময় আমি তাকিয়ে ছিলাম, প্লেনের ইন ফ্লাইট ডিসপ্লের দিকে। ঢাকা থেকে লন্ডনের বিমান যাত্রার প্রায় পুরোটাই স্থলভাগের উপর দিয়ে। আমাদের রংপুর রাজশাহী পেরিয়ে, কাঠমান্ডু, পোখারাকে পাশকাটিয়ে বিমান ওড়ে আগ্রা – দীল্লির পথে। লাহোর ছেড়ে মুলতান কোয়েটা হয়ে আফগানিস্তান। মাজার ই শরিফ হয়ে মুজতবা আলির কাবুল – কান্দাহার। বিমানে বসে মাটন বিরিয়ানী খেতে খেতে মনে পড়ল সৈয়দ মুজতবা আলির আফগান ভৃত্য আগা আবদুর রহমানের কথা। পোলাও কোরমা দই রেজালার শতপদের রান্নার পরও তার মনে হয়েছিল খাবারের আইটেম কম। ছলছল চোখে নিজের জন্মভূমির প্রসংশা করেছিলেন, পানশিরের আবহাওয়া এমন যে একটা আস্ত দুম্বার রোস্ট খাওয়ার পর এক গ্লাস পানি খেলে আবার ক্ষিদা লাগবে।

বাদশাহ আমানুল্লাহর পতন হয়েছিল তো সেই কোন আমলে। ডাকু সর্দার বাচ্চএ সাকাওর হামলায় বিচ্ছেদ হয় শবনম বানু আর বাঙালী অধ্যাপকের। তারপর এই জনপদে যত যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীর আর কোথাও এতটা হয়েছে কিনা সন্দেহ। ইংরেজ পুরো উপমহাদেশ দখল করলেও বার বার ব্যার্থ হয় এখানে। রাশিয়ার সাথে এরা যুদ্ধ করেছে দীর্ঘ চল্লিশ বছর। শেষমেশ পরাশক্তিকে পরাজিত হয়ে পিছু হঠতে হয়। অদ্ভূত ব্যাপার, আমাদের প্লেন আফগানিস্তান থেকে আগাচ্ছে রাশিয়ার দিকে, গন্তব্য ইংল্যান্ড – দূদেশই আফগানদের হাতে মার খাওয়া।

মুজতবা আালির লেখা পড়ে রুক্ষ আফগানিস্তানকে ভালবাসেনি এমন মানুষ কম। এখানকার স্বাধীনচেতা বোকা মানুষগুলোর যুদ্ধ করেই জীবন সারা, রাজনীতির মারপ্যাঁচ কখনো শিখল না। আমার দৃষ্টিতে বাংলায় লেখা শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাস ‘শবনম” এর পৃষ্ঠাগুলো স্মৃতি থেকে তাড়াতে পারছিলাম না। ফরাসি দেশে বড় হওয়া, ফারসি ভাষায় পারদর্শি সর্দার আওরঙজেবের কন্যা শবনম বানুর সাথে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি আর জার্মান শেখাতে যাওয়া বাঙাল অধ্যাপকের কাব্যিক সংলাপের স্মরনে মন যখন বিভোর, বিমান তখন আফগানিস্তান পেরিয়ে তাশখন্দ, সমরখন্দ, বোখারার পথে। ঐতিহ্যে আচড়নে এই সব দেশের সাথে আমাদের কত মিল – ত্রিশ হাজার ফুট উঁচু থেকে শ্রদ্ধায় নিচে তাকালাম প্রাচ্য সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলির দিকে। যাচ্ছি এশিয়া পেরিয়ে ইউরোপের দিকে, আজারবাইজানের রাজধানী বাকু হয়ে, বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক, তারপর পৌঁছুলাম ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে। আরেকটু দুরেই মস্কো – গোর্কি, তলস্তয়, কাফকার দেশ, চেখভের কৌতুকের সাথে মুজতবা আলির রসের কোথায় যেন একটা সম্পর্ক। তলস্তয়ের রিজারেকশনের মাসলভারা আমাদের কত কাছের চরিত্র।

প্লেনে বসে ঘন্টায় হাজার মাইল বেগে সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোলের পাতায় স্বপ্নভ্রমন অনেক হল। বাস্তবে হয়ত এসব দেশের মাটি কখনো ছোঁয়া হবে না। এ সব যখন ভাবছি প্লেন তখন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার আকাশ ছাড়িয়ে, জার্মানির বার্লিন হয়ে, কেল্টিক সাগরের উপর দিয়ে লন্ডনের আকাশে, হিথরো বিমান বন্দরের আশেপাশে চক্কর কাটছে। প্রতি দেড় মিনিটে একটি বিমান ওঠে বা নামে এখানে তাই নামার জায়গা পাচ্ছে না।

নিখুঁত টাচ ডাউনে, বিলাতের মাটি স্পর্স করল বিমানের চাকা। টার্মিনাল ভবনে স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চাদের দেখে হিথরোর কর্মকর্তারা আমাদের দলটাকে আলাদা লাইনে দাঁড় করালেন। ফলে কয়েকমিনিটে বেরিয়ে গেলাম বিশ্বের অন্যতম ব্যাস্ত বিমানবন্দরের আনুষ্ঠিনকতা সেরে। বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আগেই লন্ডনে আসা সানশাইন গ্রামার স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাফিয়া গাজী রহমান আর তাঁর লন্ডন প্রবাসী দূই ছেলে। ডাক্তার মেহতাব গাজী রহমান, কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন বৃটিশ মেডিকেল সার্ভিসে অতন্ত্য মেধাবী এ তরুণ। আর আফতাব গাজী রহমান, যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠত ব্যবসায়ী। মেহতাব, আফতাবের সাথে অনেকদিন পরে দেখা। বুকে জড়িয়ে ধরে নিরব থেকে বলা হল অনেক কথা। তাঁদের সাথে যোগ দিলেন, লন্ডনে আমাদের মেজবান Oxford Education Group এর প্রতিনিধী বৃটিশ তরুনী, সারা। এদের আন্তরিকতা ভালবাসায়, মুহুর্তে আপন হয়ে গেল লন্ডন।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.