--- বিজ্ঞাপন ---

বিলাতে কয়েকদিন ….২

0

রেফায়াত কবির শাওন##

লন্ডনে ট্রেনের সময়সূচী বলে কিছু আছে বলে মনে হল না। ষ্টেশনে গেলেন, স্বয়ংক্রিয় মেশিনে টাকা ফেলে টিকিট কাটলেন, প্লাটফর্মে মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলেন – ট্রেন আসল আর উঠে পরলেন। আগের ট্রেন পাঁচ মিনিট পরে আসল না পরের ট্রেন পাঁচ মিনিট আগে আসল বোঝার কোন উপায় নেই।রয়েল হলওয়ের ক্যাম্পাস থেকে এগহাম স্টেশনে পৌছুঁতে বিশ মিনিটের হাঁটা পথ পেরুতে ঘাম ঝরল বেশ। দূরত্বের কারণে নয়, গরমের কারণে। ব্রিটনদের মতে এবারের গরম নাকি লন্ডনের ইতিহাসে নতুন। মনে মনে বললাম গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ঠেলা তোমরাও কিছু সামলাও। আমাদের চট্টগ্রামতো ভেনিসই হয়ে গেল। অবশ্য এতে আমাদেরও পাপ কম নেই।

এগহাম স্টেশনটি ছোট ছিমছাম। অনেকটা আমাদের গ্রামদেশের ষ্টেশনের মত। এক পাশে লাল ইটের ছোট ঘর। সেখানে টিকিট কাউন্টার আর স্টেশন মাষ্টারের অফিস। ট্রেনের দুটো লাইন আর দূ’পাশে টানা প্লাটফর্ম। এপার ওপার যাবার জন্য কাঠের পাটাতনে লোহার হাঁটা ব্রিজ। আশে পাশে কিছু আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট আর সব কিছুর উপর ধুলোর আস্তরণ থাকলে দেশে আছি বলে ভুল হত।

এই দেশে ট্রেনে ওঠার মৌখিক ট্রেনিং আগেই নিয়েছিলাম, এখন প্র্র্যাকটিকাল পরিক্ষার পালা। ঝড়ের বেগে ট্রেন আসবে, সাইক্নোনের বেগে দরজা খুলবে, টর্নেডোর গতিতে আপনাকে উঠে যেতে হবে। সব কিছুই ভয়ন্কর রকমের স্বংয়ক্রিয়। আমাদের সফরের সার্বিক তত্বাবধানে থাকা এডুকেশন এক্সিলেন্সের খুররম ভাই আর সোমা আপা আমাদের একুশ জনের দলটাকে তিনভাগে ভাগ করে নিদ্রিষ্ট দুরত্বে দাঁড় করালেন, যাতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে ট্রেনে উঠতে পারি।

গন্তব্য ওয়াটারলু স্টেশন, বিখ্যাত ওয়াটারলু যুদ্ধের স্বরণে বেলজিয়ামের ওয়াটারলুর সাথে মিল রেখে এই এলাকার নামকরণ ওয়াটারলু, সেই সুবাদে স্টেশনটিও ওয়াটারলু, লন্ডনের ব্যাস্ততম রেলওয়ে স্টেশন, আছে বাইশটি প্লাটফর্ম। দ্রুতগামী ট্রেনে ইউরোপকে এক করা ইয়োরোস্টারের গন্তব্যও ছিল একসময় ওয়াটারলু। এগহাম থেকে উঠেছি সাউথওয়েস্টার্ন রেলওয়ের ওভারগ্রাউন্ড ট্রেনে। ওয়াটারলু শেষ ষ্টেষন বিধায় ওঠার সময় যে ত্রস্ততা ছিল নামার সময় তা নেই।

ট্রেন থেকে নেমেই সবেগে হাঁটা শুরু করল পাক্কা ছ’ফুট লম্বা এডাম, আমাদের আজকের গাইড। অক্সফোর্ড ইর্টারন্যাশনালের উজ্জল লাল টি শার্ট গায়ে থাকায় দূর থেকেও তাকে খুঁজে পাওয়া যেত সহজে, তার উপর হাতের লাল ফাইলটা ক্ষণে ক্ষণে উঁচিয়ে ধরত সে যাতে কসমোপলিটেন লন্ডনের বেজায় ভীড়ে কেউ হারিয়ে না যায়, আর ক্ষানিক পর পর থেমে সবার মাথা গুনাও যেন তার অভ্যাস।

আমার ছোট বেলার প্রায় প্রতিটা সকালে ঘুম ভেঙেছে লন্ডনের এক ঘড়ির শব্দে। যদিও এই আদার ব্যাপারী বিলাতের উড়োজাহাজে উঠেছি চল্লিশ পেরিয়ে। এক চ্যানেল টেলিভিষনের যুগে ভাল ভাল নাটক, ইংরেজি সিরিয়াল আর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের কোন অভাব ছিল না, কিন্তু খবরের অবস্থা ছিল জর্জ অরওয়েলের “১৯৮৪” উপন্যাসে পরা টেলিস্ক্রিনের অনবরত “পিগ আয়রণের” গুনগান করার মত। তাই আমরা সবাই বিবিসি রেডিও শুনতাম। বাংলায় সকাল সন্ধায় অনুষ্ঠান ছিল। অধিকাংশ লোক সন্ধা সাতটার নিউজ শুনলেও আমার বাবা ছিলেন সকালের অধিবেশনের ভক্ত। তখন লন্ডনে বিবিসির হেডকোয়ার্টার ছিল বুশ হাউসে, বিগ বেনের কাছেই। সকাল ছ’টায় (লন্ডনে রাত বারটা, দিনের শুরু) বিগ বেনের ঘন্টাধ্বনি সরাসরি সম্প্রচার করে শুরু হত বিশ্ব সংবাদ। বাবা ভলিউম বাড়িয়ে দিতেন যাতে সবার ঘুমও ভাঙে আর খবরটাও সবাই শুনে। সিরাজুর রহমান, মাহমুদ আলি, উদয় শংকর, উর্মি রহমান, সাগর সেনদের কন্ঠ এখনো কানে বাজে। পৃথিবীর নানা অঞ্চলের সব গল্প শুনেছি বিবিসির মানষী বড়ুয়ার কন্ঠে। সেই ঘুম ভাঙানিয়া বিগ বেনের কাছে এসে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম। তবে বিগ বেনের আবাস এলিজাবেথ টাওয়ার এখন স্টিলের বেড়ায় ঘেরা। ঘড়িটি চলছে না, ঘন্টাও বাজছে না। সংস্কার চলছে। আগামী বছর আবার চালু হবে। বিবিসি হেডকোয়ার্টারও সরে গেছে বুশ হাউস থেকে। এটি এখন কিংস কলেজের লন্ডন ক্যাম্পাসের অংশ।

 

বিগ বেন এর পাশেই বিশাল ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেস, বৃটিশ পার্লামেন্ট ভবন, সংসদিয় গনতন্ত্রের সুতিকাগার। ১৫১২, ১৮৩৪, দূবার অগ্নিকান্ডে পূড়ে যায় ভবনটি। নতুন করে তৈরি করা ১৩ লক্ষ বর্গফুট আয়তনের বিশাল স্ট্রাকচারটির বর্তমান ডিজাইনার চার্লস ব্যারি। সংসদিয় গনতন্ত্রের চর্চায় এই ভবনের গুরুত্ব এত বেশি যে এখন রাজনীতি বিজ্ঞানে একটি টার্ম চালু হয়েছে “ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসি”। অন্যদিকে ‘গোথিক’ আর্কিটেকচারে গড়া ভবনটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট ঘোষনা করেছে। মনে মনে ভাবলাম লুই কানের ডিজাইনে গড়া আমদের সংসদ ভবনও ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। গ্রাম বাংলায় ঘুরে লুই কানও আমাদের সংসদ ভবন ডিজাইন করেছেন নদীমাতৃক থিমে। এমন দিন হয়ত আসবে আমাদের সংসদ ভবনও গনতন্ত্র চর্চার কেন্দ্র হিসেবে সম্মানিত হবে।

আরকটু আগাতে বিখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টা এবি, রাজ – রানীদের অভিষেকের স্থান, বিয়ে শাদীর স্থান, এমনকি শেষকৃত্যেরও জায়গা। আগাচ্ছি কিং জেমস পার্কের দিকে, উদ্দেশ্য বাকিংহাম প্যালেস। হঠাত সামনা সামনি হলাম চার্চিলের স্ট্যাচুর। ভদ্রলোক অহিংস আন্দোলন করা সত্বেও গান্ধিকে পিশে মারতে চেয়েছিলেন, বাংলায় ছিয়াত্বরের মনন্তরের জন্যও অনেক ঐতিহাসিক তাঁকেই দায়ি করেন। বেলফোর ডিক্লারেশনে তার ভুমিকায় বিশ্বে যে দুষ্ট ক্ষত সৃষ্টি হয় তার প্রায়শ্চিত্ব হয়ত বিশ্বের ধ্বংস দিয়েই সম্ভব। অবশ্য জীবন সায়ান্হে, তাঁর ভূল বুঝতে পেরেছিলেন এই অসাধারন বাগ্মী মহানায়ক। তখন আর করার কিছুই ছিল না। একাধারে রাজনীতবিদি, চিত্র শিল্পী, লেখক সাবেক এই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রি বক্তৃতার জন্য নোবেল প্রাইজও পান। তবে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব যুদ্ধের জন্য তিনি শুধু নিজের জাতীকে ঐক্যবদ্ধ করেননি বরং বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের সমর্থনও নিজের প্রতি টেনে আনতে সক্ষম হন।

ভাল মন্দের মিশেল চার্চিলের মূর্তির নিচে ছবি তুলে ঢুকে পরলাম কিং জেমস পার্কে। ঘাসের গালিচা, রঙ বেরঙ ফুলের কেয়ারী আর লেকের পানিতে হাঁসের সন্তরন দেখতে দেখতে দৃষ্টিনন্দন কিং জেমস পার্ক পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম রাজবাড়ীর দিকে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.