--- বিজ্ঞাপন ---

বিলেতে কয়েকদিন….(৩) গনতন্ত্র দর্শন

0

রেফায়াত কবির শাওন ##

একটু ভাল করে ভেতরটা দেখতে গেটের সামনে দাঁড়াতেই বিশাল লোহার গেট খুলে গেল। বুঝতে পারিনি পেছনে একটি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। কাল পোষাকে এক পুলিশ সদস্য এসে অতি ভদ্রভাবে দেখিয়ে দিলেন পেছনে একটা গাড়ি। প্রধানমন্ত্রির অফিসে যাওয়া গাড়ির ড্রাইভারটিও কেমন বোকা, হর্ন বাজালোনা, রক্তবর্ণ চোখে তাকালোও না। আশে পাশের অন্যভবনগুলোর সাথে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট এমনভাবে মিশে আছে যে বৃটিশ প্রধামন্ত্রীর অফিস তেমনটা আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। কাছেই ৭০ হোয়াইট হল, ক্যাবিনেট ভবন, খালি হাতে এক মহিলা পুলিশ সদস্য পাহারা দিচ্ছে দরজায়, দু’একজন টুরিস্ট পথের ডাইরেকশন ও জিজ্ঞেস করতে দেখলাম তাকে। অতি ভদ্র ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছে কোন দিকে যেতে হবে।

এখানে প্রধানমন্ত্রির অফিস, সচিবালয় প্রভৃতি জায়গায় মন্ত্রিকে পার্কিং এ গাড়ী রেখে হেঁটে আসতে হয়। কোন কোন মন্ত্রী সাইকেলও চালান। কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছি, প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে আশা এক মন্ত্রী সাইকেল ভুল লেনে চালানোয় জরিমানা করে দিয়েছিল পুলিশ। কি অদ্ভুত দেশ। আর শার্লক হোমসের দেশের পুলিশও কেমন। হাজার হাজার টুরিস্ট রাস্তায় চলার হেন আইন নেই যা ভাঙছে না। কেউ হয়ত, ওয়াকওয়ে বাদ দিয়ে গাড়ি চলার রাস্তায় হাঁটা শুরু করছে, কেউবা বসে পড়ছে কোন সরকারি ভবনের সিঁড়িতে, পুলিশ অতি ভদ্র ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছে, কি ভুল হয়েছে, কি করতে হবে। এদেশের পুলিশের কোমরে পিস্তল গোঁজা তো নেইই, এমনকি হাতে একটা লাঠিও নেই। বছর পাঁচেক আগে, দিল্লীতে ভারত সরকারের কেবিনেট সেক্রেটারির সাথে এক মিটিঙে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল। বেচারা একটা এমবাসেডর গাড়ীতে করে এসেছিলেন। আগে পিছে গাড়ি নেই, কড়া পাহারা নেই, ট্রাফিক আটকে রাখা নেই – এসব গনতান্ত্রিক দেশে মানুষ কেন মন্ত্রী, এমপি হয় বুঝলাম না।

তবে প্রধানমন্ত্রির অফিস, ক্যাবিনেট রুম আর পার্লামেন্ট ভবনের যত কাছে আপনি যেতে পারবেন, বাকিংহাম প্যালেসের তত কাছে আপনি যেতে পারবেন না্। আমার মনে হল রাজতন্ত্র আর গনতন্ত্রের পার্থক্য বোঝাবার জন্যেই এই নিয়ম। আসলে বৃটেনের জাতীয় ঐক্যের প্রতিক, ঐতিহ্য আর সাতন্ত্রের প্রকাশ রাজভবনকে সম্মান জানাতেই এই ব্যাবস্থা । কাছাকাছি এসে দেখলাম প্রাসাদ চুড়ায় উড়ছে বৃটেনের জাতীয় পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক, তার মানে রানী এখন প্রাসাদে নেই জানালেন খুররম ভাই। রাণীর উপস্থিতি জানান দিতে প্রাসাদ চুড়ায় ওড়ে হলদে নীল ‘রয়েল স্ট্যানডার্ড’ ফ্ল্যাগ। নানা রঙের ফুলের বাগান, গাছ – গাছালির সাথে, বিশাল রাজপ্রাসাদ এমনভাবে মিশে আছে, মনে হয় আর্কিটেক্ট জন ন্যাশ সবকিছু একসাথে স্থায়ীভাবে তৈরি করেছেন। আমরা প্যালেসে এসেছি, কিং জেমস পার্ক ধরে, শর্টকার্ট হয়ে। প্রাসাদের আশপাশটা একটু ঘুরে এবার মুল রাস্তা দিয়ে উল্টো পথ ধরলাম। প্রাসাদের অর্ধবৃত্তাকার মুল ফটক প্রাসাদ থেকে কিছুটা দূরেই। আর ফটক থেকে মূল প্রাসাদ পর্য়ন্ত পথ লাল রঙে রাঙানো – রাজপথ।

টেমস নদীতে নৌ – ভ্রমন ছিল সম্ববত পুরো লন্ডন সফরের সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা। যতটা না নদীর দুপাশের দৃশ্যের জন্য, তারচেয়ে বেশি এর ধারাবর্ণনার জন্য। নদীর দিকে তাকিয়ে আমাদের মধ্যে কবিত্ব জেগে উঠল না। লন্ডনের এই অংশে নদী সরু, দুপাশে সবুজের কোন অস্তিত্ব নেই, মাথার উপর অসংখ্য ব্রিজ, স্রেতহীন শান্ত জলে চোখ রেখেও প্রশান্তি পাওয়ার কোন জো নেই। জল অসম্ভব ঘোলা।

তবে, নদীর দূ’তীরের স্থাপনা গুলোর দিকে তাকিয়ে এ নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা সভ্যতার আদি থেকে আধুনিক কালের অনেক কিছুই জানা যাবে। প্রচন্ড রোদ সত্বেও আমরা বোটের খোলা ছাদে উঠে বসলাম। চামড়া যখন কালই তখন তামাটে হওয়ার ভয় নেই, দূ’চোখ ভরে দেখতে হবে সভ্যতা আর গনতন্ত্রের জয়যাত্রার গল্পগুলো।

এডুকেশন এক্সেল্যান্সের কর্ণধার সামিরা আপা সবার জন্য ঠান্ডা কোকাকোলা নিয়ে এলেন। এই মহিলা কখন আমাদের কি লাগবে কিভাবে যেন বুঝে যান। হাঁটতে হাঁটতে ক্ষিদা লেগেছে, ওনাকে বলতে হবে না, আপনাকে টেনে নিয়ে যাবেন কোন রেস্টুরেন্টের দিকে। লন্ডনের কোকাকোলা আমাদের দেশে ছোটবেলায় খাওয়া কোকাকোলার মত। একবার খেলে অনেক্ষণ ঢেকুর ওঠে। কোকাকোলার ক্যানে প্রথম চুমুক দিতে জাহাজ বাঁক ঘুরল। পার্লামেন্ট ভবন পেরিয়ে বিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজ, টাওয়ার অব লন্ডন, লন্ডন আই, লন্ডন ব্রিজ। নদীর একপারে বাঁধা রাজকীয় জাহাজ বেলফাস্ট, ঐতিহাসিক এই জাহাজটি এখন জাদুঘর। তবে সবচেয়ে ভাল লাগল প্রতিটি ব্রিজের নিচ দিয়ে লঞ্চ যাওয়ার সময় ব্রিজের উপর হাঁটতে থাকা পথচারিদের নিচের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়া। আভিজাত্যের অহংকারের বদনাম থাকা বৃটিশদের এই আন্তরিকতা মুগ্ধ করার মত। টেমস নদীর উপর শুধু লন্ডন শহরেই আছে তেত্রিশটি ব্রীজ। আর পুরো নদীর যাত্রাপথে আছে দূশোরও বেশি ব্রিজ, টানেলও আছে বেশ কয়টি। একসময় তো টেমস নদীর তলপথকে সপ্তাশ্চর্য় ধরা হত।

দুপাশের আরো অনেক স্থাপনা পেরিয়ে আমাদের জাহাজ ভীড়ল গ্রিনীচের বন্দরে। টেট মডার্ণ আর গ্লোব থিয়েটারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনটা একটু খারাপ হল। এ যাত্রায় এগুলোর ভেতরে আর যাওয়া হবে না সময় সল্পতায়। যদিও আর্টে আমার জ্ঞান শুন্যের কোঠায়, তবু টেট মডার্ন এ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল এর বিচিত্র সংগ্রহ দেখতে। শুনেছি ভাঙ্গা কোকাকোলার ক্যান থেকে শুরু করে, কোন এক শিল্পীর প্রেমিকার ব্যবহ্রত অন্তর্বাসও এখানে স্থান পেয়েছে শিল্প মর্য়াদায়। একবার রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছিলাম এক ক্লিনিং কোম্পানীর লোকেরা আবর্জনা মনে করে কোটি টাকা মূল্যের শিল্প ফেলে দিয়েছিল এখান থেকে। আর সেক্সপিয়রের জন্মভূমিতে গিয়ে গ্লোব থিয়েটারে নাটক দেখার ইচ্ছা কার না হবে।

আন্তর্জাতিক সময় রেখা গ্রীনিচ মানমন্দিরের কাছেই বোট থেকে নামলাম। জায়গাটা আবার গ্রীনিচ বিশ্ববিদ্যালেয়ের ভেতরে। ডেন ব্রাউনের বইতে পড়েছি, সময়ের কেন্দ্র আগে প্যারিসের কাছে কোথাও ছিল, পরে গ্রীনিচে আনা হয়েছে। তবে সত্যতা নিয়ে গবেষণার সুযোগ হয়নি। সত্য যাইহোক, সময়ের অভাবে সময় রেখায় বেশিক্ষণ সময় ব্যয় করা যায় নি।

এবারের যাত্রা পাতাল রেলে। পৃথিবীর প্রথম পাতাল রেল চালু হয় লন্ডনে। প্রচুর শাখা প্রশাখায় এই পথ সংযুক্ত করেছে বিশাল শহর লন্ডনের নানা অংশকে। টিউব/লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড নামে পরিচিত এই পাতাল ট্রেন এর অসম্ভব দ্রূত গতির কারণে জনপ্রিয়। কেনারি হোয়ার্ফ ষ্টেশন থেকে পাতাল ট্রেন ধরে আবার এসে পৌছুলাম ওয়েস্টমিনস্টার এলাকায়। উদ্দেশ্য লন্ডন আই। চারশত তেতাল্লিশ ফুট উঁচু এই বিশাল নাগরদোলায় চড়ে মেঘহীন দিনে প্রায় পঁচিশ মাইল দূরের দৃশ্য দেখা যায়। শহরের এই অংশে ঐতিহাসিক সব স্থাপনার মাঝে, আধুনিক এই নাগরদোলা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু। তবে এর সমর্থকরা একে লন্ডনের আইফেল টাওয়ার হিসেবে দেখেন। টেমস নদীতে নৌ বিহারের সময় আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন কোন রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন নগর কর্তৃপক্ষের অর্থলিপ্সার কারণেই দাঁড়িয়ে আছে লন্ডন আই। তবে যে যাই বলুক চারশ ফিট উপর বসে বিভিন্ন কোন থেকে লন্ডন দেখার অনুভূতি সত্যি অন্যরকম।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.