কাশ্মীর নিয়ে ভারত -পাকিস্তান মুখোমুখি। কাশ্মীরে বর্তমানে কি অবস্থা বিরাজ করছে তা জানার জন্য মুখিয়ে আছে সারা বিশ্ব। ভারত -পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত নিয়ে একাধিকবার যুদ্ধ হলেও এবারের বিষয়টি কেউ হালকাভাবে নিচ্ছে না। ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মির নিয়ে বড় ধরনের কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে কিনা তা নিয়ে সারা বিশ্বে চলছে জল্পনা কল্পনা। ভারত-পাকিস্তানের কার অবস্থা কি রকম..এ নিয়ে পাঠকদের জানার জন্য কয়েক সিরিজের প্রতিবেদন প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের সংবাদ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন বিষয়সহ পুরো বিষয়টি তুলে এনেছেন নির্বাহী সম্পাদক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম…প্রকাশিত হলো ৫ম পর্ব।
পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বানানোর নাটকীয় কাহিনী
ভারত ১৯৯৮ সালের ১১ ও ১৩ মে ৫ টি পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। দেশটির পরমাণু বোমা তৈরীর পিতা বলে পরিচিত ড. এ পি জে আবদুল কালাম এর মূল পরিকল্পনাকারী। ভারতের বিশ্লেষকরা বলেন, ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যের রামেশ্বরমের একজন মসজিদের ইমাম জয়নুল আবেদিনের পুত্র বিজ্ঞানী ড. কালাম (জন্ম ১৫ অক্টোবর,১৯৩১ ইং) প্রতিপক্ষ মুসলিম প্রধান পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সম্মান এনে দেন পরমাণু বোমা তৈরী ও ‘অগ্নি’ ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। ১৯৮৯ সালে তার উদ্ভাবিত দূরপাল্লার ‘অগ্নি’ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার পর ড. কালামকে ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ড. এ পি জে কালাম ভারতের ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন । ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই শিলং এর একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেয়ার সময় হার্ট এ্যাটাকে তিনি মারা যান। এদিকে ভারতের জবাবে পাকিস্তানও নিজেদের পরমাণু শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটাবে ঘোষণা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এই বিস্ফোরণ না ঘটাতে চাপ দেয় এমনকি শতাধিক এফ-১৬ সহ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও আর্থিক অনুদানের টোপ দেয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এতে রাজী হয়নি। শেষ পর্যন্ত ভারতের পরীক্ষার দু সপ্তাহের পরই পাকিস্তান বেলুচিস্তানের চাগাই পর্বতে ১৯৯৮ সালের ২৮ মে একসঙ্গে ৫টি ও পরে ৩০ মে আরও ১টি সহ মোট ৬ টি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভারতের জবাব দেয়। পাকিস্তানের এ পরমাণু বোমা বানানোর পিতা বলা হয় ড. আবদুল কাদের খানকে। ড. কাদের খানের পরমাণু বোমা বানানোর পরিকল্পনা জেমস বন্ড ০০৭ সিরিজকেও হার মানায়। আমেরিকার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট এস. নরিস পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদের খানের উপর এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। ড. খান কিভাবে ইউরোপ থেকে পরমাণু বোমা তৈরীর নকশা চুরি করে পালিয়ে আসেন পুরো ঘটনার উল্লেখ রয়েছে তার লেখায়। এখানে খানিকটা উদ্ধৃত করা গেল। ভারতের ভূপালে জন্ম ড. আবদুল কাদের খান (জন্ম ১ এপ্রিল, ১৯৩৬) এর পিতামাতা দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন। পাকিস্তান থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি জার্মানীর বার্লিন ও নেদারল্যান্ডস থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও মাস্টার্স নেন মেটালার্জিতে । এবং পরে বেলজিয়াম থেকে ঐ বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী নেন। ইউরোপে পড়াশোনার সময় তিনি ১৯৬৪ সালে নেদারল্যান্ডের নাগরিক হেন্ডরিনা রিটারিংকে বিয়ে করেন। স্ত্রী ঐ দেশের নাগরিক হওয়ার সুবাদে ড. কাদের খান ১৯৭২ সালে ইউরোপের সবচাইতে স্পর্শকাতর তিন জাতির যৌথ পরিচালনায় ( জার্মান, ডাচ ও বৃটিশ) আণবিক বোমা তৈরীর উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কারখানা ‘ইউরেনকো’এবং পরে নেদারল্যান্ডের আলমেলোতে প্রবেশের সুযোগ পান। তার কাজ ছিল জার্মান ভাষায় লেখা আনবিক বোমা তৈরীর সেন্ট্রিফিউজগুলোর ডক্যুমেন্ট ডাচ ভাষায় অনুবাদ করা। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারত সেদেশের রাজস্থান রাজ্যের পোখরানে প্রথম আণবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। তখনই ড. খানের মাথায় নিজ দেশ পাকিস্তানের জন্য বোমা তৈরীর পরিকল্পনা মাথায় ঢোকে। তিনি ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তার পরিকল্পনার কথা চিঠিতে জানান। ভুট্টো সাথে সাথে তাকে উৎসাহ দেন এবং তিনমাসের মধ্যে ডিসেম্বর মাসে ড. খানের সাথে গোপন বৈঠক করেন। এভাবে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৭৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনবিক বোমা তৈরীর মূল নকশা, সরঞ্জাম সাপ্লাইয়ারদের তালিকা চুরি করে স্ত্রী ও দু কন্যাকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন। পরে নেদারল্যান্ডস সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ড. আবদুল কাদের খানকে গ্রেফতার করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। পরে দেশটি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেয়। ড. কাদের খান দেশে ফিরে পাকিস্তান সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায় খান রিচার্স লেবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। এবং আণবিক বোমা বানানোর কাজে হাত দেন এবং সফলতার সাথে তা বানান। পরে তিনি পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচীতে সফলতা দেখান। সেখানে হাতাফ, গৌরী, আবদালী, শাহীন প্রভৃতি শ্রেণীর ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী করা হয় তার পরিকল্পনায়। এভাবে বিদেশে তিনি ‘চোর’ হিসেবে চিহ্নিত হলেও দেশে তিনি আণবিক বোমা তৈরীর পিতা ও বীরের সম্মান পান।
ভারত-পাকিস্তানের পরিক্ষামূলক পারমানবিক বিষ্ফোরণ ও দেশ দু’টির উপর নিষেধাজ্ঞায় লাভ বেশী কার
বিভিন্ন সময়ে মার্কিন ও পশ্চিমা দেশের অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞায় পাকিস্তানের লাভই হয়েছে। দেশটি পশ্চিমা দেশগুলোর উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে শুরু করে। মার্কিন এফ-১৬ বিমান সরবরাহের ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তান জীদ করে অবশেষে চীনের সাথে যৌথভাবে নিজেদের তৈরী প্রথম জঙ্গী বোমারু বিমান জেএফ-১৭ থান্ডার তৈরী করেছে। পাকিস্তান দাবী করে এই জেএফ-১৭ মার্কিন এফ-১৬ বিমান থেকেও অতি কার্যকর।
বিশ্লেষকরা সেই প্রমাণটি পেয়েছেন গত ২৭ ফেব্রুয়ারী ভারতের সাথে কাশ্নীর সীমান্তে সংঘর্ষের সময়। পাকিস্তান দাবী করেছিল তাদের জেএফ-১৭ থান্ডার বিমানই ভারতের মিগ-২১ বিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তানে নামিয়ে এবং ভারতীয় পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করে। ভারত বলেছিল পাকিস্তানের মার্কিন সরবরাহকৃত এফ-১৬ জঙ্গী বিমান ঐ হামলায় অংশ নেয় এবং ভারতের মিগ-২১ বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার আগে ডগফাইটে পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানকেও ভূপাতিত করেছে। অবশ্য পরে ভারতের ঐ দাবী মিথ্যা ভুয়া প্রমাণিত হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে জেএফ-১৭ বিমান অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। কামরায় অবস্থিত পাকিস্তান এ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স (পিএসি)এ এপর্যন্ত ১০০টিরও বেশী বিমান তৈরী করেছে দেশটি। চীনের সাথে যৌথভাবে তৈরী সফল এ জঙ্গী বিমানের ৫৮ ভাগই পাকিস্তানে তৈরী করা হয়।
নাইজেরিয়া ও মায়ানমারে এ জঙ্গী বিমান রফতানি করেছে পাকিস্তান। অপরদিকে ভারত নিজেদের হিন্দুস্থান এ্যারোনেটিক্স লি: এ তৈরী ‘তেজাহ’ জঙ্গী বিমান এখনও রফতানি দূরে থাক পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারেনি অর্থ্যাৎ আলোর মুখ দেখেনি বলা চলে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আরেক সফল প্রকল্পের নাম পাকিস্তানের তৈরী মেইন ব্যাটল ট্যাংক (এমবিটি) ‘আল খালিদ’।
২০০১ সালে পাকিস্তানের হেভি ইন্ডাষ্ট্রিজ টাক্সিলায় চীনের সাথে যৌথভাবে তৈরী ৪৬ টনের এই এমবিটি আল খালিদ এপর্যন্ত ৩১০টি তৈরী করেছে সফলতার সাথে। তুলনামূলকভাবে ভারতের ‘অর্জুন’ নামের ট্যাংক এখনও সফলভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি।এখনও অর্জুন ট্যাংকের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। পাকিস্তান আল খালিদ ট্যাংক ছাড়াও পুরোনো মডেলের চীনের টি-৫৯ ট্যাংককে আধুনিকায়ন করে ‘আল জারার’ ট্যাংক তৈরী করেছে।এক হিসাবে দেখা গেছে, পাকিস্তানের নিকট ইউক্রেন থেকে ক্রয় করা টি-৮০ ইউডিসহ বিভিন্ন মডেলের ২,৭৩৫টি ট্যাংক রয়েছে। সাঁজোয়া যান রয়েছে ৩,০৬৬টি, আর্টিলারী বহরে রয়েছে ৩,৭৪৫টি কামান।
তম্মধ্যে ২৫০টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এম-১০৯এ৫ ১৫৫মিমি ও এ-১০০ই ৩০০মিমি স্বয়ংক্রিয় হুইটজার কামান। ক্ষেপণাস্ত্র তৈরীতেও পাকিস্তান ভারতের চাইতে এগিয়ে গেছে। পাকিস্তান ‘হাতফ’ শ্রেণীর মিসাইল রয়েছে স্বল্প থেকে দূরপাল্লার। এছাড়া রয়েছে, ‘বাবুর’ ক্রুজ মিসাইল, ‘আবদালী’ ব্যালাস্টিক মিসাইল, ‘শাহীন’ শ্রেণীর স্বল্প থেকে দূরপাল্লার পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র। পাকিস্তানের সবক’টি ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ভারতে মুসলিম শাসনামলের বীর যোদ্ধদের নামকরণে। ‘বাবুর’
ক্ষেপণাস্ত্রেও নাম দেয়া হয়েছে ভারতে মুসলিম বীর সেনাপতি মোগল সম্রাট বাবরের নামকরণে। ভারতে একটি স্বাধীন হিন্দু রাজ্য কায়েমের জন্য রাজপুত রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে ১২০ জন রাজপুত সর্দার, ১ লক্ষ ২০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য, ১ হাজার হস্তিবাহিনীসহ বিশাল বাহিনী মুসলিম সম্রাট বাবরের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাহিনীকে ধূলিস্যাৎ করার প্রত্যয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বাবুরের উঁচু মনোবলে বলীয়ান ক্ষুদ্র বাহিনীটি বিশাল রাজপুত বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ভারতে মোষল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। পাকিস্তান সেই বীর সেনাপতি বাবুরের নামে ক্ষেপণাস্ত্রের নামকরণ করেছে ‘বাবুর’ ।
এখানে বলা প্রয়োজন, পাকিস্তান-ভারত ইতিপূর্বে তিনবার নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে ৩-১৬ ডিসেম্বর, এর আগে ১৯৬৫ সালের ৬-২২ সেপ্টেম্বর কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এবং ১৯৪৭ সালের ২১ অক্টোবরও কাশ্মীর নিয়ে। তবে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরপরই তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারত পরমাণু বোমা বানাচ্ছে এমন পরিকল্পনা শোনার পর প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন, ভারত যদি পরমাণু বোমা বানায় তাহলে পাকিস্তানও ঘাস,পাতা এমনকি উপোষ থেকে হলেও পরমাণু বোমা বানাবেই। এদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার এ দু দেশের পরস্পর পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশ দুটির উপর সামরিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আগে থেকেই জানত যে, পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানাচ্ছে এজন্য সেদেশের সিনেটের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান ল্যারি প্রেসলার ইসরাইলের সমর্থক ইহুদি লবির চাপে পাকিস্তান যাতে পরমাণু শক্তির অধিকারী না হয় সেজন্য শুরু থেকেই চাপে রাখার জন্য শুধু পাকিস্তান কেন্দ্রিক একটি বিল তৈরী করে ১৯৮৪ সালের ২৮ মার্চ। এর নাম দেয়া হয় প্রেসলার সংশোধনী বিল। এই বিল কংগ্রেসে উত্থাপিত ও পাস হয় ১৯৮৫ সালের আগস্টে যা ‘প্রেসলার এমেন্ডমেন্ট বিল’ নামে পরিচিত। এই বিলের সার হল পাকিস্তান কোন পরমাণু বোমা বানাচ্ছেনা কিংবা তার হাতে এ জাতীয় কোন বোমার কোন সরঞ্জাম নেই এমর্মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সই করলেই তবেই পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া হবে। এই আইন প্রয়োগ করে বহুবার পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম বিশেষ করে এফ-১৬ জঙ্গী বিমান ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী আটকে দেয়া হয়। এত কিছুর পরেও পাকিস্তানকে দমানো যায়নি অবশেষে দেশটি ড. আবদুল কাদের খানকে দিয়ে দেশটি পরমাণু শক্তির অধিকারী হয়েছে।
বিশ্বের সেরা স্পেশাল সার্ভিসেস কমান্ডোর তালিকায় পাকিস্তান, ভারত নেই
বিশ্বের বহু দেশকে পেছনে ফেলে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপকে ৮ম স্থানের মর্যাদা দিয়েছে বিশ্বে সুপরিচিত সংবাদ মাধ্যম অষ্ট্রেলিয়ার ‘বিজনেস ইনসাইডার’। পত্রিকাটি সারগর্ভ ও বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য ইতিমধ্যেই সর্বমহলে সমাদৃত। গত ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল সংখ্যার ঐ প্রতিবেদনে শিরোনাম দেয়া হয় “দি এইট মোস্ট এলিট স্পেশাল ফোর্সেস ইন দি ওয়াল্ড” এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেনাদের বিশেষ বাহিনীর উপর আলোকপাত করে তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। সংখ্যায় আনুপাতিক দিক ও আধুনিক অস্ত্রসম্ভার সহ বিশাল বাহিনীর অধিকারী ভারত সহ অনেক দেশই তালিকায় বাদ পড়েছে। পাকিস্তানের এসএসজি’র কর্মক্ষমতা ও দক্ষতার উল্লেখ করে এতে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়। এসএসজি কমান্ডোদের দক্ষতার ব্যাপারে বলা হয় তাদের প্রশিক্ষণটি এতই কঠিন যে, যেকোন এসএসজি কমান্ডো সেনা ৫০ মিনিটে ৫ মাইল দৌড়াতে সক্ষম এবং ১২ ঘন্টায় ৩৬ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম এই এসএসজি। বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকার বার্ষিক ঐ তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভী সীলকে ১ নং ও বৃটেনের স্পেশাল বোট সার্ভিস ২য় সেদেশের এসএএস স্পেশাল এয়ার সার্ভিসেসকে ৩য় এবং ইসরাইলের সায়েরেট মাটকালকে ৪র্থ স্থান দেয়া হয়। এতে ফ্রান্সের জিআইজিএন ৫ম, রাশিয়ার আলফা গ্রুপকে ৬ষ্ঠ এবং স্পেনের নেভাল স্পেশাল ফোর্সকে ৭ম স্থানের মর্যাদা দেয়া হয়।
অত্যাধুনিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমান বিক্রী ও সরবরাহ নিয়ে মার্কিন নাটক
বিশ্লেষকরা বলছেন, এফ-১৬ নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতকে নাখোশ করার নাটক আবার মঞ্চস্থ হতে চলেছে। ভারতের জন্য খবরটি সুখকর নয়। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে দেশে ফিরতে না ফিরতেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঐ সফরটি যে কতটা সফল এর ফল আসতে শুরু করেছে। গত ২৬ জুলাই ইমরান সফরের ৩ দিন পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের জন্য ১২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের কারিগরী সহায়তা কার্যক্রম ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর ফরেন মিলিটারি সেলস এর আওতায় টিএসটি (টেকনিক্যাল সিকিউরিটি টিম) পাকিস্তানের সকল এফ-১৬ জঙ্গী বিমানে এ সহায়তা দেয়া হবে। টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রোগ্রাম দিচ্ছে । দীর্ঘদিন এ সহায়তা বন্ধ থাকায় পাকিস্তানের কাছে থাকা এফ-১৬ জঙ্গী বিমান প্রায় অচল হতে চলেছিল। আন্তর্জাতিক মহলে ক্রিকেটার হিসেবে সুপরিচিত ইমরান খানের যাদুতে অবশেষে দু’দেশের মধ্যে বরফ গলতে শুরু করেছে। এফ-১৬ জঙ্গী বিমান নিয়ে দীর্ঘদিন পাক-মার্কিন সম্পর্কে টানাপোড়ন চলেছিল। কখনও দেবে আবার কখনও স্থগিত রাখবে এভাবেই অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে থাকতে দেখা যায় পাকিস্তানের এফ-১৬ ।
ইমরান-ট্রাম্প ৪৭ মিনিটব্যাপী নজিরবিহীন প্রেস ব্রিফিংকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৭০ বছরের কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের মধ্যে মধ্যস্থতাকরতে প্রস্তাব দেন। এসময় তিনি মোদি তাকে এব্যাপারে আগাম অনুরোধ জানিয়েছে বলেন। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় মোদি নাকি ট্রাম্পকে এটা বলেননি। ইমরানের এ সফল সফরকে ভারত ভাল চোখে দেখেনি। এরই মধ্যে এফ-১৬ সাপোর্ট প্রোগ্রামের জন্য মার্কিন সহায়তা ভারতের জন্য অশনি সংকেত এর মত। মার্কিন প্রভাবশালী থিংক ট্যাংক উড্রো উইলসন সেন্টারের এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর ও দক্ষিএশিয়ার সিনিয়র এসোসিয়েট মাইকেল কুজারম্যান পাকিস্তানের ডন প্রত্রিকায় ইমরান খানের সফরের মুল্যায়ন নিয়ে একটি কলাম লেখেন। কলামের শিরোনাম দেন ‘তিনি আসলেন দেখলেন জয় করলেন’। এটি প্রকাশিত হয় ইমরান খানের সফরের শেষে। ইমরান সফর করেন ২২ থেকে ২৪ জুলাই ৩ দিন । কলামটি প্রকাশিত হয় ২৫ তারিখে। মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে পুনরায় সামরিক সরঞ্জাম বিক্রী ও সহায়তা করবে এমনটি ইমরান খানের সফরের ১০ দিন আগেই শীর্ষ একজন সামরিক জেনারেলের বক্তব্যে পরিস্কার হয়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ নমিনি জেনারেল মাইক মিলি মার্কিন সিনেটের আমর্ড সার্ভিসেস কমিটির সম্মুখে রাখা বক্তব্যে পাকিস্তানের সাথে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করার সুপারিশ করেন।
এদিকে, ভারত পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক সহায়তা কর্মসূচী পুনরায় চালু করায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত ১ আগস্ট ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় সাংবাদিক রেজাউল এইচ লস্কর পাকিস্তানে পুনরায় মার্কিন অত্যাধুনিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমান সহায়তা কর্মসূচী চালু সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৈঠকের পরপরই এ সামরিক চুক্তিটি তাৎপর্যবহ উল্লেখ করেন। তাঁর প্রতিবেদনে বলা হয়, আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানে স্থগিত রাখা মার্কিন সামরিক সাহায্য কর্মসূচী পুনরায় চালু করতে যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন গত বছরের জানুয়ারীতে পাকিস্তান সন্ত্রাস দমন কর্মসূচীতে যুক্তরাষ্ট্রকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছেনা মর্মে অভিযোগ এনে দেশটিকে দেয়া বার্ষিক সামরিক সাহায্য স্থগিত ঘোষণা করে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরাতে পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবানদের বৈঠকে রাজী করানোর বিনিময়ে মূলত: ইসলামাবাদকে পুরস্কার হিসেবে আবারও সামরিক সহায়তা কর্মসূচী চালু করছে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাভিশ কুমার নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিং এ জানান যে, পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক সহায়তা পুনরায় চালু করায় এবং এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রোগ্রামের জন্য ১২৫ মিলিয়ন ডলারের যে ঘোষণা ট্রাম্প প্রশাসন দিয়েছেন এ চুক্তিতে নয়াদিল্লী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। আমাদের উদ্বেগের কথা আমরা নয়াদিল্লীতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সে দেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমেও গভীর উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে মার্কিন সামরিক সদর দপ্তর পেন্টাগন পাকিস্তানকে প্রস্তাবিত এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের সহায়তা কর্মসূচী প্রদানের ব্যাখ্যায় বলা হয়, পাকিস্তান সে দেশে আগে থেকে ক্রয় করা এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের জন্য চলমান কারিগরী সহায়তা চেয়েছে অর্থ্যাৎ টেকনিক্যাল সাপোর্ট চেয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতেই মার্কিন সরকার এ ১২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের প্রস্তাবিত চুক্তির ঘোষণা দেয় । পেন্টাগনের পক্ষ থেকে এব্যাপারে আরও বলা হয়েছে যে, এতে করে ঐ অঞ্চলে আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যে কোন পরিবর্তন আসবেনা।এমনিতেই ইমরান খানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাশ্নীর নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব করেন। এবং এজন্য নাকি ভারতের মোদি ইমরান খানের সফরের ঠিক আগের সপ্তাহে ট্রাম্পকে এ মধ্যস্থতার অনুরোধ করেছিলেন।
ভারতের পক্ষ থেকে এর পরপরই বিবৃতিতে বলা হয় প্রধানমন্ত্রী মোদি নাকি এ ধরণের কোন প্রস্তাব নিয়েই আলোচনা করেননি। এ নিয়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে কিছুটা বিতর্ক চলছে ঠিক তখনই পাকিস্তানকে বহুদিন স্থগিত রাখা উঠিয়ে নিয়ে পুনরায় এফ-১৬ জঙ্গী বিমান সহায়তার বিষয়টি ভারতীয় মহলে উনুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মত ঘটনা। ভারত কখনোই চায়না মার্কিনীরা পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দিক। পরবর্তীতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও ভারত কোন বড় অস্ত্র চুক্তি করলে সে দেশের আশংকা জানিয়ে প্রতিবাদমুখর হতে দেখা যায় । বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানীকারক দেশ হচ্ছে ভারত (স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইন্সটিটিউট, ২০১৯)। পাকিস্তানে কোন দেশ অস্ত্র বিক্রয় করতে গেলেই আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হবে যুক্তি দেখিয়ে সরবরাহকারী দেশকে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে ভারত । সেসব দেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতিও দেয় দেশটি। এক্ষেত্রে ভারত কখনও সফল হয়েছে কখনও হয়নি। পাকিস্তানের বেলায় এটা ভারতের একটা চিরাচরিত নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। পাকিস্তানের অস্ত্র ক্রয়ে তার আশংকা কম থাকারই কথা। পরমাণু শক্তির অধিকারী বলেই পাকিস্তানকে ভারত সমীহ করে চলে এটা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা। এমনকি পাকিস্তান অন্য কোন দেশ যেমন রাশিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ থেকেও উচ্চ প্রযুক্তির সমরাস্ত্র কিনতে পারেনা ভারতের বাধার কারণে। গত ফেব্রুয়ারীর সীমান্ত সংঘর্ষের সময় এই এফ-১৬ ভূপাতিত করার ভুয়া দাবী করেছিল ভারত। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিজেদের তৈরী জেএফ-১৭ থান্ডার জঙ্গী বিমানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই ভারতের মিগ-২১ বিমান ভূপাতিত করে পাইলট উইং কমান্ডার ‘অভিনন্দন বর্তমান’কে আটক করা হয়। ভারতের দাবী ও অভিযোগ পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিশেষজ্ঞরা সেখানে গিয়ে গুণে সবগুলোই বিমান ঠিকঠাক আছে দেখতে পান যার কোনটি খোয়া যায়নি। মার্কিন প্রভাবশালী ম্যাগজিন ফরেন পলিসি’র ওই প্রতিবেদনের পর আন্তর্জাতিক অ্গংনে ভারতের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। (চলবে)