--- বিজ্ঞাপন ---

সংবাদপত্র এখন ফেসবুক, অনলাইনে

0

::কাজী আবুল মনসুর ::

এডমান্ড বার্ক বৃটিশ রাজনীতিবিদ, একইসাথে একজন লেখকও। প্রায় ১৫০ বছর আগে সংবাদপত্র নিয়ে হাউস অব কমন্স এ দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, পার্লামেন্টের তিনটি রাষ্ট্র রয়েছে। কিন্ত ঐ যে দূরে সাংবাদিকদের আসনসারি, সেটি হচ্ছে পার্লামেন্টের ‘চতুর্থ রাষ্ট্র’ বা ফোর্থ এস্টেট এবং আগের তিনটি রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডিলানো রুজভেল্ট এর উক্তি ছিল এ রকম, ‘যদি কখনো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কার্যকরভাবে খর্ব করা হয়, তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা, বক্তব্য রাখার এবং জনসমাবেশের অধিকার প্রভৃতি গণতান্ত্রিক মৌল অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়বে।

সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা দুটো বিষয় যে কোনো  রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলো ছাড়া রাষ্ট্র-সমাজ অচল। পৃথিবীতে রাষ্ট্রিয় উত্থান-পতন এবং যুদ্ধ বিগ্রহের পেছনে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরাই অগ্রণী ভুমিকা রেখে চলেছে। এই ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশদের তাড়ানো থেকে শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সবখানে সংবাদপত্র আর সাংবাদিকদের কলমের ভূমিকা ছিল অন্যতম। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘অসির চেয়ে মসি বড়’। কথাটি কিন্ত এমনি এমনি চালু হয় নি। সাংবাদিকরা যেখানে কলম ধরেছেন, সেখানে হয় সাম্রাজ্য ধসে পড়েছে না হয় নতুন সাম্রাজ্যের উত্থান হয়েছে। আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে যত সহজে সংবাদ বের হচ্ছে পূর্বে এমনটি ছিল না। সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা ছিল রীতিমতো কঠিন। বিশেষ করে এ ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। ১৭৮০ সালে জেমস হিকি নামে একজন ইংরেজ প্রথম ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এর প্রায় ৮০ বছর পূর্বে ইংল্যান্ডে দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়। ভারতবর্ষেও সাংবাদিকতার পূর্বের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। বৃটিশ রাজ হঠাতে সাংবাদিকরা কলম ধরতে গিয়ে অনেকে নাজেহাল হয়েছেন চরমভাবে।

সংবাদপত্রের উপর দফায় দফায় সেন্সরশীপ আরোপ থেকে শুরু করে সংবাদপত্র বন্ধের ইতিহাসও কম নয়। আইরিশ বংশোদ্ভুত উইলিয়াম ডুয়ানে নামের একজন খ্যাতিমান মার্কিন সাংবাদিক এক সময় কলকাতায় ছিলেন একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। সরকার বিরোধী ভূমিকার কারনে তাকে এক সময় অপহরণ করা হয়েছিল। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে তার উপর চলে নানা মানসিক নির্যাতন। শেষপর্যন্ত বৃটিশরা তাকে ভারত থেকে নির্বাসিত করেন। ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক ছিলেন জেমস সিল্ক বাকিংহাম। এক সময় চাকরি করতেন জাহাজে। তার কাজ ছিল ক্রীতদাস বোঝাই জাহাজ পরিচালনা। ভারতবর্ষের বৃটিশ রাজনীতি দেখে তিনি জাহাজের চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। একটি মাত্র কারনে তিনি সাংবাদিকতায় পেশায় আসেন, তা হলো ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধী রাজনৈতিক হিসেবে তার পরিচিতি। ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কলম ধরা। তিনি ছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া বিরোধী বৃটিশ হুইগ পার্টির সমর্থক।

ভারতে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করে তিনি শুরু করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা অনিয়ম-গোমর একের পর এক ফাসঁ করতে থাকলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রোসানলে পড়েন তিনি। তার সাথে পাল্লা দিতে না পেরে এ সময়ের অনেক ভারতীয় পত্রিকার সাংবাদিকদেরও ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেন জেমস। শেষপর্যন্ত তাকেঁ কয়েকবার দীপান্তরে যেতে হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম কর্ণধার লর্ড হেস্টিং তাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে না এলে হয়ত তাকে মেরেই ফেলা হতো।

উপরের কথাগুলো এ জন্য বললাম সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কোন সময় নিরাপদ ছিল না। রাষ্ট্র, সমাজ বা প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরলে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকরা হুমকির মূখে পড়েন। বৃটিশ ভারতের সাংবাদিকরা কলম ধরে দীপান্তরিত হলেও এখনকার সাংবাদিকদের অনেকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে তুরস্কে। তুরস্কের সৌদি দুতাবাসের ভেতরে টুকরো টুকরো করে কেটে সৌদি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জামাল খাসোগীতে হত্যা করা হয়েছে। বিশে^ তোলপাড় হলেও এ হত্যাকান্ডের পেছনে যে সৌদি রাজপরিবার জড়িত তা প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। জামাল খাসোগী সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ট মিত্র ছিলেন, সেই হিসেবে রাজপরিবারের অনেক গোপন কথা তিনি জানতেন। যেমন ভারতবর্ষের বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোপন কথা জেনে হুমকির মূখে পড়েছিলেন বাকিংহাম। বাকিংহাম হত্যাকান্ডের শিকার হতে বেচেঁ গেলেও রক্ষা পায় নি খাসোগী। তাই সাংবাদিকতা ঝুঁিক যেমন রয়েছে তেমনি এ ঝুঁকি এড়ানো কোনক্রমে সম্ভব নয়। সব সময়, সব কালে ঝুঁকি থাকবে। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নানা ধরনের ঝুকিঁ প্রায় সময় সাংবাদিকদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট র্জানালিস্ট (সিপিজে)’ এর রির্পোট মতে, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি হতে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশে^ও বিভিন্ন দেশে ৫৩জন সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। বেশিরভাগ সাংবাদিককে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন আড়াই’শ সাংবাদিক। গত ২০১৭ সালে ৪৭ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮ জনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সব দেশে কোন না কোনভাবে সাংবাদিকরা হেনস্থার শিকার। হয় সরকারী দলের হাতে, না হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে সাংবাদিকরা অহরহ হামলার শিকার হচ্ছে। ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের সমালোচনা করায় কিশোরচন্দ্র নামের একজন টেলিভিশন সাংবাদিককে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে। মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করায় রয়টারের দু’জন সাংবাদিক ওয়া লোন ও কিয়াও সোয়েকে গ্রেফতার করে বিচার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি তথ্য প্রযুক্তি আইনে আন্তর্জাতিক ফটো সাংবাদিক শহীদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পরে জামিনে বেরিয়ে এলেও তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। চীনে আন্তর্জাতিক ফটো সাংবাদিক লু গুয়াংকে আটক করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারিয়া রেসা নামের এক সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকান্ডে সোচ্চার হলেও তার দেশে ২০১৮ সালে ৬৮ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি মিসরে ২৫ জন, সৌদিআরবে ১৬ জন, ইরিত্রিয়ায় ১৬ জন, আজারবাইজানে ১০ জন, ভিয়েতনামে ১১ জনসহ ২৫১ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে আশঙ্কাজনকহারে সাংবাদিকদের গ্রেফতার হয়রানি চলছে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সারা বিশ্বে সাংবাদিকরা নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। ফলে হুমকির মূখে পড়ে অনেকে সাংবাদিকতাবপেশায় ইতি টানছেন। অন্যদিকে অব্যাহত তথ্য প্রযুক্তির দাপটে সাংবাদিকতা পেশায় ক্রান্তিকাল শুরু হয়েছে।

বর্তমানে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রিয় যন্ত্র কেড়ে নিচ্ছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কলেবর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। তথ্য প্রযুক্তি বিকাশের সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রিন্ট মিডিয়ার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সারা বিশ্বে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ক্রান্তিকাল চলছে। সেটা উন্নত দেশ হোক বা অনুন্নত। সব দেশের সাংবাদিকরা অহরহ চাকরি হারাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যত হচ্ছে ততই সাংবাদিকতা পেশা হুমকির মূখে পড়ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সংবাদপত্র। বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। ২০১৭ অস্ট্রেলিয়াতে যখন সাংবাদিকদের চাকরির উপর খড়গ নেমে আসে তখন ‘দি গার্ডিয়ান’ এ একটি রিপোর্ট হয়েছিল। সাংবাদিক মার্গারেট সাইমনস এর ‘জার্নালিজম ফেইসেস এ ক্রাইসিস ওর্য়াল্ড ওয়াইড, উই মাইট বি এন্টারিং এ নিউ ডার্ক এইজ’ শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে বিশ^ব্যাপি সাংবাদিকদের চাকরি হারানোর প্রতিযোগিতা চলছে। তথ্য প্রযুক্তি কেড়ে নিচ্ছে সাংবাদিকতার প্রান। এ যেন অন্ধকার যুগের ছায়া।

উন্নত, উন্নয়নশীল ও দরিদ্র সব দেশেই প্রযুক্তির ছোয়ায় পাল্টে যাচ্ছে সাংবাদিকতার সার্বিক চিত্র। একদিকে কমছে সাংবাদিকদের চাকরি, অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক সংবাদপত্র। লোকসানের কারনে গুটিয়ে নিতে হচ্ছে সংবাদপত্র কোম্পানি। ছাটাই চলছে সব দেশে। ছোট হয়ে আসছে কলেবর। একই সাথে তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের ঢেউয়ে বাড়ছে অপসাংবাদিকতা। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে এমন এক ধরনের সাংবাদিকতার কাজ চলছে যাদের সাথে সাংবাদিকতা পেশার বিন্দুমাত্র সর্ম্পক নেই। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব এক্ষেত্রে ভুমিকা রাখছে। যে যেভাবে পারছে সংবাদচিত্র গণমাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছে। এসব সংবাদের কোন গভীরতা নেই। হালকা বা চটুলভাবে উপস্থাপন কওে বাহ্বা নেয়ার চেষ্টা চলছে। ফলে সাংবাদিকতা শিল্পের সম্মানের জায়গাটি মূখ থুবড়ে পড়ছে। ফেসবুক, গুগল বা ইউটিউব নির্ভর সাংবাদিকতা বেড়ে যাওয়ার কারনে সংবাদপত্র প্রকাশনার সাথে জড়িত মালিকপক্ষ একের পর এক কর্মী ছাটাইয়ে ব্যস্ত। ফলে গত দু’দশক ধরে ধীর গতিতে সংবাদপত্র শিল্পের মরণদশা চলছে। এটি কোথায় গিয়ে দাড়ায় এ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্র জানায়, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বৃটেনের একের পর এক সংবাদপত্র বন্ধ করাকে ‘গণতন্ত্রের বিপদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলো এখন অনলাইন মিডিয়ার কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে। ‘চোখে অন্ধকার’ দেখছে মূলধারার পত্রিকাগুলো। বৃটেনের প্রভাবশালী প্রিন্ট মিডিয়া ওয়াশিংটন পোস্ট, শিকাগো ট্রিবিউন এমনকি দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টও এখন হুমকির সম্মুখিন। এসব ‘অভিজাত’ ও ‘প্রভাবশালী’ দৈনিক এখন ছাপা সংস্করণ বন্ধ করে কেবল অনলাইনে থাকার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আগামি দিনের বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করে এসব প্রভাবশালী দৈনিকের মালিকরা গ্রহণ করছে ‘সুদূরপ্রসারী কৌশল’। বৃটেনের সংবাদপত্রের বর্তমান চিত্র নিয়ে বৃটেনের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও ডিজিটাল কৌশলবিদ অ্যান্ডি ড্যাঙ্গারফিল্ড তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘বর্তমান বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই ‘জেনারেশন জেড’র।

এই জেনারেশন বা প্রজন্ম বলতে বোঝানো হয় ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০০০ সালের দিকে জন্ম নেওয়া মানুষদের। ইন্টারনেট আর অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তার লাভের সময়ের এই প্রজন্মকে নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে, তারা সংবাদপত্র পড়ে না। এমনকি পাঠককে আকৃষ্ট করতে সংবাদপত্রগুলোর আকার ছোট, প্রতিবেদন পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত করা হলেও আকৃষ্ট হচ্ছে না প্রজন্ম। এই ‘কথা’ যখন গণমাধ্যম অঙ্গনে ঘুরছে, তখন খবর মিলছে, যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলো তাদের ‘ভবিষ্যৎ’ রক্ষায় ‘জেনারেশন জেড’ বা তাদের বছর কয়েক আগের প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে অভিনব সব পরিকল্পনা নিয়ে ‘বিনিয়োগ’ করছে। সংবাদমাধ্যমে এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব থাকবে অনলাইনের হাতে। অনলাইনে যে সংবাদমাধ্যম যতো বেশি আধুনিক, সাবলীল, নজরকাড়া ও বিশ্বাসযোগ্য হবে, সেই সংবাদমাধ্যমই থাকবে নেতৃত্বের সারিতে। দৈনিকগুলোকে যদি পুরোপুরি অনলাইনে অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নামতে হয়, তাহলে পাঠক সংখ্যা বিচারে যেন তলানিতে পড়ে থাকতে না হয়, সেজন্য এই ‘বিনিয়োগ’ করছে তারা।’

গবেষণা সংস্থা রয়টার্স ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষা মতে, টেলিভিশন, রেডিও, সাময়িকীসহ ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ার ১৮-৩৪ বছর বয়সী পাঠক বেড়েছে বেশ। বিশেষত অনলাইনের অর্থব্যয়ী ‘জেনারেশন জেড’র হার বাড়ছে ক্রমে। ২০১৬ সালে যেখানে অনলাইনের অর্থব্যয়ী পাঠক বৃদ্ধির হার ছিল ৪ শতাংশ, সেখানে গত বছর ২০১৭ সালে বেড়ে যায় ১৮ শতাংশ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণমাধ্যমের ওপর ব্যাপক ক্ষোভ ঝেড়ে ‘ফেক নিউজ’ স্লোগানে প্রচারণা চালালেও অনলাইনের অগ্রযাত্রা এতোটুকুন ব্যাহত হয়নি। বৃটিশ সাংবাদিক অ্যান্ডি ড্যাঙ্গারফিল্ড এর মতে, ছাপা পত্রিকার নানা প্রলোভনের মধ্যেও বিশ্লেষকদের বিস্মিত করছে অনলাইনের পাঠক বৃদ্ধির বিষয়টি। রয়টার্স ইনস্টিটিউটসহ এ সংক্রান্ত প্রায় প্রত্যেকটি সমীক্ষাই বলছে, ব্রিটেনের দ্য টাইমস, দ্য টেলিগ্রাফ ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের মতো খ্যাতিমান দৈনিকগুলোর ছাপা সংস্করণ দুর্দশাগ্রস্ত হলেও তাদের অনলাইনের নিবন্ধিত পাঠক বা রেজিস্টার্ড পাঠক বাড়ছে। দ্য গার্ডিয়ানের মতো দৈনিকেরও নিবন্ধিত পাঠক বিগত ১২ মাসে বেড়ে ৫ লাখে পৌঁছে গেছে। ছাপা পত্রিকার বাস্তব অবস্থা আর অনলাইনের এই অগ্রযাত্রা দেখেই দৈনিকগুলোকে তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় ‘বিনিয়োগের কৌশল’ নিতে হচ্ছে।

আর এই কৌশল হলো অনলাইনের দিকে যাত্রা। জাপানি মালিকানার ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি) কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, আগে কেবল ব্রিটেনের ১৬-১৯ বছর বয়সী পাঠকরা বিনামূল্যে বা ফ্রি তাদের ওয়েবসাইট সাবস্ক্রিপশন করতে পারলেও এখন এ সুবিধা গোটা বিশ্বের টিনেজদের জন্যই করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এফটি’র বিজনেস টু বিজনেস ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাসপার ডে বোনোর মতে, কেবল ব্রিটেন থেকে ফ্রি ওয়েবসাইট ব্রাউজের যে প্রাথমিক কার্যক্রম ছিল, তার ফলাফল আমাদের অভিভূত করেছে। সেজন্য আমরা গোটা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে আমাদের ওয়েবসাইট ব্রাউজের সুযোগ করে দিয়েছি। এখন ১৫ শ’ স্কুলের ১৬ হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিনামূল্যে সার্বক্ষণিক পড়ছেন ফিন্যান্সিয়ালটাইমস ডট কম, ডেইলি মিরর, সানডে মিরর, সানডে পিপল, সানডে মেইলসহ প্রায় আড়াইশ’ সংবাদমাধ্যমের প্রকাশক কোম্পানি ট্রিনিটি মিররের মার্কেটিং ডিরেক্টর জোয়ে হ্যারিস এ বিষয়ে বলছেন, লোকজন আমাদের জিজ্ঞেস করে যে, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী পাঠকদের বিবেচনায় নিলে আমরা কোন জায়গায় আছি। আমরা বলি বয়স্কদের চেয়ে তারুন্যই আমাদের নিউজ ব্র্যান্ডকে এগিয়ে নিচ্ছে।

হ্যারিসের ভাষ্যে, তারুন্যকে কাছে টানার জন্য আঞ্চলিক ব্র্যান্ডিংকে গুরুত্ব দিচ্ছে ট্রিনিটি মিরর। কারণ, তারা মনে করে, কেউ যদি ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত হয়, তবে সে এই ক্লাবের ইতিবাচক খবর পাওয়ার জন্য বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকতার শরণাপন্ন হতে চাইবে এবং হয়তো সেই আশাবাদ থেকে আঞ্চলিক তথা ম্যানচেস্টারকেন্দ্রিক নিউজ সাইটেই বেশি ঢুকবে। এই বিষয়টি বিবেচনায় ট্রিনিটি মিররের অবস্থান সাদাকে সাদা বলা, লালকে লাল। আরেক দৈনিক দ্য সান’ যুব পাঠকদের মনোযোগ টানতে চাইছে শোবিজ জগতের সংবাদ এবং মোবাইল ভিডিও আপ করার মাধ্যমে। তাদের ওয়েবসাইটের ৫১ শতাংশ পাঠক এখন নারী এবং ৪২ শতাংশেরই বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছর। দ্য টাইমসও ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী পাঠকদের আকৃষ্ট করতে এমন নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যেটা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সববয়সী পাঠক থাকলেও ১৮-২৪ বছর বয়সী পাঠকদের টানার এই প্রতিযোগিতায় উদ্যোগী দেখা যাচ্ছে দ্য টেলিগ্রাফকেও। সম্প্রতি জার্মানির এলএমইউ মিউনিখের জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইন ও ছাপা সংস্করণ একইসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া পত্রিকাগুলোর পথচলা দ্বিধাগ্রস্তই বলা চলে। অনলাইনের কাছেই যেখানে মার খেয়ে তারা ভবিষ্যতের জন্য ‘বিনিয়োগ কৌশল’ নিয়েছে, সেখানে ছাপা সংস্করণের ‘মায়া’ ধরে রাখার কোনো মানে হয়, এ প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে এসেছে জরীপে।

এ তো গেলো বৃটেনের কথা। কানাডাতেও এখন প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা শোচনীয়। একের পর এক ছাটাই আর সংবাদপত্র বন্ধ চলছে। এ অবস্থায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী এ শিল্প বাচাঁতে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো স্থানীয় সংবাদপত্র শিল্পকে রক্ষা করার জন্য অর্থ সংগ্রহে সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছেন। কানাডার বেশিরভাগ সংবাদপত্রের মালিক দুটো সংস্থা। পোস্ট মিডিয়া এবং টরস্টার। পোস্ট মিডিয়ার ৭০ টিরও বেশি দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদ সাইট রয়েছে। আর টরস্টার হচ্ছে কানাডার সবচেয়ে বড় দৈনিক টরেন্টো স্টারের মালিক এবং অঞ্চল ভিত্তিক স্থানীয় ছোট ছোট পত্রিকাও রয়েছে। উভয় কোম্পানি থেকে ভয়াবহভাবে সাংবাদিক ছাটাই চলছে। গত কয়েক বছরে এ দু’কোম্পানি থেকে শত শত সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। এক পরিসংখ্যান মতে, গত ২০১০ সাল থেকে কানাডার সব ধরনের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ চাকরি হারিয়ে গেছে। এরই মধ্যে ২৭টি দৈনিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপনের রাজস্ব প্রায় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। অ্যাবাকাসের এক জরীপে দেখা যায়, কানাডার পছন্দসই সংবাদপত্র দেউলিয়া হয়ে যাবার পর পাঠকদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাদের চাহিদা মতোন সংবাদটি কোথা থেকে তারা খুজেঁ পাবেন? ৮৬ শতাংশ পাঠক উত্তর দিয়েছিলেন, কেন ফেসবুক এবং গুগল থেকে! ৪২ শতাংশ পাঠক ফেসবুক থেকে প্রতিদিন খবর খুজেঁ নেন। তাদের মতে, ফেসবুক নিউজ বিনামূল্যে পাওয়া যায় আর এক্সেস করা সহজ।

বর্তমান বিশ্বে সংবাদপত্রের জায়গা দখল নিচ্ছে অনলাইন সাংবাদিকতা। কি এই অনলাইন সাংবাদিকতা। এটি আসলে এমন এক ধরনের সংবাদপত্র যা ইন্টারনেটকে কেন্দ্রকরে গড়ে উঠেছে। অনলাইন সংবাদপত্র ট্র্যাডিশনাল সংবাদপত্রের মতোই। ফিচার, ছবি, অডিও, ভিডিও সব কিছুর প্রকাশ থাকে এ অনলাইন সংবাদপত্র ঘিরে। ১৯৯০ সালের দিকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (ডব্লিও ডব্লিও ডব্লিও)-নামের একটি শব্দগুচ্ছের প্রচার প্রসার বাড়তে থাকে। ক্রমশ এর জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় গিয়ে দাড়ায়, যার ফলে সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ইন্টারনেট জগত বা তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ই-মেইল থেকে গুগল, ফেসবুক এবং অনলাইন জগতে সব কিছু ঢুকে পড়ে। শুরু হয় অনলাইন সাংবাদিকতার পথচলা। তবে অনলাইন সংবাদপত্রের যে ইতিহাস জানা যায়, তাতে দেখা যায় ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ‘নিউজ রিপোর্ট’ নামে প্রথম একটি অনলাইন নিউজপোর্টাল বের হয়। তাদের সাফল্য দেখে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রগুলো অনলাইন সংস্করণ চালু করতে শুরু করে।

যুক্তরাজ্য থেকে ‘সাউথপোর্ট রিপোর্টার’ নামের একটি অনলাইন তুলনামূলকভাবে আধুনিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের সংবাদ জগতও ধীরে ধীরে অনলাইনে ঢুকে যেতে থাকে। গত ২০০৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪.কম এর যাত্রা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত এক যুগ ধরে অনলাইনের যাত্রা থেমে যায়নি। তথ্য প্রযুক্তির জোয়াওে এখন মানসম্পন্ন এবং মানহীন উভয় অনলাইন সংবাদপত্র দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাদেও এ জোয়ারের কারনে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও বাই প্রোডাক্ট হিসেবে অনলাইন ভার্সন চালু করে দিয়েছে।

এদিকে বিশ্বজুড়ে টালমাটাল প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা দেশে অনেক ধনকুবের মিডিয়া কেনা শুরু করেছেন। বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ১৯ কোটি ডলার দিয়ে ইতিমধ্যে কিনে নিয়েছেন মার্কিন ধনপতি মার্ক বেনিওফ। এই ধনকুবের সেলসফোরস ডট কম নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানির মালিক। গত ২০১৩ হাতবদল হয়েছে দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট। জানা গেছে, ২৫ কোটি ডলার দিয়ে এটি কিনে নিয়েছেন আমাজন’ এর মালিক জেফ বেজোস। একই সালে দৈনিক বোস্টন গ্লোব কিনে নিয়েছেন মার্কিন ধনপতি জন হেনরি। আটলান্টিক ম্যাগাজিনের বেশিরভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছেন অ্যাপলের প্রতিষ্ঠিাতা স্টিভ জবসের স্ত্রী লরেন পাওয়েল। লস এঞ্জেলস টাইমসের অধিকাংশ শেয়ার এখন প্যাট্রিক সুন নামের আরেক ধনপতির হাতে। সবচেয়ে মজার বিষয় যে, যে পত্রিকাগুলো অনলাইনে পাঠক আগে ফ্রি তে পড়তো এখন তা আর হচ্ছে না। সাবস্ক্রাইব করে টাকা দিয়ে এগুলো পড়তে হচ্ছে। আগামিতে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোও আর অনলাইনে ফ্রি তে পড়া যাবেনা।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.