--- বিজ্ঞাপন ---

মাহাথিরঃ দ্যা লিজেন্ড (৫ম পর্ব)

0

::কাজী আবুল মনসুর::

মাহাথিরের বই ‘দ্যা মালয় ডিলেমা’ মূলত আদীবাসিদের নিয়ে রচিত। যেখানে মালয় সমাজের অসাম্য দুর করার কথা রয়েছে। মাহাথিরের মতে, মালয় জাতি হলো মালয়েশিয়ার আদিবাসী ভূমিপুত্র। তাই তার বইতে ভূমিপুত্রদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে বেশি। মাহাথির চীনাদের সাথে মালয়েশিয়ার ভূমিপুত্রদের জিনগত বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আকাঁর চেষ্টা করেছেন একটা তুলনামূলক চিত্র। তিনি বিশ্বাস করতেন, মালয় এবং চীনাদের মধ্যে যে সব পার্থক্য রয়েছে তা তাদের জিনগত। বংশপরম্পরায় এগুলো সংক্রমিত হয়। চীনা অরিজিন মালয়েশিয়া এবং ভূমিপুত্র এ দু’য়ের দ্বন্দ্বের চিত্রটি মাহাথির বইতে তুলে ধরেন।উল্লেখ করেছেন, মালয়েশিয়া মূলত চারটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির দেশ। মালয় ভূমিপুত্রদের চেয়ে চীনা অরিজিন মালয়েশিয়ানরা সংখ্যায় কম। মালয়’রা যেহেতু মালয়েশিয়ার ভূমিপুত্র তাই তাদের সুযোগ সুবিধা বেশি হওয়া উচিত।

বৃটিশদের সহযোগিতায় চীনা অরিজিন মালয়েশিয়ানরা পুরো মালয়েশিয়ায় প্রভাব বিস্তার কওর রেখেছেন। মাহাথির এটা কোনভাবে মানতে পারেন নি। অন্য জাতির মাধ্যমে তার দেশের মূল আদীবাসি ভূমিপুত্ররা পরাধীন হয়ে থাকবে এটায় ছিল মাহাথির মূল বিবেচ্য বিষয়। তিনি তার থেকে উত্তোরন কিভাবে হবে, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা কিরূপ হবে বইতে পরিস্কারভাবে তুলে ধরেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এ বইটি মালয় সমাজের জন্য একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে প্রচারিত হলেও প্রশাসনের রোসানলে পড়েন মাহাথির। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, তিনি জাতিগত বিদ্বেষ ছড়াতে এটি রচনা করেছেন। তখন মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিলেন ‘টুংকু আবদুর রহমান’। এ বইকে কেন্দ্র করে তার দলে মাহাথিরের বিরুদ্ধে অনেকে পেছনে লাগে। ক্ষুদ্ধ মাহাথির রাস্ট্রক্ষমতায় আসীন টুংকু আবদুর রহমানের নানা কর্মকান্ডের তিব্র সমালোচনা করে একটি চিঠি লেখেন। এ চিঠির সূত্র ধরে মাহাথিরকে দল থেকে প্রথমে বহিস্কার এবং পওে গ্রেফতার করা হয়। মাহাথির তার মত ও বক্তব্য থেকে এতটুকু পিছপা হবেন না বলে জানিয়ে দেন। প্রয়োজনে মালয়’দেও জন্য জীবন প্রস্তত বলেও ঘোষনা দেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, আবদুর রহমান দলকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন। দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আবদুর রহমান কাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেশ চালাচ্ছেন তারও প্রকাশ্যে বিবৃতিতে বলেন। মাহাথিরকে নিয়ে বিব্রত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমান তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। মাহাথিরের সাথে যাদের সাথে যোগাযোগ, যাদের সাহায্যে মাহাথির তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা করে চলেছেন তাদের উপরও খড়গ নেমে আসে। ১৯৬৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মাহাথিরকে দল থেকে বহিস্কার করে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে মালয়েশিয়ার কুয়ালামামপুরে মালয়দের সাথে চীনাদের তুমুল একটি দাঙ্গা হয়। মাহাথির এ দাঙ্গার জন্য দোষ দেন আবদুর রহমানকে । মাহাথিরকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তার বিরুদ্ধে দেশে জাতিগত দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়। এ সময় নির্বাচনে মাহাথিরকে হারানো হয়। মাহাথির মাত্র ৯৮৯ ভোটে হেরে যান পার্টি ইসলাম সে (পাস) পার্টিও প্রার্থীর কাছে।
মাহাথিরকে গ্রেফতারের পর তার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হতে শুরু করে। তিনি দেখেন, তার আশেপাশে যেসব বন্ধু-বান্ধব সুবিধা নিয়েছেন তারা কেউ নেই। তার যারা শুভাকাংখি তারা কেউ আসছে না। যারা তাকে সবসময় ঘিরে রাখতেন তারাও ভয়ে ভয়ে তার কাছ থেকে দুরে। সরকারের রাজস্ব বিভাগের লোকজন ছাড়া তার কাছে কেউ আসছে না। তার রাজস্ব আয়, তার ইনকাম ট্যাক্সসহ নানা ফাঁকফোকর নিয়ে রাজস্ব বিভাগের লোকজনের বেশি আগ্রহ। মাহাথির কার্যত একা হয়ে যান। তিনি একজন ভয়ংকর, নিষিদ্ধ মানুষে পরিনত হন। এতকিছুর পরও মালয় সমাজের ভেতরে তার জন্য হাহাকার চলে। মালয় সাধারন মানুষ মাহাথিরের উপর নানা নির্যাতন নিয়ে সমালোচনা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে সবাই সোচ্চার হতে থাকেন। মাহাথির জামিনে বেরিয়ে আসার পরও অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। তিনি আবার চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দিলেন।
অনেকে মনে করেন, মাহাথির যেহেতু চিকিৎসক তাই তার উপর ডারউইনের তত্ত্বের প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ যে লড়াই করে জিতবে পৃথিবীতে বেছে থাকার অধিকার তার। হারার পাত্র মাহাথির নয়। যেহেতু তার লক্ষ্য ঠিক, তা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দিন যত গড়াতে থাকে পরিস্থিতি ততই স্বাভাবিক হয়ে আসে। দলের মধ্যে তার কিছু ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। দুঃসময়ে বেশ কয়েকজন দল নেতা তার কাছে আসতে শুরু করেন। তারা মনে করছেন, সাধারন মানুষের কাছে মাহাথিরের গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাকে এভাবে দলের বাইরে রাখলে তার নয়, বরং দলের ক্ষতি হবে। মাহাথিরের বিষয় নিয়ে তার দল ‘উমনো’তে রীতিমতো দীর্ঘ সময় ধওে তর্ক বিতর্ক চলে। চীনা অরিজিন প্রভাবিত মালয়েশিয়ার অধিবাসীদের একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল তাকে যেন দলে আর আনা না হয়। কিন্ত মালয় ভুমিপুত্র গ্রুপদের নেতারা মাহাথিরকে দলে ফিরিয়ে আনার জন্য ভেতরে বাইরে সক্রিয় হয়। দলের বেশ কয়েকজন তরুন নেতা তার সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। নানা চাপে টুংকু আবদুর রহমানও তুলনামূলকভাবে দলে দুর্বল হয়ে পড়েন। মাহাথিরের মতোন তরুন নেতৃত্বের প্রতি অনেকের সমর্থন দেখে তিনি তার কঠোর মনোভাব থেকে দুরে সরে আসেন। তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দলের ভেতরে রীতিমতো তোলপাড় চলে। বার বার বৈঠক হলেও এক পর্যায়ে তা ভন্ডুল হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত দলের সংখ্যগরিষ্ট সিনিয়র নেতা নানা চাপের কারনে তাকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। নিষিদ্ধ থাকার তিন বছর পর ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ তিনি দলে ফেরেন। তার জন্য দলের তরুন নেতৃত্ব সবসময় সোচ্চার ভুমিকা রেখেছিলেন। মাহাথির তরুনদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। তিনি মনে করলেন, তরুনরাই আগামী দিনের নতুন মালয়েশিয়া গঠন করবেন। তাই দলে তিনি তরুনদের সমর্থন পান ব্যাপকভাবে। দলের সুপ্রিম আউন্সিলে তরুনদের সমর্থন নিয়ে মাহাথির জায়গা কওর নেন। তিনি বুঝাতে চেষ্টা করেন, মালয়রা মালয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ট ভুমিপুত্র। তাদের বাদ দিয়ে কোন কিছুই হবে না। অসাম্য দুর করে মালয়েশিয়াতে ভুমিপুত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মাহাথিরকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয় নি। সামনে শুধু সাফল্য আর সাফল্য।… (চলবে)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.