--- বিজ্ঞাপন ---

মালয়েশিয়ায় এখন ১৬ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক

0

কাজী আবুল মনসুর::‘আদম ব্যবসায়ীর হাত ধরে মালয়েশিয়ায় গিয়ে টানা তিন দিন না খেয়ে জঙ্গলে পড়েছিলাম। পরে সেখান থেকে পুলিশের ভয়ে পালাই। ভাগ্যক্রমে এক মালয় নাগরিকের সহযোগিতায় প্রাণে বেঁচে যাই। তিনি আমাকে দুই দিন আশ্রয় দেন। পরে টানা পাঁচ মাস কাটে পালিয়ে পালিয়ে। কোনো রকমে রেস্টুরেন্টের কাজ শিখে কাজে লেগে যাই। পরিশ্রম আর সীমাহীন কষ্টের পর এখন আর আপসোস নাই। দেশে বাবা-মায়ের কাছে মাসে ২০ হাজার করে টাকা পাঠাতে পারি। এক চীনা নাগরিকের রেস্টুরেন্টে কাজ করে যাচ্ছি। মাসে বেতন পাই ১৮০০ রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি ৩৬ হাজার টাকার সমান।’

কথাগুলো বলছিলেন যশোরের ফরহাদ হোসেন। এখনো বৈধতা না পেলেও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার কায়দাকানুন শিখে গেছেন। মালয়েশিয়ার পুলিশকে কীভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে হয় তাও জানেন। তার মতো লাখ লাখ বাংলাদেশি এখানে কাজ করছেন। যাদের কোনো বৈধ কাগজ নেই। তারাও দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নানা গুজবে নির্ঘুম রাত কাটে এ মানুষগুলোর।

মালয়েশিয়ার বিলাসবহুল মার্কেট ‘মাই ডিন’র নিচে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ব্যাপারে কথা হচ্ছিল ফরহাদের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন, আমাদের কথাগুলো লিখে বাংলাদেশ সরকারকে জানান। সরকার যেন মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের বৈধ করে নেয়। পাঁচ বছর ধরে স্টুডেন্ট ভিসায় কাজ করে যাচ্ছেন ঢাকার বশিয়ুর সুমন। তিনি জানান, বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বৈধ ও অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে ১৬ লাখেরও বেশি। এ বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশির মধ্যে ১০ লাখই দেশে টাকা পাঠায়। যার পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকারও বেশি। অবাক করা এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে। তবে যারা অবৈধ রয়েছেন তাদের টাকার সিংহভাগই লেনদেন হয় হুন্ডির মাধ্যমে। কারণ বৈধতা নেই বলে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর কোনো রাস্তাও তাদের থাকে না।

মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে ‘বুকিত বিনতাং’ এলাকায়। প্রায় প্রতিটি দোকান, রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আনাগোনা নজরে পড়ে। এখানে বহুতল ভবন বা রাস্তার উন্নয়নে যে কর্মযজ্ঞ চলছে তাতেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি।

অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক যেখানে কাজ করেন সেখানেই থাকেন। নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে চলেন সবাই। মাস শেষে দেশে টাকা পাঠানোর জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট মানুষ। তার হাতে মালয়েশিয়ার টাকা দিলেই কিছু কমিশন কেটে রেখে পুরো টাকাটা বাংলাদেশে অন্য একজন বিকাশ বা নানান মাধ্যমে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে নিজের পরিবারের সদস্যদের নানা কৌশলে নিয়ে আসেন। অনেকে ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে কাজে যোগ দেন। এখানকার উদ্যোক্তারা এখন চীনা বা ভারতীয় শ্রমিকদের চেয়ে বাংলাদেশিদের পছন্দ করেন।

মালয়েশিয়ার উন্নয়নে যে বিশাল নির্মাণযজ্ঞ চলছে তাতে আরো প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন হবে বললে কম হবে। বর্তমানে মালয়েশিয়ার সার্বিক উন্নয়নের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আরো ৩৫ শতাংশ কাজ তাদের শেষ করতে হবে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে। মালয়েশিয় সরকার ‘ভিশন ২০২০’ নামে যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে তা নিজের দেশের শ্রমিক দিয়ে হবে না। আনতে হবে বিশাল পরিমাণের বাইরের দেশের শ্রমিক। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

শুধু শ্রমিক নয়, অনেক বাংলাদেশি ব্যবসা করে এখন বিশাল সম্পত্তি ও শত শত কোটি টাকার মালিক। অসংখ্য বাংলাদেশি মালয় নারীকে বিয়ে করে স্থায়ী হয়েছেন। দিয়েছেন নানা প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়ার বুকিত বনিতাংয়ের রেস্টুরেন্ট তাজের মালিক মীর আবদুর রহমান রুমি। বাড়ি সন্দীপ। তিনি ১৫ বছর আগে মালয়েশিয়ায় এসেছেন। বিয়ে করেছেন মালয় নারীকে। দুজনে মিলে এখন রেস্টুরেন্ট চালান। আলাপকালে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। সরকার একটু চেষ্টা করলে এখানে আরো শ্রমিক পাঠাতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি খাবারের ব্যাপারে শুধু বাংলাদেশিরা নন, বিভিন্ন দেশের নাগরিকদেরও এখন পছন্দ।

তবে বাংলাদেশিদের নিয়ে খারাপ উদাহরণও কম নেই। মালয়েশিয়ার ট্যাক্সিচালক আহমেদ হুমায়ন আজমি বলেন, বাংলাদেশিদের পছন্দ করেন মালয়েশিয়ার নাগরিকরা। তবে তাদের দুর্বলতার সুযোগে অনেকে পারিবারিকভাবে নানান সমস্যাও তৈরি করেন। তা ছাড়া আরো একটি বিষয় এখন মালয়েশিয়া প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। তা হলো, দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জঙ্গি কানেকশন। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার ‘সুবান জায়া’র মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বাংলাদেশি ছাত্রের জঙ্গি কানেককশন পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। সম্প্রতি পুলিশ একজন বাংলাদেশিসহ বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে ধরার পর একাধিক পত্রিকা ফলাও করে প্রচার করেছে। তাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি ছাত্ররা নজরদারিতে থাকেন। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। গুটিকয়েক বাংলাদেশির নেতিবাচক তৎপরতা পুরো বাংলাদেশি সমাজকে তোপের মুখে ফেলছে। বেশির ভাগ বাংলাদেশি চাইছে এসব তৎপরতা বন্ধ হোক। কারণ ঘটনার পরিমাণ যদি বেড়ে যায় তাহলে মালয়েশিয়ায় থাকা লাখ লাখ বাংলাদেশির ওপর শুধু আঘাত আসবে না, চিরতরে সে দেশে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.