--- বিজ্ঞাপন ---

ইমরান খানের সফল কূটনীতি, মার্কিন এফ-১৬ জঙ্গী  বিমান সহায়তা পুনরায় শুরু (কাশ্মীর পর্ব-৪)

0

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতিসংঘের সর্বশেষ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ২৭ সেপ্টেম্বর কাশ্মীর প্রসঙ্গে তার ভাষণ ও উপস্থাপন ভঙ্গীতে ইতিমধ্যেই সবার নজরে এসেছেন। কূটনীতিতেও তিনি পিছিয়ে নেই। বিশ্বের শক্তিমান দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশেষে বৈরী দেশ ইরানের সাথে মধ্যস্থতায় তাকেই বেছে নিলেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন সৌদি আরবের সাথেও ইরানের সম্পর্ক জুড়তে তিনি এখন ঝটিকার সফরে রয়েছেন। ১৩ অক্টোবর তিনি ইরান সফরে সেদেশের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি ও ধর্মীয় সুপ্রীম নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনীর সাথেও দেখা করেছেন। ইমরানের সমঝোতায় তাদের সম্মতিও লক্ষ্য করা গেছে। এরপর তিনি সৌদি আরব যাবেন কথা রয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানের প্রধান মিত্র বৃহৎশক্তি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জেনপিং তার সাথে সাক্ষাতের দুদিন পর গত শনিবার ভিন্ন মতের  দেশ ভারতের মোদির সাথে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক সেরেছেন। কূটনৈতিক মহল মোদী-শি জিনপিং সাক্ষাতকে দুদেশের বাণিজ্য সম্পর্কের বিষয় প্রাধান্য পেলেও চীনের প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দুদিন আগের সফরটি মোদিকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলেননি বলে জানা গেছে। দক্ষিণ ভারতের মামল্লাপুরমে এ বৈঠককে ভারতের পক্ষ থেকে দুদেশের সম্পর্কে এক নতুন ধারা রচনা বলছে ভারত। তবে দিল্লীর সাথে বাণিজ্য ঘাটতি যে অনেক সেটা হিসাব দেখলেই বুঝা যায়।ভারত চীন থেকে আমদানী করে ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। আর চীনে তার রফতানী মাত্র ১৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কেবল ভবিষ্যৎই বলবে পাকিস্তান ও চীনের বৈরী দেশ ভারতের সাথে বেইজং এর সম্পর্ক কতটা উন্নতি হতে চলেছে। শি জিনপিং শুক্রবার বিকেলে এয়ার চায়না বোয়িং ৭৪৭ বিমানে চড়ে ভারতে আসেন। তাঁকে চেন্নাইয়ে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ই কে পলানিস্বামী, সেখানকার রাজ্যপাল বানওয়ারিলাল পুরোহিত, তামিলনাড়ু বিধানসভার অধ্যক্ষ পি ধনপাল এবং চীনে ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম মিস্রি। চীনের প্রেসিডেন্টকে সম্মান জানাতে একটি সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং শি জিনপিংয়ের মধ্যে প্রথম অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ সম্মেলন গত বছর ডোকলামে । দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ৭৩ দিনের উত্তেজনার কয়েক মাস পরে, চীনের হ্রদ শহর উহানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এর তিনদিন আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বৈঠকের পর এই সফর আসেন চীনের প্রেসিডেন্ট। তার আগে প্রেসিডেন্ট শি ও ইমরান খানের বৈঠকের শেষে একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান “রাষ্ট্রসংঘের সনদ, রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রাসঙ্গিক প্রস্তাব এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে” যথাযথ ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা উচিত। এই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ভারত জানায়, “চীন ভারতের অবস্থান সম্পর্কে ভালভাবেই জানে এবং “অন্য কোনও দেশের ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত নয়”। সরকার নিজের অবস্থানে অনড় যে জম্মু ও কাশ্মীর পদক্ষেপ এবং লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে পরিণত করার বিষয়টি একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়।

পাকিস্তানে  মার্কিন এফ-জঙ্গী  বিমান সহায়তা পুনরায় শুরু

গত ২৬ জুলাই ইমরান খানের ওয়াশিংটন সফরের ৩ দিন পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের কারিগরী সহায়তার জন্য ১২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের  কারিগরী সহায়তা কার্যক্রম ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর ফরেন মিলিটারি সেলস এর আওতায় টিএসটি (টেকনিক্যাল সিকিউরিটি টিম)  পাকিস্তানের সকল এফ-১৬ জঙ্গী  বিমানে এ সহায়তা দেয়া হবে।  টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রোগ্রাম দিচ্ছে । দীর্ঘদিন এ সহায়তা বন্ধ থাকায় পাকিস্তানের কাছে থাকা এফ-১৬ জঙ্গী বিমান প্রায় অচল হতে চলেছিল। আন্তর্জাতিক মহলে ক্রিকেটার হিসেবে সুপরিচিত ইমরান খানের যাদুতে অবশেষে দু’দেশের মধ্যে  বরফ গলতে শুরু করেছে।

ইমরান-ট্রাম্প ৪৭ মিনিটব্যাপী নজিরবিহীন প্রেস ব্রিফিংকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৭০ বছরের কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের মধ্যে মধ্যস্থতাকরতে প্রস্তাব দেন। এসময় তিনি মোদি তাকে এব্যাপারে আগাম অনুরোধ জানিয়েছে বলেন। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় মোদি নাকি ট্রাম্পকে এটা বলেননি। ইমরানের এ সফল সফরকে ভারত ভাল চোখে দেখেনি। এরই মধ্যে এফ-১৬ সাপোর্ট প্রোগ্রামের জন্য মার্কিন সহায়তা ভারতের জন্য অশনি সংকেত এর মত। মার্কিন প্রভাবশালী  থিংক ট্যাংক  উড্রো উইলসন সেন্টারের  এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর ও দক্ষিএশিয়ার সিনিয়র এসোসিয়েট  মাইকেল কুজারম্যান  পাকিস্তানের ডন প্রত্রিকায় ইমরান খানের সফরের মুল্যায়ন নিয়ে একটি কলাম লেখেন। কলামের শিরোনাম দেন ‘তিনি আসলেন দেখলেন জয় করলেন’।

এটি প্রকাশিত হয় ইমরান খানের সফরের শেষে। ইমরান সফর করেন ২২ থেকে ২৪ জুলাই ৩ দিন । কলামটি প্রকাশিত হয় ২৫ তারিখে। মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে পুনরায় সামরিক সরঞ্জাম বিক্রী ও সহায়তা করবে এমনটি  ইমরান খানের সফরের ১০ দিন আগেই শীর্ষ একজন সামরিক জেনারেলের বক্তব্যে পরিস্কার হয়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ নমিনি জেনারেল মাইক মিলি মার্কিন সিনেটের আমর্ড সার্ভিসেস কমিটির সম্মুখে রাখা বক্তব্যে পাকিস্তানের সাথে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করার সুপারিশ করেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এফ-১৬ নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতকে নাখোশ করার নাটক আবার মঞ্চস্থ হতে চলেছে। ভারতের জন্য খবরটি সুখকর নয়। এদিকে, ভারত পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক সহায়তা কর্মসূচী পুনরায় চালু করায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত ১ আগস্ট ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় সাংবাদিক রেজাউল এইচ লস্কর  পাকিস্তানে পুনরায় মার্কিন অত্যাধুনিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমান সহায়তা কর্মসূচী চালু সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের  বৈঠকের পরপরই এ সামরিক চুক্তিটি  তাৎপর্যবহ উল্লেখ করেন। তাঁর প্রতিবেদনে বলা হয়, আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানে স্থগিত রাখা মার্কিন সামরিক সাহায্য কর্মসূচী পুনরায় চালু করতে যাচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসন গত বছরের জানুয়ারীতে পাকিস্তান সন্ত্রাস দমন কর্মসূচীতে যুক্তরাষ্ট্রকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছেনা মর্মে অভিযোগ এনে দেশটিকে দেয়া বার্ষিক সামরিক সাহায্য স্থগিত ঘোষণা  করে।   আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরাতে পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবানদের বৈঠকে রাজী করানোর বিনিময়ে মূলত: ইসলামাবাদকে পুরস্কার হিসেবে আবারও সামরিক সহায়তা কর্মসূচী চালু করছে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাভিশ কুমার নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিং এ জানান যে,  পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক সহায়তা পুনরায় চালু করায়  এবং এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রোগ্রামের জন্য ১২৫ মিলিয়ন ডলারের যে ঘোষণা ট্রাম্প প্রশাসন দিয়েছেন এ চুক্তিতে  নয়াদিল্লী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। আমাদের উদ্বেগের কথা আমরা নয়াদিল্লীতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সে দেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমেও গভীর উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে মার্কিন সামরিক সদর দপ্তর পেন্টাগন পাকিস্তানকে প্রস্তাবিত এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের সহায়তা কর্মসূচী প্রদানের ব্যাখ্যায় বলা হয়, পাকিস্তান সে দেশে আগে থেকে ক্রয় করা এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের জন্য  চলমান কারিগরী সহায়তা চেয়েছে অর্থ্যাৎ টেকনিক্যাল সাপোর্ট চেয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতেই মার্কিন সরকার এই  ১২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের প্রস্তাবিত চুক্তির ঘোষণা দেয় । পেন্টাগনের পক্ষ থেকে এব্যাপারে আরও বলা হয়েছে যে, এতে করে ঐ অঞ্চলে আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যে কোন পরিবর্তন আসবেনা।এমনিতেই ইমরান খানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাশ্নীর নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব করেন। এবং এজন্য নাকি ভারতের মোদি ইমরান খানের সফরের ঠিক আগের সপ্তাহে ট্রাম্পকে এ মধ্যস্থতার অনুরোধ করেছিলেন। ভারতের পক্ষ থেকে এর পরপরই বিবৃতিতে বলা হয় প্রধানমন্ত্রী মোদি নাকি এ ধরণের কোন প্রস্তাব নিয়েই আলোচনা করেননি। এ নিয়ে যখন  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে কিছুটা বিতর্ক চলছে ঠিক তখনই পাকিস্তানকে বহুদিন স্থগিত রাখা উঠিয়ে নিয়ে পুনরায় এফ-১৬ জঙ্গী  বিমান সহায়তার বিষয়টি ভারতীয় মহলে উনুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মত ঘটনা। ভারত কখনোই চায়না মার্কিনীরা পাকিস্তানকে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দিক। বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানীকারক দেশ হচ্ছে ভারত (স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইন্সটিটিউট, ২০১৯)। (চলবে)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.