--- বিজ্ঞাপন ---

খনিজ সম্পদে ভরা বঙ্গোপসাগর

কাজে লাগছে না গবেষণা

0

অস্ট্রেলিয়ার ইস্ট কোস্ট, এনিয়েব্বা, ভারতের কুইলন, আমেরিকার ফ্লোরিডা, নিউজার্সি, শ্রিলংকার পালমুড্ডি, কলম্বো, ব্রাজিলের এসপ্রিটো, সান্তো, রিউ ডি জেনেরিউ, সাউথ আফ্রিকার রিচার্ড বে এবং তানজানিয়ার দার-এ-সালাম এর চেয়ে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বাংলাদেশের কক্্রবাজার সমুদ্র সৈকত। কারণ বিশ্বে উল্লেখিত সমুদ্র সৈকতগুলোর সঙ্গে নাম এসেছে কক্সবাজারের। বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে দফায় দফায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বের উপরোক্ত সৈকত গুলোতে যে মূল্যবান খনিজ রয়েছে তার চেয়েও বেশি রয়েছে বাংলাদেশের ১ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ২শ’ নটিক্যাল মাইলের বঙ্গোপসাগরে। সাগরের সৈকতে এবং সাগরের তলদেশের খনিজ সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন দেশ উপকৃত হলেও আধুনিক যন্ত্রপাতি ও গবেষণার অভাবে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদগুলোর হদিস মিলছে না। বিশ্বের বিভিন্ন খনিজ গবেষক এ সম্পদের কথা জানলেও বাংলাদেশ এর অর্থনৈতিক মুল্য এখনো বুঝতে পারেনি। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন সৈকত থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে এসব খনিজ। কাজে লাগছে বিমান প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান, রেডিও শিল্প, আনবিক যন্ত্রপাতি তৈরি, রাসায়নিক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান ধাতব খনিজ সম্পদ ও তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মজুদ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন পরিবেশ ও আনবিক শক্তি বিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে মূল্যবান এই খনিজ পদার্থের কথা বলা হয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ৫ মিলিয়ন টন বলে ইতিপূর্বে লন্ডন ভিত্তিক জার্নালে উল্লেখ করাও হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যার বাজার মূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবের কারণে এই সমস্ত তেজষ্ক্রিয় ও ধাতব খনিজ মূল্যবান পদার্থের আহরণ সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা এই মূল্যবান সম্পদ আহরণে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। কিন্তু উদ্যোগের অভাবে বারে বারে পিছিয়ে এগুলো আহরণের কাজটি। তারপরও গবেষণার শেষ নেই।
অবশ্য বর্তমান সরকার এ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে। বঙ্গোপসাগরে বিদ্যমান খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে সরকার ‘ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফিক সেন্টার’ নামের যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থাকে নিয়োগ করতে যাচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সংসদীয় কমিটিতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সাগরের সৈকতে এবং সাগরের তলদেশে মূল্যবান সম্পদ আহরনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরও আগ্রহী। চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল জুলফিকার আজিজ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাথে এক বৈঠকে উল্লেখ করেন, আমাদের সাগরের তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে তা খুজে বের করার জন্য বন্দও সব রকম সহযোগিতা করবে। মূল্যবান এ সম্পদ উদ্ধার করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
এ ব্যাপাওে সরকারও আগ্রহী বলে উল্লেখ কাো অর্থমন্ত্রী মুস্তাফা কামাল সংসদীয় কমিটির সভায় উল্লেখ করেন,‘ভারত ও মিয়ানমার ইতিমধ্যে এমন প্রাকৃতিক সম্পদেও খোঁজ পেয়েছে। তিনি বলেন, সাগরের তলদেশে গ্যাস হাইড্রেট ঘিরে গবেষণা করা হবে। এখানে মিথেনের অস্তিত্ব রয়েছে যা প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উৎস।’
আনবিক কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার ও টেকনাফ সৈকতে প্রথম খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৬৮ সালের দিকে। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের একটি রিপোর্টে এই খনিজ সম্পদের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন। মূল্যবান সম্পদের মধ্যে রয়েছে ইলমেনাইট, মেগনেটাইট, মোনাজাইট, র্যুটাইল, জিরকন ইত্যাদি। সন্ধান পাবার দীর্ঘ বছরের পর বছর অতিবাহিত হওয়া সত্তে¡ও এই মূল্যবান সম্পদ আহরণের কোন চেষ্টা করা হয়নি। বাংলাদেশের আণবিক শক্তি কমিশন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে কক্সবাজারে বিএসইসি নামের একটি এক্সপ্লোয়েটেশন সেন্টার স্থাপন করে। ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে আণবিক শক্তি কমিশন একটি জরিপের মাধ্যমে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে টেকনাফ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিপুল পরিমাণ বালি, মাটি মিশ্রিত ইউরেনিয়ামসহ কয়েকটি মূল্যবান ধাতুর সন্ধান লাভ করে। প্রযুক্তিহীনতার কারণে বিএসইসি ঐ সব ধাতুকে পৃথক করতে পারছে না।
বাংলাদেশের এসব প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা অব্যাহত থাকলে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রেডিও এ্যাকটিভিটিতে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন বিভিন্ন সময় কয়েকদফা প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে কক্সবাজারের সৈকত এলাকাসহ মহেশখালী দ্বীপে জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, র্যুটাইল, রেডিয়াম, থোরিয়াম, পটাশিয়ামসহ বিভিন্ন প্রকারের ধাতব ও তেজষ্ক্রিয় পদার্থের বিপুল পরিমাণ মজুদের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রাপ্ত পদার্থগুলোর মধ্যে জিরকনের পরিমাণ ১ কেজিতে ৬৮৪৯ বেকেরেল; যার রেডিয়েশনডোজ হলো প্রতি ঘন্টায় ৩ দশমিক ৬৪ মাইত্রেক্রা গ্রে. ইলমেনাইট রয়েছে প্রতি কেজিতে ৩৪২ বেকেরেল, যার রেডিয়েশন ডোজ শূন্য দশমিক ৪১ মাইক্রো গ্রে, গারনেটের পরিমাণ প্রতি কেজিতে ৩৯৫১ বেকেরেল এবং রেডিয়েশন ডোজ হলো ৬ দশমিক ৯৩ মাইক্রো গ্রে, রুটাইলের পরিমাণ প্রতি কেজিতে ৬৬৪৩ বেকেরেল, যার ডোজের পরিমাণ ১০ দশমিক ৫৭ মাইক্রো গ্রে।
সূত্র মতে, ধাতব পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণ ইউরেনিয়াম। মূল্যবান এই খনিজ পদার্থটির সঙ্গে মিশে আছে মোনাজাইট। এই দুটি পদার্থ আণবিক বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহƒত হয়। জিরকন ফাউন্ড্রি ও সিরামিক শিল্পে, র্যুটাইল ওয়েল্ডিংসহ বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে, ইলমেনাইট রড প্রস্ততিতে, গারনেট বিভিন্ন মেটালে ব্যাপকভাবে ব্যবহƒত হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক জার্নালের রিপোর্টে যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম রয়েছে তার মাত্রা শূন্য দশমিক এক থেকে শূন্য তিন ভাগ এবং থোরিয়ামের পরিমাণ ৫ থেকে ৭ ভাগ বলে উল্লেখ করে এই ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ও আণবিক বোমা তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য বলে মন্তব্য করা হয়।
সূত্র মতে জানা গেছে, কক্সবাজার সৈকতের মূল্যবান খনিজগুলো সৈকতের পর্যটন ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখে সংগ্রহ করা যাবে। সমুদ্রের কয়েক মাইল এলাকা জুড়ে চিহ্নিত এ সমস্ত খনিজ পদার্থ আলাদা আলাদাভাবে পৃথক করা ব্যয় সাধ্য ব্যাপার। বাংলাদেশের বিভিন্ন দ্বীপে থাকা এবং সৈকতের পাওয়া মোনাজাইট দিয়ে আকাশ ও পৃথিবী পথের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত স্থাপনা তৈরি করা যায়। কিন্তু উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবের কারণে বর্তমানে এখানকার খনিজগুলোর কিছু খুচরাভাবে বিক্রি হচ্ছে। দেশে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ থাকার অস্তিত্বের কথা অনেক আগে প্রচার হলেও এই ব্যাপারে কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দেশের মাটিতে ও সমুদ্রগর্ভে মিশ্রিত এই ধাতবগুলোর উৎকর্ষতা পৃথিবীর অন্য ধাতবগুলোর চেয়ে অধিকতর উন্নত বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যাপকভাবে এই ধাতব আহরণ করে বিক্রি করতে পারলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের এর মূল্য নির্ধারণ না হলেও এগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত বিদেশীদের দৃষ্টিতে এই খনিজ ও তেজষ্ক্রিয় পদার্থের পরিমাণ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ####২৫.১১.১৯

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.