--- বিজ্ঞাপন ---

ভারত-পাকিস্তান নীরবে শক্তি বাড়াচ্ছে

কাজী আবুল মনসুর

0

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক এখন অনেকটা থমথমে। উভয়পক্ষ নীরবে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। এ সম্পর্ক কোনদিন জোড়া লাগবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। দু’দেশ পারমানিবক শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়ে রেখেছে। পরিস্থিতি এমন, কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। দুই দেশের সীমান্তে কোন না কোনভাবে উত্তেজনা জিইয়ে থাকে। মাঝে মাঝে অবস্থা এমন হয় যে, যে কোন মুহুর্তে লেগে যেতে পারে যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধ বাঁধা কি এতটা সহজ? উত্তরে বলা যায়; দক্ষিণ এশীয় দুটি দেশ পরমাণু বোমায় সজ্জিত। ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধ হলে ২০০ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে; এমনকি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মানবসভ্যতা। সীমিত পর্যায়েও পারমাণবিক অস্ত্রের লড়াই হলে বিশ্বের আবহাওয়ামন্ডলের ব্যাপক ক্ষতি ও শস্যক্ষেত্র ধ্বংস হবে। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব আশংকার কথা উঠে আসে। ২০১৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউকিয়ার ওয়্যার এবং ফিজিশিয়ানস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নামের দুই সংগঠন।
জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে পাকিস্তানে সেনা শক্তি বেশি হলেও ভারত সামরিক দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের লোক সংখ্যা প্রায় ১২৫ কোটি। এ বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে তাদের সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত সেনা রয়েছে সোয়া ১৩ লাখ। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল রয়েছে আরো ২১ লাখ ৪৩ হাজার। অন্যদিকে পাকিস্তানের লোকসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। নিয়মিত সেনা রয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল রয়েছে আরো ৫ লাখ ১৫ হাজার।
ভারতের সর্বমোট বিমান রয়েছে দুই হাজার ৮৬টি। এছাড়াও দেশটির রয়েছে ৬৪৬টি হেলিকপ্টার, ১৯টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ৮০৯টি নির্ধারিত পাখাযুক্ত অ্যাটাক বিমান, ৬৭৯টি যুদ্ধ বিমান, ৩১৮টি প্রশিক্ষণ বিমান এবং ৮৫৭টি ট্রান্সপোর্ট বিমান। দেশটির ৩৪৬টি ব্যবহারযোগ্য বিমানবন্দর রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সব মিলিয়ে ৯২৩টি বিমান রয়েছে। এছাড়াও দেশটির ৩০৬টি হেলিকপ্টার, ৫২টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ৩৯৪টি নির্ধারিত পাখাযুক্ত অ্যাটাক বিমান, ৩০৪টি যুদ্ধ বিমান, ১৭০টি প্রশিক্ষণ বিমান এবং ২৬১টি ট্রান্সপোর্ট বিমান রয়েছে। দেশটির ১৫১টি ব্যবহার যোগ্য বিমানবন্দর রয়েছে।
এদিকে ভারতের হাতে রয়েছে ছয় হাজার ৪৬৪টি ট্যাংক, ছয় হাজার ৭০৪টি আর্মার্ড ফাইটার ভেহিক্যাল, ২৯০টি সেল্ফ প্রপেল্ড গান, সাত হাজার ৪১৪টি টানা কামান এবং ২৯২টি মাল্টিল লাঞ্চার রকেট সিস্টেম। পাকিস্তানের হাতে রয়েছে দুই হাজার ৯২৪টি ট্যাংক, দুই হাজার ৮২৮টি আর্মার্ড ফাইটার ভেহিক্যাল, ৪৬৫টি সেল্ফ প্রপেল্ড গান, তিন হাজার ২৭৮টি টানা কামান এবং ১৩৪টি মাল্টিপল লাঞ্চার রকেট সিস্টেম।
ভারতের রয়েছে ৩৪০টি মার্চেন্ট মেরিন জাহাজ। প্রধান সমুদ্রবন্দর রয়েছে সাতটি। এছাড়া দুটি বিমানবাহী ক্যারিয়ার, ১৪টি সাবমেরিন, ১৪টি ফ্রিগেট, ১০টি ডেস্ট্রয়ার, ২৬টি কর্ভাটি, ছয়টি মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট এবং ১৩৫টি পেট্রোল ক্রাফট রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের রয়েছে ১১টি মার্চেন্ট মেরিন জাহাজ। প্রধান সমুদ্রবন্দর রয়েছে দুটি। এছাড়া পাঁচটি সাবমেরিন, ১০টি ফ্রিগেট, তিনটি মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট এবং ১৩৫টি পেট্রোল ক্রাফট।
তবে পারমাণবিক ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে পাকিস্তান। কিছু দিন আগে প্রকাশিত একটি মার্কিন রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের ১২০টিরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এ হারে পারমাণবিক অস্ত্র বানানো বাড়তে থাকলে দেশটি আগামী এক দশকের মধ্যে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকার করবে। এই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে অতিক্রম করতে না পারলেও চীন, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের আছে ১০০টির কাছাকাছি পারমাণবিক অস্ত্র। ইউরেনিয়ামের সমৃদ্ধ মজুত থাকায় ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে পাকিস্তান।
সে হিসেবে চির বৈরী প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব থাকলেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। অবশ্য পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কে উত্তেজনার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ থেকে প্রায়ই এ ধরনের উত্তেজনা চলে আসছে; এক ধরনের নিয়মে পরিণত হয়েছে। তাই বলে, উরিতে সেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলায় ১৮ সেনা নিহতের বদলা না নিয়ে ছাড়বে না ভারত। এই প্রতিশোধটা হবে, কুটনৈতিক পর্যায় থেকে। ভারতীয় কর্মকর্তারা মুখে যুদ্ধের কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। এমনকি যত দিন যাচ্ছে যুদ্ধের সম্ভাবনা তত দূরে সরে যাচ্ছে। ভারত বরঞ্চ এখন চাইছে কাশ্মীরের এই ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানকে ক’টনৈতিকভাবে একঘরে করে ফেলতে।
তবে এক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামনেও খোলা রয়েছে কুটনৈতিক পথ। চীন ও আফগানিস্তানের মত প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট করতে পারে পাকিস্তান। এমনকি তারা তুরস্কসহ মুসলিম আরো কিছু দেশের শরণাপন্ন হতে পারে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান এখন আন্তর্জাতিক ফোরামে বোঝাতে চাইবে যে, কাশ্মীরে ভারত যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তার থেকে দৃষ্টি ফেরাতে উরির এই ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ভারত তা নিয়ে এত চেঁচামেচি করছে। সেটাই হতে পারে পাকিস্তানের কৌশল। তবে পাকিস্তানের ভেতরে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠির অবস্থান এবং তৎপরতা একটি বাস্তবতা। আর সে কারণে আান্তর্জাতিক মহলকে পাশে পেতে বেগ পেতে হবে পাকিস্তানকে।
এদিকে কাশ্মিরের যে সংকট তা ভারত আখ্যায়িত করছে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে। কিন্তু কাশ্মির ইস্যুটির একটা ভিন্ন এঙ্গেল রয়েছে। কাশ্মিরে লাইন অব কন্ট্রোল রয়েছে দেশ দুটির অধিকারে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সকল সমস্যারই সমাধান দরকার।
এদিকে ভারত শাসিত কাশ্মীরের উরিতে বিগত হামলার এক সপ্তাহ পর ভারতীয় কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছিল, পাকিস্তানের সাথে করা চুক্তি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে না এলেও সিন্ধু অববাহিকার জলকে ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে’ ব্যবহার করবে তারা। সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব- এই তিনটি নদীর জলকে কীভাবে ভারত আরও বেশি ব্যবহার করতে পারে সেই রাস্তা খতিয়ে দেখছে ভারত। বর্তমান চুক্তি অনুসারে পাকিস্তান এই তিনটি নদীর জলের সিংহভাগ পেয়ে থাকে। কিন্তু ভারত বলছে, পারস্পরিক আস্থা না-থাকলে সেই চুক্তি বজায় রাখা সম্ভব নয়। এছাড়া ভারত-পাকিস্তানের এই চুক্তি জম্মু ও কাশ্মীরেই সমর্থন পায়নি। কারণ তারা মনে করে এই চুক্তির ফলে তারা তাদের ন্যায্য পানির হিস্যা পায়নি। এখন এই বাড়তি পানি সেখানে ব্যবহার করে ভারত যেমন সেই ক্ষোভ সামাল দিতে চাইছে, তেমনি পাকিস্তানকেও চাপে রাখতে চাইছে।
এদিকে পাকিস্তান বালুচসহ অজস্র জনগোষ্ঠীর ওপর পাশবিক নির্যাতনে অভ্যস্ত। এ প্রেক্ষিতে ভারত ঘোষণা দিয়েছে, তারা বালুচ বিদ্রোহী নেতাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে। এর মাধ্যমে গত কিছুদিন ধরে চীনের বিরুদ্ধে দেওয়া ভারতের নানা হুমকিও একটা পরিণতি পেল। কারণ চীনা বিনিয়োগে চীন-পাকিস্তান বাণিজ্যিক করিডর যাচ্ছে বালুচের মধ্য দিয়ে, বালুচরা যার বিরোধিতা করছে। প্রসঙ্গত চীনের সঙ্গে ভারতের সা¤প্রতিক উত্তেজনা অনেকদূরই এগিয়েছে। ভারতীয় সীমানায় চীনা বাহিনীর ঢুকে পড়া, সীমান্ত অঞ্চলে চীনের নব উদ্ভাবিত যুদ্ধ বিমান স্টিলথ জেড ফাইটার মোতায়েন; জি-২০ সম্মেলনে চীনকে আমেরিকা-ভারতের হুশিয়ারি এবং ফ্রান্স থেকে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান ও মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি চ’ড়ান্তের মাধ্যমে চীনের বিমান বাহিনীকে চোখ রাঙানি- এভাবেই এগুচ্ছে ভারত-চীন দ্বৈরথ। সবমিলিয়ে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত বেশ বেকায়দাতেই পড়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- ভারত এবং পাকিস্তান উপনিবেশ সুলভ সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত; সেটা এই দুই দেশেই অব্যাহত সন্ত্রাসী হামলা ও সহিংসতার উৎস। যে গণভোটের প্রতিশ্রæতি কাশ্মীরের জনগণকে নেহেরু দিয়েছিলেন, সেটা বাস্তবায়ন না হওয়া কাশ্মীরী জনগোষ্ঠীকে বলপ্রয়োগ করে দমন করে রাখা যাবে না, আটকে হয়তো রাখা যাবে, সেটা দশকের পর দশক ধরে প্রমাণিত হয়ে আসছে।
অন্যদিকে বালুচ বিদ্রোহীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে পাকিস্তানও। দুই দেশের এই্ নিপীড়নের সীমা এতদূর বিস্তৃত যে একে আর অভ্যন্তরীন বিষয় বলা কঠিন। কিন্তু একটা যৌথ পারস্পরিক শত্রæতার ওপরই ভারত ও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ভরসা করে থাকে। ভারত ও পাকিস্তানে যে কোন ব্যর্থতা আড়াল করার, যে কোন বিপদ অতিক্রমের সহজ উপায় হলো অন্য দেশটিতে কোন সহিংস হামলা উস্কে দেয়ার অভিযোগ আনা। কিন্তু এই অভিযোগ যদি সত্যিও হয়ে থাকে, এর কারণ তো নিঃসন্দেহে বিক্ষুদ্ধ জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি। দু’দেশের ঝামেলাপূর্ণ এসব এলাকার সকল মুক্তিকামী মানুষের মত প্রকাশের ও রাজনৈতিক মর্যাদা প্রাপ্তির অধিকার আছে; তাকে অস্বীকার করে, পাশ কাটিয়ে উপমহাদেশের এই অস্থিরতার সমাধান হবে না। বরং এই অস্থিরতাকে ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরাই জনগণকে বিদ্বেষের ফাঁদে আটকে রাখবে। এর পরিণতি যুদ্ধ যদি না-ও হয়, হবে উপমহাদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাবে।## ৩০.১১.১৯

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.