যখনই মুনাকে দেখি ও বাঁ হাতের দুটো আঙ্গুল মুখে পুরে একমনে চুষে চলেছে। টিভি দেখা, পুতুল খেলা, হোমওয়ার্ক করা – সব কাজ করতে করতেই আপন মনে মুখে আঙ্গুল দুটো পুরে দেয়া মুনার ছোটবেলার অভ্যাস। এই খারাপ অভ্যাসটার জন্য মুনার শরীর প্রায়ই খারাপ হয়। পেটে গন্ডগোল তো লেগেই আছে। ডাক্তার ও মুনার মা বাবা কে বলেছে, এই ব্যাড হেবিট থেকে মুক্ত না হলে কোনভাবেই শরীর ঠিক হবে না। অথচ সালাম আর রুনা তো কম চেষ্টা করেননি। বকে, মেরে, ভয় দেখিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য মেয়েকে সামলানো গেলেও দুই-একদিনের মধ্যেই সে আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
রিজুর মায়ের সমস্যা আবার অন্যরকম। ক্লাস ফাইভে পড়া রিজুর খাওয়া নিয়ে ঝামেলায় বাড়ির সবাই টথস্থ। শাকসবজি তো খেতে চায় না, মাছওখেতে চায় না, ছেলেকে খাওয়ানো নিয়ে নিলা একেবারে নাকানি-চুবানি অবস্থা। খেতে বসেও হাজার ঝামেলা।ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া, প্রতি গ্রাশ এর সঙ্গে এক ঢোক করে জল। খাওয়া খাবার ঠিকমতো চিবিয়ে না খাওয়া। রিজু কে নিয়ে আর পারা যায় না, কবে যে ছেলেটা একটু শুধরাবে। নক খাওয়া, আঙ্গুল চোষা, খাওয়া নিয়ে ঝামেলা, মাথার চুল টানা -প্রত্যেক বাচ্চারই এ রকম কোনো না কোনো খারাপ অভ্যাস থাকে। এই খারাপ অভ্যাস ছাড়াবার চেষ্টা করার আগে অভিভাবকদের বুঝতে হবে, এই অভ্যাসগুলো এক ধরনের স্ট্রাটেজি যা বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য বাচ্চারা নিজে নিজেই আবিষ্কার করে। স্ট্রেস, ক্লান্তি ইনসিকিউরিটি, হতাশা, অপূর্ণ ইচ্ছে, ডিপ্রেশনের মতো নানা আবেগের সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য এই ট্যাকটিস। দেখতে খারাপ লাগলেও, বাচ্চারা এর মধ্য থেকে এক ধরনের শান্তি এবং আরাম পায়, সেজন্য বারণ করা সত্ত্বেও অভ্যাস গুলো সযত্নে জিইয়ে রাখে।
পজিটিভ অ্যাপ্রোচ
বাচ্চার ব্যাড হেবিটস আপনার যতই খারাপ লাগুক, বকাঝকা করবেন না। এতে বাচ্চাদের জেদ আরো বেড়ে যাবে বরং এই ব্যাড হেবিট কাটিয়ে উঠার ব্যাপারটাকে বাচ্চার সামনে একটা চ্যালেঞ্জের মতো পেশ করুন। যখনই ওকে নখ খেতে বা মুখে আঙ্গুল দিতে দেখবেন, ওকে চ্যালেঞ্জের কথাটা মনে করিয়ে দিন। কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখলে একটা সুইট্যাবল প্রাইস দিন । চকোলেট, পিজ্জা বা কোন জাঙ্কফুট দিবেন না ।বরং সুন্দর ছবির বইয়ের সিরিজ, পছন্দের খেলোয়াড়ের পোস্টার বা স্টিকার বা এডুকেশনাল গেমস গিফট হিসেবে উপহার দিন। এর সঙ্গে ওর প্রশংসা করুন। ওর চেষ্টার কথা অন্যদের জানান। এই পজেটিভ অ্যাপ্রচ শিশুকে অনুপ্রাণিত করবে।
ধৈর্য ধরুন
অভ্যাস যেমন একদিনে তৈরি হয় না, তেমনই একদিনে ছাড়ে না ।সেজন্যই ধৈর্য ধরুন এবং বাচ্চাকে শোধরানোর সময় দিন । অতিষ্ঠ হয়ে গায়ে হাত তোলার ভুলটা কখনোই করবেন না। যখনই দেখবেন ও কাজটা অসতর্ক মুহূর্তে করছে, তখনই দৃঢ়ভাবে ওকে বারণ করুন আর প্রাইজের কথা মনে করিয়ে দিন। নিজেদের মধ্যে একটা পয়েন্ট দেওয়ার সিস্টেম চালু করতে পারেন। ভালো কাজের জন্য প্লাস পয়েন্ট, খারাপ কাজের জন্য মাইনাস পয়েন্ট। মাসের শেষে একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট সংগৃহিত হলে ওর পছন্দ করা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান বা সিনেমা দেখান।
গুড ম্যানার্স
বাচ্চা একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওকে সভ্য ব্যবহার বা গুড ম্যানার্স শেখাতে শুরু করুন। হাইজেনিক হ্যাবিটাস, বাড়ির লোকের সঙ্গে ব্যবহার, বাইরে বেড়াতে গেলে ব্যবহার, নিজের জিনিসপত্র সামলে রাখা ইত্যাদি সবকিছুই গুড ম্যানার্স এর আওতাভুক্ত হতে পারে। নিজেকে বাচ্চার সামনে রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরুন। নিজের স্বভাব, ব্যবহার বাচ্চাকে ফলো করতে বলুন। ওর ব্যবহারের কোথাও ঘাটতি থাকলে বকাঝকা না করে আপনার কথাটা খারাপ লেগেছে বা আপনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন সেটা বুঝিয়ে বলুন। বাড়িতে দুজনে মিলে এই ধরনের কিছু সিচুয়েশন কল্পনা করে দুজনে একে অপরের ভূমিকায় অভিনয় করে একটা মজার খেলা ও খেলতে পারেন।
প্যারেন্ট ইনভলভমেন্ট
নিজের কাজে খুব ব্যস্ত থাকলেও বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগটা যেন কখনোই ছিন্ন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। দিনের কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানো একসঙ্গে পড়াশোনা বা একসঙ্গে খেলাধুলা করা, রাত্রে একসঙ্গে খেতে বসা, অফিস থেকে ফোন করে খোঁজখবর নেয়া, এই ছোট ছোট অভ্যাসের মাধ্যমে সম্পর্কটা দৃঢ় হবে। ওর মধ্যে কোন ভয় বা নিরাপত্তার অভাব দেখা দিলে সেটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে ওকে আত্মবিশ্বাসী করে তুললে ওর বদ অভ্যাস নিজে থেকে কমে যাবে।
নতুন শখ
প্রত্যেক শিশুর কিছু শখ বা হবি থাকা দরকার। অনেক সময় কিছু কাজ না থাকার জন্য ব্যাড হেবিট গ্রো করে। নতুন অনেক কিছু শেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা ব্যস্ততা তৈরি হয়।কাজের ব্যস্ততার মধ্যে থাকলে সাময়িকভাবে হলেও ব্যাড হ্যাবিটস ভুলে থাকে ওরা।নাচ, গান, ছবি আঁকা, বাগান করা, হাতের কাজ যে ব্যাপারে উৎসাহ তাকে এনকারেজ করুন।হবি ক্লাসে ভর্তি করে দিতে পারেন। তাহলে অন্যান্য বাচ্চার সামনে ওর অভ্যাসগুলো সামনে আনতে সংকোচ বোধ করবে।
স্মার্ট প্যারেন্টিং
বাচ্চাকে ন্যাগ করবেন না। যে অভ্যাস পছন্দ হবে না সেটা দৃঢ়ভাবে বারণ করুন। কোন ভাবে কাজ না হলে ওর পছন্দের কোন একটা জিনিস নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করে দিন।
বাচ্চার সঙ্গে একটা পার্টনারশিপ গড়ে তুলুন। বেড হেবিট কে শত্রু ভেবে নিয়ে দুজনে মিলে অ্যাটাকিং প্ল্যান তৈরি করুন।
ভালো ব্যবহারের জন্য পুরস্কার অবশ্যই দেবেন, তবে কোনোভাবেই সেটা যেন ঘুষ না মনে হয়। গিফট যাই দিন সেটা যেন আপনার সাধ্যের মধ্যে হয় এবং বাচ্চার কাজে লাগে।
যদি কোন সময় হয় বাচ্চার কোন গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে বলে খারাপ অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারছেনা, বিনাদ্বিধায় কাউন্সিলরের এর জন্য সাহায্য নিন। (সূত্রঃ সানন্দা)