--- বিজ্ঞাপন ---

পাকিস্তান কি বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইবে……বিবিসি’র বিশ্লেষন

0

বাংলাদেশের মানুষের কাছে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে, বাংলাদেশ বহুদিন ধরে এমন দাবি জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশের অভিযোগ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, যা আজকের বাংলাদেশ, সেখানে যুদ্ধাপরাধ চালিয়েছে। পাকিস্তান ওই অভিযোগ নাকচ করে আসলেও, ১৯৭৪ সালে প্রথম দেশটি বাংলাদেশের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।

১৯৭৪ সালে সিমলা চুক্তির পর যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পাকিস্তান তখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, আর বাংলাদেশ এবং ভারত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানো শুরু করে। একই সময়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আটক যুদ্ধবন্দী এবং সেখানে আটকে পড়া সাধারণ বাঙালিদের ফেরত পাঠানো সমাপ্ত করে পাকিস্তান। তবে বাংলাদেশ ওই সময় যুদ্ধাপরাধীসহ পাকিস্তানের অন্য শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিলে পাকিস্তান তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান দাবি করে তাদের হাতে গ্রেপ্তার থাকা ২০০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা করার ষড়যন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের অভিযোগে প্রমানিত হয়েছে। আর তাই শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা কেবল নিজেদের বন্দী নাগরিকদের ফেরত দেয়া-নেয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে। এই ঘটনার কারণেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং দেশটির কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশ তখন ঘোষণা দেয় যে তারা ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর কোন বিচার করবে না এবং তাদেরকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে।

ভবিষ্যতে সহযোগিতার সম্পর্ক রাখবে এমন চুক্তি স্বাক্ষর করে দুই দেশ। এক ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সবার সম্মতিতে যে চুক্তি হয়, তাতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।

চুক্তির বিবরণ অনুযায়ী, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান। তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের প্রধানমন্ত্রীর এমন বার্তা জানিয়ে দেন যে তিনিও বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষমা করে, অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে বলেছেন। তিনি বলেন, “কিভাবে ক্ষমা করতে হয় বাংলাদেশের মানুষ তা ভালোই জানে।”

দ্বিতীয়বার, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশে সফরকালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন এবং ওই সময়ের পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেন। তাহলে বাংলাদেশ আবার কেন দাবি করছে, পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিবিসি ঊর্দু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে।

আশরাফ কুরেশী ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, ঢাকায় যখন তিনি দায়িত্বরত ছিলেম তখন তিনি অনেকবারই ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ১৯৫ জন বন্দী প্রত্যর্পণের সময় যে আলোচনা হয়েছিল, তখনকার সেই চুক্তিতে পরিষ্কার উল্লেখ ছিল যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি বাংলাদেশে একবার সফর করবেন এবং দেশটির জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন যে তারা যেন পেছনের কথা ভুলে যায়।

এখানে উল্লেখ করা উচিত হবে যে চুক্তিটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ কুরেশী বলেন যে “বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চুক্তিতে সই করেছিলেন এবং লিখেছিলেন যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও জনগণকে একটি বার্তা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে বাংলাদেশের মানুষ জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়, এবং ক্ষমা হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ফেরত পাঠাবে।”

বিবিসি ঊর্দুর সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী বলেন যে বাংলাদেশে এটা মনে করা হয় চুক্তিটি আসলে হয়েছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে, কারণ তারা ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল এবং বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে চুক্তির অংশ হতে হয়েছিল।

তিনি বলেন, সেই সময়ে “নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে একে আপসরফা এবং সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ এতে সন্তুষ্ট নয়, প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও এটা বিরাট এক সমস্যা। আমার মনে হয় না দুঃখ প্রকাশ করায় কোন সুবিধা হবে। তারপরও ওটা সত্যিকারের দুঃখপ্রকাশ ছিল কি-না, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা ছিল।” আশরাফ কুরেশীর বক্তব্য অনুযায়ী, “পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়েছে এবং দুই তরফ থেকেই ভুল করা হয়েছে। যুদ্ধের কারণে আক্রান্ত এবং নির্মমতার শিকার মানুষ দুই দেশেই রয়েছেন, এবং এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছে যে যুদ্ধ শুরুর আগেই কিছু পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করা হয়েছিল, তাই সেজন্য কি বাংলাদেশ ক্ষমা চাইবে?” তিনি বলেন, বাংলাদেশ সফরের সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ অনুতাপ প্রকাশ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানি ভাই ও বোনদের পক্ষ হয়ে কথা বলছেন।

কিন্তু আফসান চৌধুরীর বক্তব্য, পারভেজ মুশাররফের সফরের সময় বাংলাদেশের মানুষের গভীর প্রত্যাশা ছিল। “আমার মনে হয়, এটা বোঝা জরুরী যে মার্জনা মানে এই নয় যে আমরা দুঃখিত, যা হবার হয়ে গেছে। এর মানে আরো গভীর কিছু। কারণ বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে একটি সর্বাঙ্গীণ ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজন ছিল।”

“আপনি একে হয়ত আইনতভাবে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ বলতে পারেন, কিন্তু মানুষের কাছে এটা কোন ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ ছিল না। ওই চুক্তিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্ষমা করে দেয়া উচিত। কিন্তু এখানে আমরা বিশ্বাস করি যে পুরো পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।” আফসান চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের উপলব্ধি হচ্ছে যে ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে, তার সবই হয়েছে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা-মাফিক। আমরা চাই এর দায়িত্ব নির্ধারণ করা হোক, কে কী করেছে তা চিহ্নিত হোক।”

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সরকার ক্ষমা চাক বা না চাক, বিশ্লেষকদের বিশ্বাস যুদ্ধের শিকার বহু বাংলাদেশি এখনো বুকের ভেতর কষ্ট আর কান্না চাপা দিয়ে বেঁচে আছেন, সেই ঘটনার সংশোধন এখন অপরিহার্য।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করা এবং দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে সে কাজ হয়তো সম্ভব হতে পারে।###২৩.১২.১৯

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.