--- বিজ্ঞাপন ---

১৯৮৮ সালের চট্টগ্রাম গণহত্যা, ৫ জনের ফাসিঁ

0

মাঝখানে গড়িয়ে গেছে অনেক সময়। কথায় বলে সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। প্রায় ৩২ বছর বছর আগের ঘটনা। ১৯৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারী রক্তাক্ত হয়েছিল চট্টগ্রামের রাজপথ। স্বৈরাচারি এরশাদ সরকারের আমলে যখন মানুষ গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল তখন ঘটে নির্মম হত্যাকান্ড। স্বৈরাচারি এরশাদ সরকারের পেটোয়া বাহিনী প্রধান সিএমপি কমিশনার রকিবুল হুদার নেতৃত্বে পুলিশ শেখ হাসিনার মিছিলে গুলি চালায়। শেখ হাসিনা ঐদিন বেলা দেড়টায় কোতোয়ালীর মোড় পার হয়ে বিশাল মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন লালদিঘীর দিকে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে ২৪ জনের লাশ। শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় আইনজীবী ভবনে।

সেই হত্যাকান্ডের বিচারের রায় হলো। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় ৫ পুলিশকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়। মূল হোতা জে সি মন্ডল পালিয়ে গেছেন ভারতে। বাতি ৪ জন কারাগারে। তাদের নির্দেশ দাতা রকিবুল হুদাও মারা গেছেন। তবে বিচারের জন্য যারা আদালত প্রাঙ্গনে লড়াই করেছেন মামলার বাদী এডভোকেট শহীদুল হুদাসহ অনেকে মারা গেছেন। তারপরও হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর সান্তনা, বিচার তো হয়েছে।

সারা দেশের মতোন চট্টগ্রামেরও ১৯৮৮ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। এ আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে আসেন। পূর্ব থেকে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে এরশাদ বিরোধী জনসমাবেশের স্থান ছিল। সকাল থেকে লালদিঘীতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পথে পথে ছিল হাজার হাজার মানুষ। তৎকালীন ১৫ দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম আসছেন শুনে হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা অবস্থান নেয় নগর জুড়ে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট চত্বরে অপেক্ষারত ছিলেন হাজার হাজার ছাত্র জনতা। ঐদিন বেলা দেড়টার দিকে মিছিল নিয়ে শেখ হাসিনা কোতোয়ালী থানা হয়ে পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করার সময় এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়। সমাবেশ বানচাল করে দিতে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে পুলিশ বাহিনী গুলি চালায়। এ সময় দলের নেতাকর্মীরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে নেত্রীকে বাঁচাতে মানববর্ম রচনা করেন। আইনজীবী ভবন থেকে নেমে আসেন আইনজীবীরা। তারা শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে আইনজীবী ভবনের দিকে নিয়ে যান। কিছু বুঝে উঠার আগেই অতর্কিত গুলিতে ২৪ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। আহত হয় আরো দু’ শতাধিক। পুলিশের গুলিতে যারা মারা যায় তারা হলেন, মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সীতাকুন্ড থানা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম, ছাত্রনেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এথেলবাট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, ক্ষেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, হোটেল শ্রমিক জি.কে চৌধুরী, ছাত্রনেতা সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি.কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মোহাম্মদ কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ এবং শাহাদাত প্রমুখ।
অভিযোগ উঠে, নৃশংসতা এমন পর্যায়ে যায় যে, পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের লাশ রাতের আঁধারে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। চলে লাশ গুম করার চেষ্টা। এই ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা এবং কোতোয়ালী জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ্র চন্দ্র মন্ডলসহ মোট ৪৬ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। মামলা করা হলেও অনেক বছর ধরে এ মামলার কোন গতি হয়নি। বছরের পর বছর নীরেেব কেটে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়টি একাধিকবার কথা উঠলেও মামলা গতি লাভ করেনি। কারন এরশাদের সাথে আওয়ামী লীগে সর্ম্পকের কারনে এটা থমকে যায়। এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তিনবার। প্রায় তিন দশক পার হবার পরও যখন বিচার হচ্ছিল না তখন সন্তান হারানো পরিবারগুলো বিচারের আশা ছেড়ে দেয়। তাছাড়া মামলা হলেও স্বাক্ষী আসছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবে থমকে যায় বিচারের কাজ। গত ২০০৯ সালের ১০ আগষ্ট হাফিজ উদ্দিন নামের এক পুলিশের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করার পর দীর্ঘদিন আর কোন নড়াচড়া নেই। পরবর্তিতে ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ডা. মিজানুর রহমান নামের একজন স্বাক্ষী স্বাক্ষ্য দেয়ার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত তিনি আদালতে উপস্থিত হন নি। এ মামলায় তখনকার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার র্মীজা রকিবুল হুদাকে মামলায় প্রধান আসামি করা হয়। একই সাথে রকিবুল হুদাকে ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লখে করা হয়। বিগত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বহুল আলোচিত এ মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। সিআইডি ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারী প্রথম দফায় সিএমপি’র তৎকালিন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাকে আসামী করা হয়। পরে আবার ১৯৯৮ সালে ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় াধিকতর তদন্তের পর মীর্জা রকিবুল হুদাসহ ৮ জনকে আসামী করে চার্জশিট দেয়া হয়। ২০০০ সালের ৯ মে আদালত ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। আসামীদের মধ্যে সবাই পুলিশ। আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৭ সালরে ২২ অক্টোবর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুহয়। মামলার মোট সাক্ষী ১৬৭ জন। গত ১৪ জানুয়ারি ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণরে মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য কার্যক্রম শেষ হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে রবিবার রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করনে। গতকাল সোমবার আসামীপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্ত আসামীপক্ষ যুক্তি উপস্থাপনে অসম্মতি জানালে আদালত তাৎক্ষণকিভাবে রায়ের সময় নির্ধারন করেন। শেষপর্যন্ত বিকাল তিনটায় আদালত রায় পড়ে শুনান।
মামলার আইনজীবী এডভোকেট ইফতার সাইমুল বলেন, মামলায় অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় জেসি মন্ডলসহ ৫ জনের মৃত্যুদন্ড এবং ৩২৬ ধারায় ১০ বছরের সাজাসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে আদালত।
রায় ঘোষনার দিন আসামী পক্ষের কোন আইনজীবী ছিল না। রায় ঘোষনার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গনে আনন্দ মিছিল করেন।
এ মামলার বিচার দেখে যেতে পারেন নি বাদী শহীদুল হুদা। ২০১৩ সালে তিনি মারা যান। ২৪ জানুয়ারী নিহত এথেলবাট গোমেজের কন্যা জানান, ‘তাঁর জম্মের দু’দিন পরই গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তাঁর বাবা। তাঁর মা লুচিয়া গোমেজও মামলার বিচার দেখে যেতে পারেননি। তিনিও কয়েক বছর আগে মারা যান। তবে দীর্ঘদিন পর হত্যাকান্ডের বিচার পেয়ে তিনি গণমাধ্যমকে সন্তষ্ট বলে উল্লেখ করেন।’
উল্লেখ্য এ মামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, সাজেদা চৌধুরীসহ ১৬৮জন স্বাক্ষী ছিলেন। ৫৩ জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহনের পর আদালত রায় দেন।### ২০.১.২০২০

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.