--- বিজ্ঞাপন ---

দল থেকে নাছিরের মনোনয়ন না পাবার নেপথ্যে

0

মেয়র হিসেবে আ জ ম নাছির দায়িত্ব নেয়ার পর নগরীর বিলবোর্ড উচ্ছেদ, ডোর টু ডোর ময়লা-আবজর্না সংগ্রহ, নগরীর কিছু ওয়ার্ডে সৌন্দর্য্যকরণসহ বেশ কিছু ভালো কাজ করেছেন। তারপরও তার প্রতি দলের হাইকমান্ড এত ক্ষুদ্ধ কেন এবং দলের সাধারন সম্পাদকের অনুরোধ সত্বেও মেয়র নাছির দলের মনোনয়ন পেলেন না এটাই এখন চট্টগ্রামে ‘টক অব দ্যা টাউন’। এটা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষন। তবে নেত্রী যে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন না এটা বেশিরভাগ নেতা-কর্মীর বিশ্বাস। মেয়র নাছিরকে মনোনয়ন না দিয়ে দল থেকে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এবং ত্যাগি নেতা রেজাউল করিম চৌধুরীকে নেত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন। কেন এবং কি কারণে নেত্রী এটা করেছেন তা শুধু তিনিই বলতে পারেন বলে অভিমত নেতা-কর্মীদের।
ঠিক কি কারনে দল থেকে মেয়র নাছির মনোনয়ন পেলেন না এটা সরেজমিন খুজঁতে গিয়ে যে বিষয়গুলো সামনে এলো তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এবার চট্টগ্রামের প্রায় সব ক’জন মন্ত্রী, এমপি, সাবেক মন্ত্রী একজোট হয়ে মেয়র নাছিরের বিরোধীতা করেছেন। নেত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন অনেকগুলো বিষয়। যে বিষয়গুলোর সবগুলোই ছিল নেতিবাচক। তার ইতিবাচক কোন কিছুই নেতিবাচক বিষয়গুলোর সামনে দাড়াতে পারে নি।
দলের সিনিয়র নেতাদের মতে, মেয়র নাছির অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেই চট্টগ্রামের একক নেতা হবার চেষ্টা করেছেন। মেয়র এবং নগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হবার সুবাদে তিনি চট্টগ্রামের অন্যান্য নেতাদের পাত্তা দিতে চান নি। তিনি কোন অনুষ্ঠানে কাউকে ডাকেন নি। দলের সাধারন সম্পাদক হিসেবে তার যা করার কথা ছিল তিনি তা তো করেন নি, বরং নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে দলে গ্রæপিং আরও জোরদার করেছেন। দলের সাধারন সম্পাদক হিসেবে তার উচিত ছিল সবাইকে ডেকে ঐক্যবদ্ধভাবে দলের জন্য কাজ করা। নেত্রী তার উপর আস্থা রেখে তাকে দলের সাধারন সম্পাদক করেছিলেন। কিন্ত দল পরিচালনায় মেয়র নাছির সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। দলের সিনিয়র নেতারা দু’জন ছাত্রলীগ নেতা হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ এবং ছাত্রলীগ নেতা সোহেলের পরিবার কেদেঁ কেটে নেত্রীর কাছে সন্তান হত্যার বিচার চেয়েছেন। অথচ মেয়র ইচ্ছে করলে এ ঘটনাগুলো মোকাবেলা করতে পারতেন। কিন্ত তিনি করেন নি। ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের পরিবার থেকে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে ছেলে হত্যার বিচার চাওয়া হয়েছে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় করে দেখা দিয়েছে, তা হলো সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর পতœীকে অপমান করে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেয়ার বিষয়টি। মূলত এ কারনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পতœী হাসিনা মহিউদ্দিন মেয়র নির্বাচনে অংশ নেয়ার লক্ষে ফরম নিয়েছিলেন। কিন্ত শেষপর্যন্ত তিনি তা জমা দেন নি। তবে তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেশ ক্ষুদ্ধ ছিলেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও মেয়র নাছিরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দলের সিনিয়র নেতারা অভিযোগ করেছেন এ মর্মে যে, দলের সাধারন সম্পাদক হিসেবে তিনি কখনও কাউকে দলের স্বার্থে ডাকেন নি। সভা-সমাবেশ করেছেন নিজেই গ্রæপিং করে। তাছাড়া মহিউদ্দিন পুত্র নওফেলের সাথে দলের প্রশ্নে দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে যান নাছির। মেয়র নির্বাচনে দলের মনোনয়নের আগে গত ৫ বছর ধরে চট্টগ্রামে দল কিভাবে চলেছে তার একটি ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয়।
বন্দর কেন্দ্রীক একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও একজন সংসদ সদস্যও নাছিরের মনোনয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন বলে জানা গেছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নিজের ব্যবসার জন্য মেয়র বন্দরকে ব্যবহার করছেন। যে কারনে তার জন্য তাদের কাজ করা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে।
চট্টগ্রামের কাউন্সিলরদের মধ্যে অনেকে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে সূত্র জানায়। মেয়র নাছির মনোনয়ন চাইবেন এটা তারা আগেভাগেই জানতেন। তাই তারা প্রস্তত ছিলেন আগে থেকেই। সিনিয়র মন্ত্রীদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে তারা এটাই প্রমান করার চেষ্টা করেন, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর থাকলেও মেয়র নাছিরের পছন্দের কয়েকজনের দাপটে কাজ করা তাদের জন্য সম্ভব হয়ে উঠেনি। মেয়র হিসেবে প্রত্যেক ওয়ার্ডকে সমান নজরে দেখার কথা থাকলেও তিনি তা করেননি। তারা সম্মিলতিভাবে তার সুনজরে থাকা বেশ কয়েকটি ওযার্ডের বরাদ্দ চিত্র এবং অন্যান্য ওয়ার্ডের অবস্থা তুলে ধরতে সক্ষম হন। সবকিছুতে মেয়রের পছন্দের কাউন্সিলরদের প্রাধান্য দেয়াটা এক পর্যায়ে মেয়রের জন্য কাল হয়ে দাড়ায়।
আরও একটি বিষয় সংস্থার রির্পোটে উল্লেখ করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়, তা হলো মেয়রের মর্যাদা। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স’ মতে মেয়র পদটি রাষ্ট্রের ১৮ নম্বর সম্মান জনক পদ। যে কারণে চট্টগ্রামের মেয়রকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়। কিন্ত তাকে দেয়া হয়নি। কারণ মেয়র নাছির মেয়র পদের সাথে সাথে এমন কিছু পদের দায়িত্বে থাকেন যা অপেক্ষাকৃত নিচের অবস্থানে। এমনকি ডিসি’র নিচেও। তিনি চট্টগ্রামের একটি হাউজিং সোসাইটির সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারন সম্পাদক (এখানে জেলা প্রশাসক সভাপতি),চট্টগ্রাম জেলা ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা রেফারি এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিসহ বেশ কিছু সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এতগুলো পদে থেকে তিনি কিভাবে সিটি কর্পোরেশন এবং দলকে সময় দেবেন এ বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।
নগরীর জলাবদদ্ধতা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও তার উপর বিরক্ত ছিল বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প দিয়েছেন। সিডিএ’র মাধ্যমে সেনাবাহিনী এটি বাস্তবায়ন করছে। কিন্ত স্থানীয় সরকারে নগরীর নালা নর্দমা পরিস্কার রাখার রুটিন কাজগুলো কেন করছে না এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় তাগাদা দেয়া হলেও চসিক এর পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোন সাড়া পাওয়া যায় নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী চট্টগ্রামে এসে তাকে স্মরন করে দেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। জলাবদ্ধতার ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দায়সারা কাজের ব্যাপারে তিনি সতর্ক করলেও চট্টগ্রামবাসী কাংখিত কোন সেবা পায়নি।’
দলের এক সিনিয়র নেতা জানান, মহিউদ্দিন চৌধুরী চেষ্টা করেছেন কর্পোরেশনকে নিজের পায়ে দাড়াতে। এমন প্রকল্প নেয়া হয় যাতে কর্পোরেশনকে জনগনের ট্যাক্সের উপর নির্ভরশীল হতে না হয়। তাই তিনি কাচাঁ – সেমিপাকা ঘরের ট্যাক্স মওকুফ করে দেন। সেখানে মেয়র নাছির হঠাৎ করে ১০গুণের বেশি ট্যাক্স আরও করে জনগনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে যান। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে বিপুল পরিমান ট্যাক্স আরোপ করা হলে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শেষপর্যন্ত আদালতের নির্দেশে এটি বন্ধ হলেও মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে ক্ষোভ রয়ে যায়। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে তার বেশ কয়েকজন আস্থাভাজন প্রকৌশলী নিজেদের ইচ্ছেমতোন অনিয়ম করার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেরিয়ে আসে। মেয়র কোন ব্যবস্থা না নিলে তারা আরও প্রশ্রয় পায়। বিষয়টি সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে অনেকে মন্তব্য করেন।
উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের মেয়র পদের দলীয় মনোনয়ন পেতে আ জ ম নাছিরকে বেশ দৌড়ঝাপ করতে হয়। তারপরও দলের হাইকমান্ড তাঁকে তা দেন নি। দলের সাধারন সম্পাদকসহ প্রভাবশালী একাধিক মহল তাঁর জন্য তদবির করলেও নেত্রী তাঁকে মনোনয়ন না দেয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। অথচ চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বঞ্চিত করে গতবার নেত্রী একক সিদ্ধান্তে তরুন নেতা হিসেবে তাঁকে মেয়র পদে দলের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। একই সাথে তাঁর হাতে দলের গুরুত্বপূর্ণ ‘সাধারন সম্পাদক’ পদটিও তুলে দেন। কিন্ত তাঁর গত ৫ বছরের কর্মকান্ডে তিনি এতটাই নাখোশ হন যে সকল প্রকার অনুরোধ – তদবির উপেক্ষা করে দলের মনোনয়ন থেকে তাঁর নাম বাদ দেন। মেয়র হিসেবে দলের মনোনয়ন না পেলেও তিনি এখনও দলের সাধারন সম্পাদক। দলের সাধারন সম্পাদক হিসেবে মেয়র নাছির কতটুকু ভুমিকা রাখতে পারেন এটাই এখন দেখার বিষয়।###১৭.২.২০২০

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.