--- বিজ্ঞাপন ---

করোনা কালের লেখালেখি…. সাংবাদিকতা

0

দীর্ঘ সময়ের সাংবাদিকতায় এমনতর কঠিন জীবন আর যাপন করিনি। অনেক গুলো হৃদয়স্পর্শী প্রতিবেদন চোখের সামনে ঘুরছে। ‌ কিন্তু লিখতে পারছি না। মানুষের দুঃখ কষ্টের সীমা নেই। প্রতিটি ঘর যেন এক একটি কারাগার। এ কারাগারের ভেতরে থাকা কষ্টের জীবন চিত্র তুলে ধরতে থাকলে রচিত হবে অনেক মহাকাব্য। একটা ভালো লেখা, মনে রাখার মতো লেখা, চমকে দেয়ার মতন লেখা আসলে আজও লিখতে পারিনি। ২৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এসে বুঝলাম সাংবাদিকতা যা করেছি তার ৮০ ভাগই শুধু বিবৃতি আর পুনরাবৃত্তি। সাংবাদিকতা যে একটি নিস্তরঙ্গ প্রবাহের বিষয় বার বার কথাটি ভুলে যায়। আসলে এ নিস্তরঙ্গ প্রবাহের ভেতর থেকে আচমকা যখন ঢেউ উঠে আসে সেটাই হয় সংবাদ।

একজন সাংবাদিককে সে ঢেউ চিনে নিতে হয়। না চিনতে পারলে আসলে বড় সাংবাদিক হওয়া যায় না। অথচ এখন ঢেউ নয় চলছে সুনামি। চলমান বিশ্বে খবরের কাগজে প্রতিটা লাইনের দাম নির্ধারিত হয় সেন্টিমিটারের হিসেবে। যেখানে প্রত্যেকটা লাইন দামি, যশস্বী মানুষদের দিয়ে লেখানো হয় ভেতরের বড় বড় উপসম্পাদকীয়গুলো। এ দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে একটা বিষয় বুঝলাম, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যতদিন ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকে ততদিন কোন ঝামেলা নেই । কিন্তু যখনই তার মধ্যে বাইরের কোনো অভিপ্রায় ঢুকে পড়ে তখনই ভাঙ্গনের শুরু। যারা সত্যিকার অর্থে এ পেশার সাথে জড়িত তারা সাংবাদিকতাকে অর্থবহ করতে হলে প্রথমে নিজের মধ্যে একটা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সাংবাদিকদের জীবন আর পাঁচটা জীবনের মত নয়। পরতে পরতে প্রতিষ্ঠা আর প্রত্যাশার কোন ইতিবৃত্ত নেই। অনেক কিছু দেখে যখন লিখতে যায় তখন মাঝে মাঝে অসহায় বোধ করি। এখন ২১শতকে জার্নালিস্ট নাকি সারপ্লাস। কস্ট কন্ট্রোল শব্দ এখন এ জগতে প্রায় শুনি।

নিউজের মেরিটের বদলে এখন বিজ্ঞাপনের স্বার্থটাই সবচেয়ে বেশি। অনেক সময় শতভাগ সত্য নিউজ ও চাপা পড়ে গেছে, বছরের পর বছর এ যন্ত্রণা সহ্য করেছি। মাঝে মাঝে এ পেশার প্রতি, নিজের প্রতি যে ঘৃণা জম্মেনি তা নয়। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর আগে মানুষের মধ্যে একটি বিস্ময় ও মুগ্ধতা কাজ করতো। এখন সেটি চোখে পড়ে না। এখন আসলে মানুষের সমস্যাগুলো সাংবাদিকদের ছোঁয় না। সব কাগজগুলো ভান করে, তারা সব সময় মানুষের জন্য , দেশের জন্য ভাবছে। মানুষের পাশে আছে সবসময়। আদতে কি তাই? অনেকে বলেন, এখন হাত পা যে বাঁধা। করোনা কালেও বুঝলাম সাংবাদিকদের অলস শয্যায় শুয়ে থাকলে চলে না। পৃথিবীর বুক থেকে আলো নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কাজ করতে হয়। খাটতে হয় অনেকটা ভূতের মতো। তবে আগের মতো নেই অনেক কিছুই। ছোট বড় ঈর্ষা, সহকর্মীকে নত করে দেয়ার প্রবণতা, মুখোশ পরা হিংসা এখন এ জগতে খুব বেড়ে গেছে। একটু একটু করে জটিল হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। এ পেশার সম্মান শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বুঝতে পারছি না।

মাঝে মাঝে মনে হতো চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন প্রফেশনে চলে যায়। এমন ভাবনা এখনও বুকের মধ্যে তোলপাড় করে। পরে ভাবি সময় যে ফুরিয়ে গেছে। গত ২৫ বছরে বন্ধুহীন হয়ে গেছি। সাংবাদিক মানে যে সুপার পাওয়ার না একথা বুঝাই কারে। পরিবার,আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, পরিচিত মানুষের সমস্যার অন্ত নেই। মাঝে মাঝে এসব সমস্যার বোঝা যখন নিজের কাঁধে এসে পড়ে তখন বুঝি সমাধান যেন আমাকেই করতে হবে। অনেকে আশা নিয়ে হাজির হয়। নিজের সীমাবদ্ধতার বাইরে অনেক কিছুই করা যায় না। তখন বেশিরভাগই মনে করে আমি পারতাম ইচ্ছে করে করিনি। দিনশেষে দেখা যায় আশেপাশে কেউ নেই। দীর্ঘ এ যাত্রায় ক্লান্তি, অপ্রাপ্তি, কিছু হতাশা বা বিরক্তি তো রয়েছেই। কিছু স্বপ্ন তো ছিল। কিছুটা বড় হওয়া, নামজাদা কেউ হবার স্বপ্ন কখনো ছিল না। এখনও নেই। তারপরও মনে রাখার মত কিছু প্রত্যাশা ছিল। জানি, সাংবাদিকতা পেশায় সৃষ্টিশীলতার অনেক পথ খোলা । সে গুলোকে চিনে নিতে হয়, খুঁজে নিতে হয়। আমি আজো খুঁজছি। রিপোর্টার হয়ে শুরু করেছিলাম, এখনও রিপোর্টার হয়ে আছি। মনে হয় সাংবাদিক এখনো হতে পারিনি। রিপোর্টার হিসেবে ভালো, মনে রাখার মতো অ্যঙ্কার স্টোরি কম করিনি। প্রশংসা পেয়েছি ,বাহবা পেয়েছি। তারপরও রয়ে গেছে একটা অতৃপ্তি, একটা শূন্যতা। বুকের ভেতর সেই শূন্যতা এখনও মাঝে মাঝে নাড়া দেয়। দিন যত গেছে তত বুঝছি, জার্নালিজম পেশার মধ্যে একটা হাতছানি আছে , প্রলোভন আছে, অদৃশ্য ফাঁদ পাতা আছে । মাঝে মাঝে মনে হয় ভালো কিছুর করার পর কাছা খুলে প্রশংসাও এক ধরনের ফাঁদ।

এখন মনে হয়, সংবাদপত্রের জগৎটা আসলেই নোংরা। এখানে অনেক কিছুই রহস্যের পর্দা দিয়ে ঘেরা। ভালো মন্দের টানাপোড়েন চলে সবসময়। যে কোন সময়, যে কোন দিন এখানে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। আমরা এই সাংবাদিকরা এক একটা দেশলাই কাঠি। কাঠির ডগায় লাগানো বারুদের আগুনে অন্যরা পুড়ে যায় । আবার আমরা নিজেরাও বাঁচতে পারি না ।পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে যায় ! এ জগতটা এমন ট্রাজেডী দিয়ে তৈরি যা আর কোন প্রফেশনে নেই। সাংবাদিকদের কোন স্ট্রং ইউনিয়ন কার্যত কি আছে? অন্যায় অপমানের বিরুদ্ধে যে কোনো সময়ে রুখে দাঁড়ানো যায়? দাঁড়ালাম,কিন্তু তারপর। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া খুব শক্ত । এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় আমরা একা। পেছনে কেউ নেই। শুধু অসহায়ভাবে পরিবার দৌড়ায়। এটাই বাস্তবতা,এটাই এখন চিরন্তন সত্য। যারা স্রোতে গা ভাসিয়ে যায় তারা সবকিছু পারে। স্রোতের বিপরীতে চলতে গেলে রক্ষা নেই। জীবন থেকে শান্তি,স্বস্তি সব চলে যায়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.