--- বিজ্ঞাপন ---

চার্লস শোভরাজ দ্যা কিলার…শেষ পর্ব

0

কাজী ফেরদৌস :

চার্লস শোভরাজ ২০০৪ সালে চৌধুরী কে প্যারিসে দেখা গিয়েছিল বলে শুনা গিয়েছিল কিন্তু তার কোন সত্যতা পাওয়া যায় নি। শোভরাজ এর পর তার কানাডার বান্ধবী এনড্রি কে নিয়ে জেনেভায় অবস্থান নেয়।এনড্রি এখানে রত্ন ব্যবসায়ী হিসেবে তার ধান্দা চালিয়ে যেতে থাকে পরে ভারতে এসে শোভরাজ এর সাথে যোগ দেয়।

ভারতের মোমবাই এসে পশ্চিমের দুজন নিরুদ্দিষ্টা নারী বারবারা স্মিথ ও মেরি এলেন নামে দুই সহযোগী কে নিয়ে শোভরাজ  নুতন ভাবে তার অপরাধমূলক কার্যক্রম শুরু করে। এখানে তার প্রথম শিকার হয় একজন ফ্রেঞ্চ পর্যটক জিন লাক সলমন।১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে শোভরাজ ও তার তিন নারী সহযোগী একদল ফরাসী আন্ডার গ্রাজুয়েট কোর্সের ছাত্রদের ট্যুর গ্রুপ কে তাদের তাদের গাইড হিসেবে নিতে রাজি করায়।উদ্যেশ্য ছিল তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়া।ভ্রমনের এক পর্যায়ে তাদের ডিসেন্ট্রির প্রতিষেধক বলে বিষ মিশ্রিত পিল খাওয়ায়।কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে  নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ড্রাগের কার্যকারিতা শুরু হয়ে গেলে তিন জন ছাত্র তাদের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে তাদের পাকড়াও  করে ফেলে পুলিশ কে খবর দেয়।পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। তবে এরই মধ্যে একজন ছাত্র সলোমন মৃত্যু বরণ করে। সেই থেকে শুরু হয় শোভরাজ এর পতন ও বন্দী জীবন। পুলিশ সোভরাজ ও তার তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে সলোমন হত্যা কাণ্ডের অভিযোগে মামলা দায়ের করে এবং তার দুই নারী সহযোগী স্মিথ ও ইথার হত্যা কাণ্ডের দায় স্বীকার করে নেয়।পরে তাদের বিচার শুরু হবার দুই বছর  আগে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
ইতিমধ্যে তার ভাই এন্ড্রি প্যারলে মুক্তি পেয়ে ভারতে এসে তার সহায়তায় এগিয়ে আসে।নয়া দিল্লির তিহার জেলে প্রবেশ করার সময় শোভরাজ বেশ কৌশল করে তার শরীরের সাথে মূল্যবান রত্ন পাথর নিয়ে আসে।বাহিরে তার ভাই এর সহায়তায় এসব পাথর বিক্রি করে জেলখানায় আয়েশি জীবন যাপন করতে থাকে।জেলের বাহির থেকে দামী খাবার নিয়ে আসত এবং তার রুমে টেলিভিশন ও আমোদ প্রমোদের যাবতীয় ব্যবস্হা করে  এবং জেল গার্ড ও কিছু কয়েদীদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলে।জেলে বসে এসময় সে বিখ্যাত  oz ম্যাগাজিনের রিচার্ড নেভিল ও আর এক সাংবাদিক  এ্যালান ডওসন এর সাথে সাক্ষাতকার প্রদান করে  এবং নির্দ্বিধায় সে তার সমস্ত অপকর্ম স্বীকার করে।কাগজে কলমে তার বিরুদ্ধে তিন চারটি মামলা থাকলেও শোভরাজ তার সাক্ষাৎ কার গ্রহণ কারি সাংবাদিকদের কাছে সে অকপটে দশবার টি হত্যার কথা স্বীকার করে।  তবে এসব হত্যাকাণ্ড কে সে পশ্চিমা সাম্রাজ্যেবাদের বিরুদ্ধে তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ বলে প্রচার করে বিশ্বব্যাপী তার অন্য ধরনের এক ভাব মূর্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করে। 
তবে  ভারতের আদালতের বিচারে শোভরাজ ও তার বান্ধবী মেরী এনড্রির  বার বছর সাজা হয়।এর মধ্যে মেরী এন্ড্রি জরায়ু ক্যান্সার আক্রান্ত হলে ভারত সরকার তাকে প্যারোলে মুক্তি প্রদান করে।মুক্তি পেয়ে সে তার স্বদেশ কানাডা চলে যায় এবং ১৯৮৪ সালে মারা যায় বলে জানা যায় । এদিকে শোভরাজের শাস্তির মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলে তার আশংকা হয় মুক্তির পর তাঁকে থাই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে যেখানে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি  মামলা চলমান ছিল এবং মৃত্যু দণ্ড ও ছিল অনিবার্য। অতএব সে তিহার জেল থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।সুতরাং মার্চ, ১৯৮৬ সালে তার আশু কারা মুক্তি উপলক্ষে জেল গার্ডদের জন্য এক রাজসিক ভোজের আয়োজন করে এবং কৌশলে সবাইকে মাদক প্রয়োগের মাধ্যমে অচেতন করে তিহার জেল থেকে পালিয়ে যায়।
তবে খুব সহসাই মুম্বাইয় পুলিশের ইনস্পেকটর মধুকর জেনডে তাকে গোয়ার একটি রেস্তোরাঁ থেকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। আদালত তার সাজার মেয়াদ আরো দশবছর বাড়িয়ে দেয় যেটা শোভরাজ কামনা করছিল যাতে করে সে থাই কর্তৃপক্ষের বিশবছর মেয়াদি এরেস্ট ওয়ারেন্ট থেকে বাঁচতে পারে। ১৯৯৭ সালে ৫২ বছর বয়সী শোভরাজ এর ভারতে সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে অনেক সাক্ষী সবুধ ও মামলার নথি পত্র  হারিয়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাবার কারণে  ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে নিজ দেশ ফ্রান্স চলে যাবার সম্মতি দেয়। 
ফ্রান্স ফিরে গিয়ে শোভরাজ একজন সেলিব্রিটি হিসেবে আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করতে থাকে এবং একজন পাবলিসিটি এজেন্ট নিয়োগ করে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সাক্ষাতকার ও ছবি ছাপার অনুমতি দিয়ে মিলিয়ন ডলার আয় রোজগার করতে থাকে। তার জীবন ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে ১৫ মিলিয়ন ডলার চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছে বলে ও জানা যায়।এছাড়াও কয়েকটি টিভি চ্যানেল তার জীবন ভিত্তিক ক্রাইম ড্রামা সিরিজ তৈরি করে। তাদের কাছ থেকে ও সে কয়েক মিলিয়ন ডলার রয়ালটি নিয়ে ছিল।তবে আবারও তার কপাল খারাপ! ১৭ ই সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে নেপালের রাস্তায় তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখে এক ঝানু সাংবাদিক তাকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।দেরি না করে তিনি নেপালী পুলিশ কে বিষয় টি অবহিত করলে নেপালের একটি হোটেলের ক্যাসিনো থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।তবে শোভরাজ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে নেপাল এসেছিল তা রহস্যময় ছিল।  আগেই নেপালে তার বিরুদ্ধে ব্রোনজিক ও কেরিরি নামক দুজন পর্যটক কে হত্যার অভিযোগে মামলা ছিল যার নথি সরবরাহ করেছিল ডাচ ডিপ্লোমেট নিপেনবার্গ এবং ইন্টারপোল । নেপালের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট শোভরাজ কে জাব্জ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। উচ্চ আদালতে আপিল করলে তার আপিল খারিজ হয়ে যায়।
ছিয়াত্তর বছর বয়সী শোভরাজ এখন নেপালের কারাগারে মুক্তির প্রহর গুনছে। এক নেপালী তরুনী নিহিতা বিস্বাস তার প্রেমে এখন মগ্ন। এদিকে তার পার্সিক স্ত্রী চানটাল ফরাসি প্রেসিডেন্ট সরকোজি কে মামলাটির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার আবেদন ও করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতে ও অভিযোগ করেছে যে নেপালের আদালত তার প্রতি সুবিচার করেনি।তার মতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৭৫ সালে অথচ সে ৭৫ সালে কখনো নেপাল ভ্রমণ করেনি।আসলে জাল পাসপোের্ট নিয়ে ভ্রমণ করার কারণে তখন নেপাল কর্তৃপক্ষ তাকে সঠিক  সনাক্ত করতে পারেনি।
শোভরাজের দাবি সে তার প্রেমিকা নিহিটা বিস্বাস কে ৯ই অক্টোবর, জেলে থাকা অবস্থায়  ২০০৮ সালে বিয়ে করেছে যদিও নেপালের জেল কর্তৃপক্ষ এটা অস্বীকার করেছে।
২০১৪ সালে নেপালের কারাগারে শোভরাজ গুরুতর অসুস্থ হয় এবং কয়েকবার তার ওপেন হার্ট সার্জারী হয়। তবে শোভরাজ তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি এতটা খ্যাতিমান হয়েছে যে ইতিমধ্যে তার জীবন কাহিনী নিয়ে ১৯৭৯ থমাস থম্পসন রচিত  Serpentine এবং ১৯৮০ সালে রিচার্ড নভিল ও জুলি ক্লার্ক রচিত Life and Crimes of Charles Sobhraj বেশ আলোড়ন তৈরি করে। পরের বইটির কাহিনি নিয়ে১৯৮৯ সালে টিভি সিরিয়াল Shadow of the Cobra তৈরি হয়।২০১৫ সালে বম্বেতে ম্যাঁয় আওর চার্লস নামে একটি হিন্দি ছবি ও তৈরি হয়।
এখন প্রশ্ন হলো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েক টি দেশে একজন বিদেশি এতগুলো অপরাধ কি ভাবে এত নির্বিঘ্নে করে যেতে পারল? তার প্রধান কারণ এসব দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অপেশাদারিত্ব, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দক্ষতার অভাব সর্বোপরি পশ্চিমের সাদা চামড়ার মানুষের প্রতি আমাদের সহজাত দুর্বলতা। আমাদের এশিয়া অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একধরনের পারসেপশন তৈরি হয়েছে যে পশ্চিমা মানুষ অপরাধ প্রবন নয়।তদুপরি শোভরাজ ছিল অত্যন্ত কৌশলী  এক নিপুণ অভিনেতা। সে যে দেশে অপরাধ সংঘটিত করত আগে সে দেশের ক্রিমিনাল ল সম্পর্কে বেশ ভালভাবে পড়াশোনা ও হোম ওয়ার্ক করত এবং আইনের ফাঁক ফোকর গুলো তার নখদর্পনে থাকত।এজন্য যখন তখন সে তার আইনজীবীদের Hire and Fire করত।
আসলে প্যারিসে সেলিব্রিটি জীবন যাপন করা সত্বেও কি কারণে ২০০৩ সালে শোভরাজ নেপাল আসল?  কোন নুতন এ্যাডভেঞ্চার এর আশায়?তার বয়স তখন প্রায় ষোটের কাটায়! এই বয়সে কি কোন এডভেঞ্চার মানায়?  নাকি নিয়তি তাকে টেনে আনল পাপের সাজা ভোগ করার জন্য?হয়ত সবই তার নিয়তি!এখন কি ভাবছে শোভরাজ এই পরন্ত বেলায় অসুস্থ শরীর নিয়ে জেলের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে? কোন অনুশোচনা আছে কি? মনেতো হয়না! সে যাই হোক শোভরাজ অপরাধ জগতে এখনো কিন্তু  এক জীবন্ত কিংবদন্তী।।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.