--- বিজ্ঞাপন ---

কোন দিকে যাবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

0

কাজী আবুল মনসুর##
মাওলানা শাহ আহমদ শফী মারা যাবার পর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ এর শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে দেশব্যাপী আলোচনা। কে হচ্ছেন সংগঠনটির আমীর এ প্রশ্নে কওমি মহল সরগরম। হেফাজতের নেতৃত্ব কি চট্টগ্রামে থাকছে নাকি চট্টগ্রামের বাইরে চলে যাচ্ছে, সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক নাকি সরকারের বিরোধীতা, কট্টরপন্থী কেউ কি দায়িত্ব নেবে নাকি যেভাবে চলছে সেভাবে এগুবে, এমনতর অনেক প্রশ্ন এখন দেশের বৃহত্তম এ সংগঠনের ভেতরে ও বাইরে। তবে মাওলানা শাহ আহমদ শফী যেভাবে সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে হেফাজতে ইসলামে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন সেভাবে আর হবে না বলে অনেকে মনে করছেন। কারন দলের মধ্যে এরই মধ্যে নানা গ্রুপ, নানা মত। হেফাজতে ইসলামের ২২৯ সদস্য শুরা কমিটিতে অনেকে বয়সের ভারে ন্যুজ। তবে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে এগিয়ে আছেন তিনি হলেন হেফাজতে ইসলামের দ্বীতিয় শীর্ষ নেতা মাওলানা মহিবুল্লা বাবুনগরী। যিনি এ সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা। তিনি বয়সের কারনে আমীরের পদ নিতে অপরাগতা প্রকাশ করতে পারেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
সূত্র জানায়, হেফাজতের অভ্যন্তরে দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি সরকারের সাথে সম্পর্ক ভালো রেখে চলতে চায়, অন্যটি সরকার বিরোধী। সংগঠনের ভেতরে সরকারের বিরুদ্ধে থাকা অংশটির সাথে যুক্ত রয়েছেন জাময়াতে ইসলামীর বড় অংশ। এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার পেছনে মাওলানা শাহ আহমদ শফীর সাথে অন্য আরও একজন ব্যাক্তি জড়িত ছিলেন। তিনি হলেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ইযহারুল ইসলাম। সংগঠনের শুরুতে চট্টগ্রামের একশ কওমি মাদ্রাসা এর অর্šÍভূক্ত থাকলেও পরে এর কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে সারা দেশের সবগুলো কওমি মাদ্রাসার সকলে এ সংগঠনের অর্ন্তভূক্ত। ফলে এটি ক্রমান্বয়ে বৃহত একটি সংগঠনে পরিনত হয়েছে। সারা দেশের জেলাগুলোতে রয়েছে এর কমিটি। কেন্দ্রীয়ভাবে ২২৯ জন সিনিয়র মাওলানা নিয়ে গঠিত শুরা কমিটি সব নিয়›ত্রন করেন। মাওলানা শফীর মৃত্যুর পর শুরা কমিটি নির্বাচন করবেন পরবর্তি আমীর কে হবেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ এর ১৯ জানুয়ারী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামক সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। গত ২০১০ সালে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১১ সালে এক বিবৃতিতে হেফাজত বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধীতায় নামে। তারা নীতিমালার কয়েকটি ধারাকে ইসলামের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক দাবি করে। প্রয়োজনে আন্দোলনের হুমকী দেয়। হেফাজতের এ ঘোষনার পর নড়েচড়ে বসে সুশিল সমাজ। তারা হেফাজতের এ কর্মকান্ডের প্রতিবাদ জানালে হেফাজত তাদের কর্মকান্ডে ১৩ দফা দাবী নিয়ে প্রকাশ্যে আসে। হেফাজতের ১৩ দফা দাবি নিয়ে দেশব্যাপি শোরগোল হলে এর ব্যাখ্যা নিয়ে গণমাধ্যমে হাজির হয় হেফাজত নেতারা। হেফাজত নেতারা উল্লেখ করেন, সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে। আল্লাহ্, রাসুল ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে। শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক এবং রাসুল এর নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। ইসলামবিরোধী নারী নীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা। মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসলিমদের নির্বিঘেœ নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা। রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ী-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিযয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা। রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র রাসুলপ্রেমিক জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা। সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা। অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও রাসুলপ্রেমিক জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান।’
হেফাজতে ইসলাম ২০১১ সালে প্রনীত ১৩ দফার দাবির পক্ষে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি দয়। ঢাকার শাপলা চত্বর এ সময় রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। তাদের কঠোরভাবে মোকাবেলা করে সরকার। হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের অনেকে গ্রেফতার হয়। সরকারের কঠোর তৎপরতায় কার্যত কোনঠাসা হতে শুরু করে হেফাজত। সরকারের সাথে সম্পর্ক রেখে হেফাজত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চেষ্টা শুরু করলে উভয় পক্ষের সমঝোতায় অনেক কিছু সহজ হয়ে আসে। হেফাজতের আমীর মাওলানা শফী সরকারের সাথে সম্পর্ক রেখে কওমি মাদ্রাসাগুলো হতে প্রাপ্ত ডিগ্রীর সরকারী স্বীকৃতি আদায় করে। হেফাজত কোন প্রকার জঙ্গী তৎপরতার সাথে যুক্ত নয় এটি প্রমানের জন্য কওমী মাদ্রাসাগুলোর দরজা সকলের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। হাটহাজারী মাদ্রাসায় দেশ-বিদেশের আমলা, রাজনীতিবিদ , কূটনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনের সকল স্তরের লোকজনকে স্বাগত জানানে হয়। এ অবস্থার পর তাদের অবস্থান সাধারন মানুষের কাছে অনেকটা নমনীয় হয়। এর জন্য মূলত হেফাজতের আমীর মাওলানা আহমদ শাহ শফী অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তার নির্দেশনায় দীর্ঘ কয়েক বছর হেফাজত আন্দোলন সংগ্রাম থেকে নিজেদের দুরে সরিয়ে রাখে।
তবে মাওলানা শফীর এ ভূমিকায় নাখোশ হেফাজতে ভেতরে থাকা বড় একটি অংশ। বলা হচ্ছে, অনেকে তার মৃত্যুর জন্য প্রতিক্ষায় ছিলেন। মাওলানা শফী সরকারের সাথে আতাঁত করে হেফাজতের মূল নীতি থেকে দুরে সরে গিয়েছেন এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কিন্ত শফীর গ্রহণযোগ্যতা, সমর্থন, ব্যাক্তিত্বের কাছে বিদ্রোহী পক্ষ সুবিধা করতে পারেন নি।
হাটহাজারী মাদ্রাসা হতে জম্ম হেফাজতে ইসলামের। এখানে বসেই কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন তিনি। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীরা সক্রিয় হয়ে উঠলে অভ্যন্তরে শুরু হয় আন্দোলন। যে আন্দোলনে তিনি টিকতে পারেন নি। মারা গেলেন মাওলানা শফী। বৃহত এ সংগঠনটির নীতি নির্ধারকরা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে ধংসাত্মক হবেন, নাকি মাওলানা শফীর পথ ধরে শান্তির পতে থাকবেন এটিই দেখার বিষয়।## ২১.৯.২০

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.