--- বিজ্ঞাপন ---

কোন পথে সৌদিআরব, হালাল নাইট ক্লাব নিয়ে তোলপাড়

0

কাজী আবুল মনসুর ::

সৌদিআরবের হালাল বার এর ছবি ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশ্ন উঠেছে দেশটির সামাজক পরিবর্তন নিয়ে। তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বে।দেশটি পূর্বের সকল প্রকার রক্ষণশীল রীতিনীতি উপেক্ষা করে নারী-পুরুষের সহ অবস্থানে সরগরম নাইট ক্লাবের দৃশ্য বের হওয়ার বিষয়টি নিয়ে খোদ সৌদিআরবেও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও এ সংক্রান্ত সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, রক্ষণশীল সৌদিআরব কি পশ্চিমা ধারায় যাচ্ছে কিনা।

দীর্ঘদিন ধরে সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে সৌদি আরব। দুই শতক ধরে ওহাবিজমের মতো কট্টর ইসলামী ধ্যানধারণা প্রচলিত দেশটিতে। সেখানে এখন পরিবর্তনের সুর। নারীরা গাড়ি চালানোর অধিকার পেয়েছেন। রেড সি’তে পর্যটকদের জন্য বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে। অর্থ্যাৎ নারীরা সেখানে বিকিনি পরতে পারবেন, থাকছে উন্মুক্ত বার। বোরকা ছাড়া শালিন পোশাকে বের হতে পারবে। স্বামী ছাড়া মার্কেটে যেতে পারবে। পরিবর্তনের এমন সুর কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। এসব কিছুর মূলে রয়েছেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি দেশটিকে উদারপন্থী মুসলিম দেশে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তার দেশকে আমূল বদলে দিতে চান। অবশ্য সৌদি যুবরাজের এই উদারপন্থি মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করছেন অনেকে। একে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হটানোর কৌশল ভাবছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার বলছেন, এটা দেশে বিনিয়োগের আকর্ষণের কৌশল।

সৌদিআরবের রাজমহলের অভ্যন্তরে নানা সমস্যা থাকলেও দেশটির সামাজিক পরিবর্তনে পশ্চিমা রীতিনীতি শুরু হয়েছে। সৌদিআরবের সাথে ইহুদি দেশ ইসরাইলের মিত্রতা হয়েছে। আমেরিকার ছাতার নিচে এখন সৌদিআরব। গণমাধ্যমে সৌদিআরবের রাজমহলের সমালোচনা সহ্য করা হয়না। সিনিয়র সাংবাদিক জামাল খাসেগি হত্যার মাধ্যমে জানান দেয়া হয়েছে আর যা হোক সমালোচনা করা যাবে না। জামালকে সৌদিআরবের লোকজন অন্য আরেকটি দেশে হত্যা করেছে। তাও দুতাবাসের ভেতরে। হত্যার জন্য বিশ্বব্যাপি আলোড়ন হলেও মূল নায়করা ধরাছোয়ার বাইরে থেকে গেছে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো সৌদিআরব এখন ইরানের পেছনে লেগেছে। এটা কি মার্কিন ইন্ধনে নাকি অন্যকিছু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সৌদিআরবের নিরাপত্তা জোরদার করার নামে সৌদিতে স্থায়ীভাবে ঢুকার চেষ্টায় আছে। অন্যদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান সৌদি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, আমেরিকা নয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের সামগ্রি রাশিয়াতেই উন্নত। কিন্ত সব মতামত উপেক্ষা করে সৌদিরা ঝুকছে আমেরিকার প্রতি।

আবার এরই মধ্যে সম্পর্কের খোলামেলা প্রকাশ ও উগ্র পোশাকসহ ‘প্রকাশ্যে শালীনতা’ লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরব। বিদেশি পর্যটকদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করার একদিন পর নানা সমালোচনা হলে এ ঘোষণা দেয় দেশটি, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের ১৯ ‘অপরাধ’ শনাক্ত করার কথা জানালেও জরিমানার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে জানায়নি।“নতুন আইনানুযায়ী পুরুষ ও নারীদের শালীন পোশাক পরতে হবে এবং প্রকাশ্যে অনুরাগ প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে। শালীন পোশাক পরার ক্ষেত্রে নারীরা স্বাধীনতা ভোগ করবে,” এক বিবৃতিতে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। “সৌদি আরবে আসা ভ্রমণকারী ও পর্যটকরা যেন রাজ্যটিতে প্রকাশ্যে চলাফেরার সঙ্গে সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে সজাগ থাকে ও তা মেনে চলে তা নিশ্চিত করতেই এ আইন করা হয়েছে।”তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পর্যটন শিল্পের প্রসারে বিদেশিদের জন্য প্রথমবারের মতো ভ্রমণ ভিসা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি আরব।ইতিমধ্যে ৪৯টি দেশের নাগরিকদের জন্য এই ভ্রমণ ভিসা চালুর ঘোষণা দেয়া হয় বলে জানিয়েছে বিবিসি। এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশসহ ওই ৪৯টি দেশের নাগরিকরা ই-ভিসায় বা অন অ্যারাইভেল ভিসায় সৌদি আরব ভ্রমণ করতে পারবেন। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো ও বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংস্কারে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, বলছেন পর্যবেক্ষকরা। সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যটক মিলিয়ে বছরে ১০ কোটি ভ্রমণপিপাসুকে আকৃষ্ট করে জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ নিশ্চিত করতে চায়; এ খাতে চাকরি সৃষ্টি করতে চায় অন্তত ১০ লাখ। সৌদি আরব এতদিন ধরে মূলত হজযাত্রী, ব্যবসায়ী এবং অভিবাসী শ্রমিকদেরই ভিসা দিত।

এত দিন সৌদি আরবের অর্থনীতি তেল দিয়ে চলেছে। ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় এখন পর্যটন, প্রযুক্তি, বাণিজ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে হাত বাড়াতে চাইছে দেশটি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে চাইছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মরুভূমিকে নতুন শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মূলত তেলভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রূপান্তর, নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি ও বিনিয়োগ বাড়াতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, উদারপন্থী ইসলামে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা সৌদি আরবের বাজার পরিকল্পনার একটি অংশ। তাদের মতে, শুধু ঘোষণা দিয়েই চরমপন্থা থেকে হুট করে বের হয়ে আসতে পারবে না দেশটি। এমন পদক্ষেপে সৌদি আরবে উল্টো অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
রাজধানী রিয়াদে অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রায় দুই হাজার বিদেশি বিনিয়োগকারী এতে উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে ৩৩ বছর বয়সী যুবরাজ আরও বলেছিলেন, ‘আমরা একটি স্বাভাবিক জীবন চাই। এমন একটি জীবন চাই যেখানে ধর্মের ভাষান্তর হবে সহনশীলতা ও আমাদের দয়ার ঐতিহ্য। সৌদি জনগণের ৭০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে এবং কোনো উগ্রবাদী আদর্শের সঙ্গে বুঝতে বুঝতে আমরা জীবনের বাকি ৩০টি বছর নষ্ট করতে পারি না। আমরা উগ্রপন্থাকে আজ, এখনই ধ্বংস করব। খুব শিগগিরই আমরা উগ্রপন্থার অবসান ঘটাব।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোহাম্মদ বিন সালমান মূলত সৌদি আরবের তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই তরুণ সম্প্রদায় ধর্মীয় দিক থেকে বয়স্কদের মতো গোড়া নয় এবং বর্তমান উচ্চ বেকারত্ব হারের মূল ভুক্তভোগী তারা। এদিকে তার সংস্কার চলাকালিন সময়ে ইয়েমেন সীমান্তের কাছে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে এক সৌদি প্রিন্স নিহত হয়েছিলেন। নিহত প্রিন্স মানসুর বিন মুকরিন সৌদি আরবের আসির প্রদেশের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্ঘটনার সময় হেলিকপ্টারটিতে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন। সৌদি সংবাদমাধ্যম এ সময় বলেছিল, নিয়মিত অনুসন্ধানী সফর শেষে ফেরার সময় প্রিন্স মানসুর ও সঙ্গী কর্মকর্তাদের নিয়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। এর কারণ এখনো জানা যায়নি। নিহত প্রিন্স মানসুর বিন মুকরিন আরেক সাবেক যুবরাজের ছেলে। তার বাবা মুকরিন বিন আবদুল আজিজ বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সৎভাই। ২০১৫ সালে বাদশাহ হওয়ার পর সালমান তার সৎভাই মুকরিন বিন আবদুল আজিজকে যুবরাজ পদ থেকে সরিয়ে দেন।
ঘটনাটি যে সময় ঘটে, তখন সৌদি আরবে দুর্নীতিবিরোধী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়।  দুর্নীতির অভিযোগে প্রিন্স আলওয়ালিদ বিন তালালসহ ১১ যুবরাজ ও চার মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। বরখাস্ত করা হয় নৌবাহিনীর প্রধানকে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীও গ্রেফতার হন। দুর্নীর অভিযোগে গ্রেফতার হয় হাজারেরও বেশি মানুষকে। সৌদি আরবে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি ডলারের দুর্নীতি হয়েছে বলে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সৌদ আল-মোজেব জানান দেন। এর আগে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ নতুন একটি দুর্নীতি দমন কমিটির ঘোষণা দেন। এই কমিটির প্রধান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। নতুন এই কমিটিকে তদন্ত, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাদশাহর জারি করা ডিক্রিতে বলা হয়, দুর্নীতির মূলোৎপাটন ছাড়া সৌদি আরব টিকতে পারবে না।
ধারণা করা হচ্ছে, শাসনব্যবস্থায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেই এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর পেছনে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যকে ছাপিয়ে আরও কিছু রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, যুবরাজ সালমান দেশের রাজনীতিতে যে সংস্কার করতে চান, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দুর্নীতির অজুহাতে তার বিরোধীদের শক্তিশালী পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। তুরস্কে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ উঠেছে সৌদি আরবের যুবরাজ সালমানের ইন্ধনে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর ক্ষমতা নিস্ককন্ঠক করার জন্য গ্রেফতার হওয়া প্রিন্সদের মধ্যে দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা প্রিন্স মিতেব বিন আবদুল্লাও ছিলেন। দেশটির ক্ষমতাধর ন্যাশনাল গার্ডের মন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে প্রিন্স খালেদ বিন আয়াফকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে আসলে ৩৫ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানেরই নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এত দিন সৌদি রাজপরিবারের অন্য একটি শাখার নিয়ন্ত্রণে ছিল এই মন্ত্রণালয়। প্রিন্স মিতেব হলেন প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর ছেলে। একসময় তাকেই সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে মনে করা হতো।

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবা সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ ২০১৫ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এক পর্যায়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে নিজের সন্তান মোহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ ঘোষণা করেন বাদশাহ সালমান। এরই মধ্যে প্রিন্স মোহাম্মদকে দেশটির জনগণ ‘ডি ফ্যাক্টো’ নেতা হিসেবে মনে করছেন। রদবদলের ফলে পুরো দেশের সব নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ পেলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এই যুবরাজ। তবে তিনি বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। সর্বপ্রথম তিনি নারীদের গাড়ি চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে রক্ষণশীল সৌদি সমাজে প্রথার বিরুদ্ধে হাঁটতে শুরু করেন। এরপর থেকে আরও নানা ধরনের সংস্কার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু আবেগী এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞ এই যুবরাজের সফলতার সম্ভাবনা কতটা? সৌদি যুবরাজ যে ঘোষণা দিয়েছেন, আদৌ তা বাস্তবায়ন করা হবে কি না-তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। সৌদি আরবে রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠী খুব প্রভাবশালী। দেশটির প্রশাসনেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আর সামাজিক প্রতিপত্তির কথা না বললেও চলে। যুবরাজের সাম্প্রতিক বক্তব্য এই গোষ্ঠীর জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ থেকে নতুন বিরোধ সৃষ্টি হবে, নাকি সত্যিই বদলে যাবে সৌদি আরব? উত্তরের জন্য আপাতত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।###২৩.৯.২০

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.