কাজী আবুল মনসুর ::
সুইস ব্যাংকে জমানো টাকা নিয়ে বিভিন্ন দেশে দেশে কৌতুহলের অন্ত নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর টাকা পাচারকারীদের টাকা রাখার নিরাপদ স্থান হচ্ছে সুইস ব্যাংক। টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রায় এক সূত্রে গাঁথা। ভারতে প্রায় সময় সুইস ব্যাংক নিয়ে হৈচৈ হলেও বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে তেমন একটা হৈচৈ হয় না। সুইস ব্যাংকে কখনও কারও টাকার পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয় না। তবে সুইস ব্যাংকের সাথে কোন দেশের তথ্য আদান প্রদানের সমঝোতা চুক্তি থাকলে তাহলে সুইস ব্যাংক তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে নমনীয় হয়। বিশেষ করে উন্নত অনেক দেশের চাপে সুইস ব্যাংক একাউন্ট এর তথ্য দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের সাথে সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কোন সমঝোতা চুক্তি নেই। চুক্তির জন্য বাংলাদেশ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তবে কোন সাড়া মিলছে না।
অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য ও পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানে এক সঙ্গে কাজ করতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ানেক আগেই চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিট (বিআইএফইউ) সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগকে চিঠি দিয়ে সার্বিক তথ্য জানাতে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক এগমন্ড গ্রুপের সদস্য দেশ হিসাবে এই প্রস্তাবটি দিয়েছে বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধ ও অর্থপাচার রোধসহ আর্থিক খাতের দুর্নীতিসহ যেকোনো ধরণের তথ্য-আদান প্রদানের জন্য গঠিত সংস্থার নাম এগমন্ড গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংক এগমন্ড গ্রুপের সদস্য। সুইজারল্যান্ডও এই গ্রুপের সদস্য দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিশ্বের ২৪টি দেশের এই ধরনের চুক্তি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা। তাদের মতে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের সঙ্গেই সুইস ব্যাংকের চুক্তি নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এব্যাপারে আশা ছাড়েনি।
সুইস ব্যাংক যেভাবে ব্যাংক আইন কঠোর করে
১৭১৩ সালে গ্রেড কাউন্সিল অফ জেনেভা ব্যাংকিং এর গোপনীয়তার নীতিমালা অনুসারে চলে বিশ্বের ব্যাংকিং সিসটেমের কার্যক্রম। একজন গ্রাহককে চরম গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেয়া হলো এই নীতিমালার অন্যতম শর্ত। কোন ব্যাংকার তার গ্রাহক ব্যতীত অন্য কারো সাথে কোনো তথ্য বিনিময় করতে বাধ্য নয়। কেন সুইস ব্যাংক বিশ্বের ধনবানদের কাছে এত পছন্দ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে নজর দিতে হয় ফ্রান্সের দিকে। উনিশ শতকের দিকে ইউরোপের দেশগুলোতে যখন নানা অস্থিরতা তখন বিত্তশালীরা নিরাপদ হিসেবে সুইজারল্যান্ডকে বেছে নেয়। বিশেষ করে ফ্রান্স এর বিপুল অর্থ সুইস ব্যাংকে চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপের দেশগুলোর বিত্তশালীরা সুইস ব্যাংকে টাকা জমানো শুরু করেন। ফ্রান্স সরকার তার লোকজন নিয়ে যখন অতিষ্ঠ তখন ১৯৩৪ সালের দিকে প্যারিসের সুইস ব্যাংক শাখায় হানা দিয়ে সব নথিপত্র জব্দ করে নেয়। এ ঘটনায় সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মনক্ষুন্ন হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ১৭১৩ সালের ব্যাংকিং আইনটি আরও কঠোর করবে। মূলত সে সময় সুইস ফেডারেল ব্যাংকিং ল’ নামের নতুন একটি আইনের সূচনা হয়। সাধারন ব্যাংকে অর্থ জমা দিতে হলে টাকার উৎস থেকে শুরু করে একগাদা তথ্য গ্রাহককে দিতে হয়। কিন্ত সুইস ব্যাংক এগুলো শিথিল করে আইনে উল্লেখ করে, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে হলে অর্থের উৎস জানানোর প্রয়োজন নেই। বয়স ১৮, একটি বৈধ পাসপোর্ট থাকলে সুইস ব্যাংকগুলোতে একাউন্ট করা যাবে। গ্রাহকের একটি কোড নাম্বার থাকে। সে নাম্বারটি ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তি ছাড়া কেউ জানেন না। আর ব্যাংকে জমানো টাকার উপর মুনাফাও আছে। সেই থেকে সুইস ব্যাংকের প্রতি বিশ্বের মানুষের এত আগ্রহ।
সুইস ব্যংক সর্ম্পকে বলতে গিয়ে সুইডেনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত হারুন রশিদ বলেন, ১৮৩০ সালের দিকে swish bank গুলো গঠন করা শুরু হয়েছিল। শুরুতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের bank-এর মতোই তাদের কাজকর্ম ছিল। ধীরে ধীরে তারা রেল পথ, বড় বড় রাস্তা, bridge, industry ইত্যাদিতে invest করা শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে তারা একটি নতুন পথ বেছে নেয়। চুরি, লুট এবং অসৎপথে অর্জন করা সম্পদ তাদের bank-এ রাখার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। Nazist-রা এই সুবিধাটা লুফে নেয়। বিশেষ করে বিশ্ব যুদ্ধের পর এই সুবিধাটা ব্যাবহার করা হয় ধনীদের টাকা এবং অসৎ পথে অর্জন করা টাকা লুকিয়ে রাখার জন্য, tax ফাঁকি দেওয়ার জন্য, dictator-দের লুট করা সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য ইত্যাদি। যার দরুন কিছু swish bank অল্পসময়ের মধ্যে অনেক অনেক ধনী হয়ে যায়। সম্পদ জমা ও উঠানো এবং transfer হতো স্বাভাবিক নিয়মে, হুন্ডির মাধ্যমে এবং বিভিন্ন বেআইনি পথে। Swish সরকারের পক্ষ থেকে এর জন্য কোন বাঁধা নেই। বর্তমানে swish bank card দিয়েও পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই টাকা উঠানো যায়। অনলাইনে এ টাকা জমা, উঠানো এবং transfer করা যায়।Customer পরিচয় এবং সম্পদের পরিমান সম্পুর্ণ গোপন থাকে। এমনকি বিশেষ করে বিদেশি customer পরিচয় এবং সম্পদ সম্বন্ধে swish সরকারেরও জানার অধিকার নেই। বিদেশিরা bank-এ যেয়ে বা online-এ account করতে পারবেন।১৮ বৎসর বয়স হতে হবে এবং passport নাম্বার. লাগবে। বর্তমানে বিশেষ করে USA-র চাপের জন্য bank গুলোর গোপনীয়তার অবসান হয়েছে। এখন তারা বাধ্য যে কোন লোকের account সম্বন্ধে জানাতে। কিন্তু তাদের bank-এ সম্পদ জমা এবং উঠানো আগের মতই হচ্ছে।
বাংলাদেশীদের যত টাকা
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বা এসএনবি। এসএনবি অবশ্য প্রতি বছর কোন দেশের গ্রাহকদের কত টাকা জমা আছে তার একটি হালনাগাদ তথ্য দেয়। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ বাংলাদেশীদের ২০১৯ সালে সুইস ব্যাংকে ৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা আছে। গত ২০০৯ সাল থেকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা রাখার পরিমান বাড়তে থাকে। ২০০৮ সালের তথ্য মতে, এ সময় বাংলাদেশীদের জমা ছিল ৮৯২ কোটি টাকা। কিন্ত ২০০৯ থেকে টাকার পরিমান বাড়তে থাকে দ্রুত। এ সময়ের মধ্যে বেড়েছে প্রায় ৬ গুন। বাংলাদেশী গ্রাহকদের ২০০৯ সালে ১,২৪১ কোটি টাকা, ২০১০ সালে ১,৯৬৮ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ১,২৯৫ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ১,৯০৮ কোটি টাকা,২০১৩ সালে ৩,১৬২ কোটি টাকা,২০১৪ সালে ৪,০৫৮ কোটি টাকা,২০১৫ সালে ৪,৪১৭ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ৫,৫৬৬ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ৪,১৬৯ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ৫,৩৭৩ কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে জমা আছে। এ টাকাগুলোর বেশিরভাগই দীর্ঘমেয়াদি স্কীমে আছে। সাধারনত যারা ডিজিটাল লেনদেন করেন তারাই তাদের টাকা নাড়াছাড়া করেন। তবে বেশিরভাগই তেমন একটা নাড়াছাড়া হয় না বললে চলে। পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশী টাকার পরিমান সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৩ ও ২০১৮ সালে।
ইতিহাস যা বলে,
সূত্র জানায়, দূর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার একটি বড় অংশ দেশ থেকে পাচার হয়ে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা হচ্ছে। এসব অর্জিত টাকা দেশে কেউ রাখতে চাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো। সুইস ব্যাংকগুলো যে দেশ-বিদেশের পাচার করা গোপন অর্থের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে, তার ইতিহাস বহু আগের। প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকেই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গোপন অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা চালু ছিল। ফ্রান্সের রাজাদের সঞ্চিত অর্থ গোপন রাখার প্রবণতা থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৭১৩ সালে জেনেভার সিটি কাউন্সিলে যে আইন করা হয়, তাতে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের হিসাব গোপন রাখার বিধান চালু করা হয়। কেবল গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও কাছে অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য জানানো ছিল নিষিদ্ধ। মূলত তখন থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার করে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে রাখার প্রবণতা শুরু হয়েছিল। আদিতে সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তা রক্ষার আইন ফৌজদারি ছিল না বিধায় গোপনীয়তা ভঙ্গের কারণে কোনো ব্যাংক কর্মচারীকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ১৯৩৪ সালের নতুন ব্যাংকিং আইন এই গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিকে ফেডারেল আইনে পরিণত করে আরও কঠোর করে দেওয়া হয়। ১৯২৯ সালের মহামন্দার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং আইনের এই সংশোধন প্রয়োজন ছিল। নতুন আইনে ব্যাংকিং গোপনীয়তার বিষয়টিকে ফৌজদারি দন্ডবিধির আওতায় নিয়ে আসা হয়, ফলে গোপনীয়তা ভঙ্গকারীর শাস্তি ছিল কারাদন্ড। জার্মানিতে হিটলারের শাসনামলে বিদেশে ধনসম্পদ জমা করার জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান চালু করা হলে সুইজারল্যান্ডে এই ব্যাংকিং গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপীয় ইহুদিরা তাদের সমুদয় সম্পদ সুইস ব্যাংকে জমা রাখা শুরু করে। যুদ্ধের ডামাডোলে বহু ইহুদি সুইস ব্যাংকের গোপন দলিলপত্র হারিয়ে ফেলে, ফলে যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তারা আর তাদের সঞ্চিত অর্থ ফেরত পায়নি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, সুইস ব্যাংকে যে কেবল ইহুদিদের সম্পদ গোপন করে রাখা হতো তা নয়, নাৎসি বাহিনী যুদ্ধবন্দী এবং অধিকৃত দেশ থেকে যে সম্পদ লুণ্ঠন করে, সেসবও গচ্ছিত রাখা হয়েছিল সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তায়। বিষয়টির মধ্যে কোনো আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। মার্কিন কুটনীতিবিদ স্টুয়ার্ট আইজেনস্ট্যাট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অর্থনৈতিক অসংগতি এবং ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ইমপারফেক্ট জাস্টিস: লুটেড অ্যাসেটস, স্লেভস লেবার, অ্যান্ড দ্য আনফিনিশড বিজনেস অব ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু-তে দেখিয়েছেন যে ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৪৫-এর জুন পর্যন্ত জার্মানি তখনকার মূল্যে ৪০ কোটি ডলারের স্বর্ণ ন্যাশনাল ব্যাংক অব বার্নে পাচার করেছে। ধারণা করা যায়, যুদ্ধের খরচ চালানোর জন্য নিয়ে যাওয়া এই স্বর্ণের বেশির ভাগই ছিল হতভাগ্য ইহুদিদের কাছ থেকে লুট করা। এসব স্বর্ণালংকার অন্যান্য সোনার সঙ্গে মিশিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়। এতে ধারণা করা যায় যে, সুইজারল্যান্ড জার্মান আগ্রাসনের ভয় করছিল।যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে সুইস-ওয়াশিংটন চুক্তির অধীনে সুইস সরকার ত্রিপক্ষীয় গোল্ড কমিশনের কাছে প্রায় ছয় কোটি (৫.৮) ডলারের সমপরিমাণ স্বর্ণ হস্তান্তর করতে সম্মত হয়। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফরাসি সরকার জার্মানি থেকে প্রাপ্ত সব স্বর্ণের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড এবং সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের সম্পৃক্ততার দাবি ছেড়ে দেয়। এর ফলে ষাটের দশক পর্যন্ত সুইস ফেডারেল আইনের কারণে সেখানকার ব্যাংক, অ্যাটর্নি অফিস, ট্রাস্টিসহ সর্বত্র জার্মান সহিংসতার শিকার এবং উদ্বাস্তুদের সুপ্ত হিসাব খুঁজে বের করার কাজ চলে। এভাবে খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় ২৪ লাখ ডলার, (১৯৬২-এর মূল্যমানে) যা যোগ্য উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে একটা ঘটনা সুইস ব্যাংকের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টাকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডের (ইউবিএস) এক প্রহরী ধ্বংস করে ফেলার ঠিক আগে ব্যাংকের কিছু পুরোনো লেজার আবিষ্কার করে, যেখানে জার্মানিতে ইহুদি নিধনের সময়কার অ্যাকাউন্টের হিসাব ছিল। বার্লিনসহ বিভিন্ন শহরের ঠিকানাসংবলিত সেই সব হিসাব দেখে ক্রিস্টোফার মেইলি নামের সেই প্রহরী সেসব লেজার তুলে দেন একটা ইহুদি সাহায্য সংস্থার কাছে। বিষয়টি সুইস আইনে অপরাধ হলেও মেইলি এই ঐতিহাসিক দলিল ধ্বংস হতে দিতে চাননি। জার্মানিতে ইহুদি নিধনের সময়কার হিসাবপত্র দেওয়ার জন্য সুইস ব্যাংকগুলো বিভিন্নমুখী চাপের মুখে থাকলেও মেইলির এই বোমা ফাটানো ঘটনা তাদের নতুন চাপের মুখে ফেলে দেয়। শাস্তি এড়ানোর জন্য মেইলি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। মেইলির এই উদ্ঘাটন অবশ্য সুইজারল্যান্ডের মানুষ এবং সংবাদমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এক পক্ষ মেইলির সাহসী বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের প্রশংসা করে, অন্য পক্ষ তাঁকে দেশপ্রেমরহিত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, পরের বছরই সুইস ব্যাংকের তরফ থেকে ইহুদি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ১২৫ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ রফা হয়। ঘটনাটা ইউবিএস কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলে দেয়, কারণ এটি নতুন সুইস আইনে জার্মানি কর্তৃক ইহুদি নিধনের প্রমাণস্বরূপ যেকোনো আলামত সংরক্ষণ করার যে বিধান রয়েছে তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফলে বিষয়টা যে এক দুঃখজনক ভুল, সেটা স্বীকার করতেও হয়েছে তাদের। কোনো প্রাচীন দলিল ধ্বংস করার আগে ব্যাংকের নিজস্ব একজন ইতিহাসবিদ সেসব পরীক্ষা করে দেখতেন যে সেগুলোতে ইহুদি নিধন সম্পর্কে কোনো প্রমাণ রয়েছে কি না। মেইলির আবিষ্কারের আগে আরও যেসব দলিল ধ্বংস করা হয়েছে, সেখানে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি বলে সেই ইতিহাসবিদ সেসব ধ্বংসের অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে ধ্বংস করা দলিলগুলোর কোনো তালিকা না রাখার কারণে সেই ইতিহাসবিদকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। অবশ্য মেইলি একা নন, পরবর্তী সময়ে রুডলফ এলমার নামের একজন সুইস ব্যাংক কর্মকর্তা কর ফাঁকি দেওয়ার টাকার হিসাব ফাঁস করে দেওয়ার পর সুইস কর্তৃপক্ষ তার পেছনে লাগে। উইকিলিকসকে দেওয়া তার তথ্যগুলো কর ফাঁকি দেওয়া কালোটাকার অভয়ারণ্য হিসেবে সুইস ব্যাংকের ভূমিকা আর গোপন থাকে না। এরপর ব্র্যাডলি বার্কেনফেল্ড নামের আর একজনের ভূমিকার কারণে ইউবিএস আরও একবার কর ফাঁকিতে সহায়তা করার জন্য ধরা পড়ে। এর জন্য ইউবিএসকে সাত কোটি ৮০ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় সাড়ে চার হাজার সন্দেহভাজন মার্কিন করখেলাপি হিসাবধারীর তালিকা সরবরাহ করতে হয়। আগে সুইজারল্যান্ডের এই ব্যাংকটি আমানতকারীদের টাকা অত্যন্ত গোপনে রেখে দিত। ফলে বিশেষ করে দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির টাকা এই ব্যাংকে জমা রাখত।
কলংকের দায় এড়াতে বিভিন্ন দেশের টাকার পরিমান প্রকাশ শুরু
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে দেশটি দুর্নীতিবাজদের টাকার নিরাপদ জিম্মাদার হওয়ায় সারা বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ফলে তারা দুর্নীতির টাকার কলংকের দায় এড়াতে ২০০২ সাল থেকে বিদেশী আমানতকারীদের দেশওয়ারি টাকার পরিমাণ প্রকাশ করতে শুরু করে। এতেই সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। একই সঙ্গে আইনের সুযোগে অনেক দেশ পাচারের তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে। এসব কারণে সুইস ব্যাংক থেকে দুর্নীতিবাজরা টাকা উঠিয়ে নিতে শুরু করেন। নতুন করে টাকা জমা হচ্ছেও কম। ফলে এখন আমানতের পরিমাণ কমতে শুরু করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সুইস ব্যাংকে বিদেশীদের জমা টাকার পরিমাণ ২০০৭ সাল পর্যন্ত বেড়েছে। এরপর থেকে কমতে শুরু করে। সুইস ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৫ সালে ব্যাংকে বিদেশীদের আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ফ্রাঁ। ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯০ হাজার ফ্রাঁ। ওই এক বছরে আমানত বেড়েছে ২৮ লাখ ফ্রাঁ। শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধির হার ১৭ দশমকি ২৮ শতাংশ। ২০০৭ সালে তা আরও ১৭ লাখ ফ্রাঁ বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭ লাখ ফ্রাঁয়। ওই বছরে বিদেশীদের আমানতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০৮ সাল থেকেই সুইস ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ কমতে থাকে। ওই বছরে ২০০৭ সালের তুলনায় আমানতের পরিমাণ ৩৩ লাখ ফ্রাঁ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৪ লাখ ফ্রাঁ। ওই সময়ে আমানত কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। ২০০৯ সালে আরও ৪০ লাখ ফ্রাঁ থেকে কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৪ লাখ ফ্রাঁ। ওই সময়ে শতকরা হিসাবে কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। ২০১০ সালে আমানতের পরিমাণ আবার সামান্য বাড়ে। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ১ লাখ ফ্রাঁ বেড়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ ফ্রাঁয় দাঁড়ায়। ওই এক বছরে শতকরা হিসাবে আমানত বেড়েছে দশমিক ৭৫ শতাংশ। অবশ্য এ সময় বাংলাদেশ থেকে বিপুল আমানত গেছে। ২০০৮ সালে ৮৯২ কোটি টাকার আমানত ২০০৯ সালে বেড়ে দাড়ায় ১,২৪১ কোটিতে। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে আমানতের পরিমাণ ৫ লাখ ফ্রাঁ বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁয়। শতকরা হিসাবে ওই এক বছরে বিদেশী আমানত বেড়েছে ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১২ সাল থেকে ব্যাংকের আমানত আবার কমতে থাকে। যা ২০১৩ সালেও অব্যাহত রয়েছে। পরের বছরগুলোতে টাকার পরিমান কম বেশি উঠা নামা করেছে। ২০১২ সালে ব্যাংকের আমানত ২০১১ সালের তুলনায় ১১ লাখ ফ্রাঁ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাঁয়। ওই সময়ে আমানত কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে আমানতের পরিমাণ ৫ লাখ ফ্রাঁ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৪ লাখ ফ্রাঁয়। ওই বছরে শতকরা হিসাবে কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। এ সময়ও বাংলাদেশী গ্রাহরা সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখার ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। ২০১২ সালে সুইস ব্যাংকের সার্বিক আমানত কমলেও বাংলাদেশী গ্রাহকদের টাকার পরিমান ২০১২ সালে ১,৯০৮ থেকে ২০১৩ সালে এক লাফে ৩,১৬২ কোটিতে উন্নিত হয়।
সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সুইস ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি টাকা জমা রেখেছে ভারতের নাগরিকরা। এরপর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। পিছিয়ে নেই আফগানিস্তানও। নেপাল, শ্রীলঙ্কা আর মালদ্বিপের পরই রয়েছে আফগানরা। বাংলাদেশের গ্রাহকদের টাকার পরিমান প্রতিবছর বেড়ে চলেছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের টাকা জমানোর পরিমান হ্রাস করতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।### ৩.১০.২০