রেফায়াত কবির শাওন ##
সেই চুরানব্বইতে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছিলাম। টেকনাফ পৌঁছে দেখি উলুবেনিয়া সীমান্তে মায়ানমারের সাথে যুদ্ধ বাঁধায় সেন্টমার্টিনের সাথে জাহাজ চলাচল বন্ধ। সে সময় জাহাজ বলতে কাঠের তৈরি ফিসিং ট্রলার। অনেক অনুরোধের পর জাহাজ মালিক জানাল আরও কিছু যাত্রী পেলে সে জাহাজ ছাড়বে। শেষমেশ কিছু স্থানীয় লোকজন জুটে গেলে জাহাজ ছাড়ল। টুরিস্ট বলতে আমরা চারজনই। জাহাজে ওঠার সময় কি মনে করে এক বন্ধু বেশ কিছু হকের চকোলেট ডাইজেস্টিভ বিস্কুট কিনে নিল। তাতে আমরা অনেক হাসাহাসি করলেও ওইদিন ওই বিস্কুট খেয়েই থাকতে হয়েছিল। সে সময় সেন্টমার্টিনে যে দুএকটি হোটেল ছিল তাও যুদ্ধের কারণে বন্ধ। তার উপর ছোট বোটে লম্বা জার্নি। ভাগ্যিস বিস্কুটগুলো ছিল।
আজকে এত বছর পরও সেই ডাইজেস্টিভ চকলেট বিস্কুট সমান জনপ্রিয়। লাল প্যাকেটে নাবিস্কো বিস্কুট আর স্বচ্ছ প্যাকেটে হলুদ রঙের ওয়েফার ছাড়া ছোট বেলায় খাওয়া প্রায় সব ধরণের বিস্কুট এখনও পাওয়া যায়। সেই সাথে নতুন নতুন হাজারো বিস্কুট এখন মার্কেটে। বাংলাদেশের দেশীয় পণ্যের মধ্যে বিস্কুটের যত ভ্যারাইটি আছে তা আর কোন কিছুতেই নাই। আমি নিশ্চিত আমাদের জিডিপি গ্রোথ আর মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তরের পেছনে বিস্কুটের বড় ভুমিকা আছে। ভবিষ্যতে বিজিএমইএ এর মত বিবিএমইএ (Bangladesh Biscuit Manufacturer and Exporters Association) তৈরি হবে, যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্কুট নিয়ে দেন দরবার করবে। সেই সংগঠনের সভাপতি ময়দাকে তন্দুরে দিয়ে বিস্কুট বানানোর পেছনে যে কঠোর সাধনা তার উপর মোটিভেশনাল স্পিচ দেবেন।
তবে বিস্কুট ব্যবসায়ীদের একটা বড় গুন, যতই নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনুন না কেন, তাঁরা কিন্তু ঐতিহ্য সচেতন। যেমন ওয়েলফুড, পিটসটপের মত বড় ব্র্যান্ডগুলো বিদেশি ঘরানার বিস্কুট বাজারে আনলেও, দেশীয় বেলা আর নিমকির মত ঐতিহ্যবাহী বিস্কুটগুলো কিন্তু বাদ দেয় নি। বরং আধুনিক মোড়কে পুরনো বিস্কুটগুলোকে আরও আকর্ষনীয় ভাবে উপস্থাপন করছে।
কলেজে পড়ার সময় এক বন্ধুর দাবা খেলার কারণে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে ছিলাম কলেজে। জুলজি’র নূর স্যারের রুমে চলছিল খেলা। সন্ধ্যায় স্যার সবার জন্য বেলা বিস্কুট আর চা আনালেন। আমরা স্যার কিছু মনে করবেন দেখে বেলা বিস্কুট চায়ে চুবিয়ে খেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। রাশভারি স্যার, গম্ভীর গলায় বললেন বেলা বিস্কুটের গ্রামার হচ্ছে চা’য়ে চুবিয়ে খাওয়া।
ওয়েলফুড পিটস্টপের ব্র্যান্ন্ডিং এর আগে আমাদের চট্টগ্রামে বেলা বিস্কুটের জন্য বিখ্যাত ছিল গনি বেকারি আর আবেদিন বেকারি। শহরের সব বাড়িতে এদের বেলা থাকত। আমার বাবা বেলা বিস্কুট খাওয়ার কিছু নিজস্ব কায়দা কানুন আবিস্কার করেছিলেন। আমরা মাঝে মাঝে বাটার আর জেলি দিয়েও বেলা বিস্কুট খেতাম।
পাড়ার বেকারিগুলোতে আরেক ধরণের বিস্কুট বিক্রি হয়। সম্ভবত আগেকার দিনে এই বিস্কুটগুলো পাউন্ডে ওজন মাপা হত বলে এদেরকে পাউন্ড বিস্কুট বলে। কিছুটা নরম এই বিস্কুটগুলো বরাবরই প্যাকেটজাত বিস্কুটগুলো থেকে স্বাদে ভাল। আমাদের ছোট বেলায় সেভয়, ডাইনেস্টি, সালাম বেকারির এই ধরণের বিস্কুটগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন এই বেকারি গুলোর একটাও অবশিষ্ট নেই।
আমার বন্ধু Syed Mohammad Harun কয়েকটি ব্র্যান্ডের বিস্কুট দেখলে রীতিমত রেগে ওঠেন। অনেক চাপাচাপি করার পর তাঁর এই অদ্ভুত রাগের কারণ জানলাম। ওই বিস্কুটগুলো গরম চায়ে চুবালে সাথে সাথে ভেঙে যায়। তাঁর মতে ভাল বিস্কিট হতে হলে ওই বিস্কিটের কমপক্ষে সাড়ে তিন সেকেন্ড গরম চায়ে টিকে থাকার মত স্থিতিস্থাপকতা থাকতে হবে। আমার বর্তমান কর্মজীবনের সবচেয়ে সিনিয়র কলিগ পদার্থবিদ্যার শিক্ষক প্রবীর স্যারের মতে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়া ভাল খান্দানের লক্ষণ। তাই তিনি কখনও বিস্কিট ছাড়া চা খান না। এজন্য তাঁর ডেস্কেরে পাশেই থাকে বিস্কুটের টিন। আর আমরা সময়ে অসময়ে হামলে পরি সেখানে।
তবে বিস্কুটকে বিস্কুট বলায় একদিন মহা বিপদে পড়েছিলাম। এক জ্ঞানী লোক বললেন শব্দটা বিস্কুট নয় বিস্কিট। ইংরেজরা এভাবেই বলে। আরে ভাই আমাদের বিস্কুট এখন আর ইংরেজি শব্দ নয়। এটি এখন তৎসম, তদ্ভবের নিয়ম নীতি পেরিয়ে খাঁটি বাংলা বিস্কুট। কিছু লোকের এই বিদেশি উচ্চারণ প্রীতিতে বিস্কুটের স্বাদটাই মাটি। চা’তে চুবিয়ে মহা আনন্দে বেলা বিস্কুট খাওয়া যায়, স্টাইলিশ বিস্কিট নয়। ইংরেজিভাষী আমেরিকানরাও কিন্তু বিস্কুট নিয়ে তাদের স্বকীয়তা ধরে রেখেছে। বৃটেনের বিস্কুট শক্ত, কিন্তু উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে বিস্কুট নরম, কিছুটা রুটির মত। বৃটিশরা বিশেষ ধরনের বিস্কুটকে বলে কুকিজ আর ক্র্যাকার। আর আমেরিকনদের কাছে বিস্কুট মাত্রই কুকিজ বা ক্র্যাকার। কিছু অল্পবিদ্যান বাঙালীর কাছে আপনাকে হয় বৃটিশ বা আমেরিকান হতে হবে, বাঙালী হলে চলবে না। এরা কোনদিন বিস্কুটের স্বাদ পাবে না।
বিস্কুট নিয়ে এত কথা বলার কারণ হচ্ছে, গত তিন মাসে যে পরিমান বিস্কুট খেয়েছি ইহজনমে ততগুলি বিস্কুট খাই নাই। কিছুটা অভ্যাস আর কিছুটা পেশাগত কারণে আমি আরলি রাইজার আর আরলি ব্রেকফাস্টার। তাই বেলা এগারোটা বাজতে আবার ক্ষিদা লাগে আর অবধারিতভাবে এই সময় সিঙ্গারা আর ডালপুরি খেতে হয়। সাথে এক কাপ ঘন দুধের চা। আজ তিন মাস হতে চলল, এগারোটার সময় সিঙ্গাড়া না খেয়ে বিস্কুট খাচ্ছি। বিস্কুটের যতই বৈচিত্র্য থাকুক ডালপুরি সিঙাড়ার জায়গায় বিস্কুট খাওয়া, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর চেয়েও খারাপ।
সিঙাড়া বিস্কুটের মত সৌভাগ্যবান নয়। এই জিনিষটার প্রপার ব্র্যান্ডিং হয় নি। কোন কোন কোম্পানী ফ্রোজেন সিঙ্গাড়ার ব্যবসা করছে বটে তবে তা রাস্তার পাশের গরম গরম সিঙ্গাড়ার মত নয় । তাছাড়া তথাকথিত বড় দোকানের পেল্লাই সাইজের সিঙ্গাড়া যেগুলোতে বাদাম থেকে বুট সবকিছু ঢোকানো হয় তাও স্বাদে তেমন ভাল নয়। রাস্তার পাশে শুধু আলু দিয়ে তৈরি সদ্য কড়াই থেকে নামানো গরম সিঙ্গাড়ার সাথে কোন কিছুর তুলনা চলে না। আমরা কয়েকজন কলিগ রীতিমত উৎসব করে সিঙ্গাড়া আর ডালপুরি খাই। আমার কর্মস্থল নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি। সেখান থেকে উত্তরে শপিং কমপ্লেক্স এলাকা থেকে দক্ষিণে মেডিকেল কলেজের সামনে ঝাল বিতান পযর্ন্ত যত ধরণের সিঙ্গাড়া আর ডালপুরি পাওয়া যায় সে ব্যাপারে আমরা রীতিমত বিশেষজ্ঞ। সবচেয়ে ভাল লাগে সুফিয়া হোটেলে শষা পেঁয়াজের সালাদের সাথে হোটেলের নিজস্ব রেসিপিতে তৈরি কাসুন্দির সাথে সিঙ্গাড়া। ক্লান্তিময় কাজে আধঘন্টার টিফিন ব্রেকে এই ভোজ শুধু উদরপূর্তি নয়, মনও ভরে।
আজ তিনমাস এই অমৃতসম খাবার থেকে বঞ্চিত। আবার সেই সিঙ্গাড়া খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকব তো।