--- বিজ্ঞাপন ---

আফগান নারী ফওজিয়া, মৃত্যু যার পেছনে ঘুরে

0

বিশেষ প্রতিনিধি ##

আফগানিস্তানের সংগ্রামী এক নারীর নাম ফওজিয়া কুফি। বলা হচ্ছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য এ নামটি এগিয়ে। আফগান তালেবানদের মৃত্যু ঝুকি মাথায় নিয়ে ফওজিয়ার দিন চলে। কখন মৃত্যু এসে দরজায় দাড়ায় সেদিকে চেয়ে থাকে ফওজিয়া।

 ফওজিয়াকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্লগার আশীষ বাবলু লেখেন,  ওর জন্মের পর পরই ফেলে দেওয়া হয়েছিল। একটুকরো কাপড় জরিয়ে তুলতুলে নবজাত ফওজিয়াকে প্রচন্ড রোদ আর গরম বালির বিছানায় ফেলে রাখা হয়েছিল। কামনা করা হয়েছিল ওর মৃত্যু। শুনলে আশ্চর্য হবেন যে এমন কাজটি করেছিলেন সে হচ্ছে ওর জন্মদাতা মা। আমরা জানি, কু-সন্তান কখোনো হয়, কু-মাতা কখোনো নয়। সন্তানের মৃত্যু কামনা যখন কোনো মা করেন তখন একটু চিন্তিত হতে হয় বৈকি!
ফওজিয়ার মা কোনো মানসিক ব্যাধিতে ভুগছিলেন না। ঊনি ছিলেন তা’র স্বামীর সাতটি বিবির একজন। সাত সতিনের ঘর। ফওজিয়ার জন্মের কয়েক মাস আগে ওর পিতার ১৪বছর বয়স্কা সপ্তম বিবিটি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। ফওজিয়া তখন মায়ের জঠরে হাত পা নাড়ছিল, ওর মা মনে প্রানে চাইছিলেন একটি ছেলে হোক, তা’না হলে এতগুলো সতিনের ঘরে তালাকের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।
আফগানিস্তানে একটি মেয়ের মূল্য গৃহপালিত ছাগলটির চাইতে কম। ছাগল দুধ দেয়, মাংশ দেবে,চামড়াটি বিক্রি করলে এক হপ্তার রুটির দাম পাওয়া যাবে। মেয়েদের কি মূল্য আছে? মেয়ের জন্য প্রতিদিন খাবার জোগার করতে হবে, বিয়ের জন্য বিশাল যৌতুক। তাই ফওজিয়ার জন্ম ওর মায়ের জন্য ছিল এক দুঃস্বপ্ন। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওর মা ওকে ফেলে এসেছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে, কর্কশ প্রান্তরে যেখানে মৃত্যু ঘুড়ে বেড়াচ্ছে এক টিলা থেকে অন্য টিলায়। সেখানে বেঁচে
থাকতে হলে ক্যাকটাস হতে হয়। এমন অব্যার্থ মৃত্যুর পরিপাটি ব্যাবস্থার মাঝখানেও সেই কথাটিই সত্যি হলো- রাখে আল্লা মারে কে! ফওজিয়া মরেনি। আকাশ থেকে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা শবনম ওর কচি ঠোট ভিজিয়ে দিয়েছে। দূরে মুয়াজ্জীনের আজানের সুর ওকে ঘুম পাড়িয়েছ। এক মুসাফির সেখান থেকে কুড়িয়ে ওকে তুলে দিয়েছিল ওর মায়ের কাছে। রোদে ঝলসানো অর্ধমৃত শিশু ফওজিয়া কোন শক্তিবলে টের পেয়েছিল ওর মায়ের শরীরের গন্ধ। ছোট্ট দুটি হাতে আক্ড়ে ধরেছিল পৃথিবীর তাবৎ মানুষের শান্তির আশ্রয়, মায়ের বুক। সেই মূহুর্তে মা ফওজিয়াকে বুকে চেপে কসম খেয়েছিলেন আমি বেঁচে থাকতে এ মেয়ের ক্ষতি করার সাধ্যি কারো নেই। কথা রেখেছিলেন ওর মা। তালিবান বেষ্টিত আফগানিস্তানে
মেয়েকে ইস্কুলে পাঠিয়েছিলেন। মেয়েকে সব বাধাঁ প্রতিহত করে ডাক্তারী পড়িয়েছেন।
ফওজিয়া কুফি এখন আফগানিস্তানের পার্লামেন্টে মহিলা ডেপুটি স্পিকার। অন্য দশটা দেশের স্পিকারের মত জীবন কিন্তু
আফগানিস্তানের স্পিকারের নয়। প্রতিদিন ফওজিয়া পাচ্ছেন মৃত্যুর পরোয়ানা আর বিবাহের প্রস্তাব। হয় বিয়ে কর নাহয় মর!
এইতো সেদিন গুলিতে ঝাঝড়া করে দিয়েছিল ফওজিয়ার গাড়ী। কি ভাবে
বেঁচে গেছে ভাবতে আশ্চর্য লাগে। আবার বলতে হয়- রাখে আল্লা…..। ফওজিয়ার আশা আগামীতে প্রেসিডেন্ট পদপার্থী হিসেবে দাড়াবেন। তবে কথাটা শেষ করলেন তিনটি শব্দ দিয়ে, যদি-বেঁচে-থাকি। ফওজিয়ার জীবনে মা সব প্রেরনার উৎস। পিতস্মৃতি বলতে তেমন কিছু নেই। ওর বাবা ওকে কোনদিন আদর করা দূরে থাক, নাম ধরে ডাকেনি। ওকে দেখলে ওর বাবা বলতো- দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে। এছাড়া আর কোন কথা ওর বাবা কখনো ওকে কোনদিন বলেনি। হয়ত বাবার মনে কোন ধরনের কষ্ট ছিল।
ফওজিয়া একে একে বাবা, ভাই, স্বামীকে হারান। তারপরও থেমে থাকা হয় নি। নিজের মনোবল অটুট রেখে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন সাহসের সাথে।

ফওজিয়া কুফি। আফগানিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি-র প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট। রাজনীতিবিদ, নারী অধিকার কর্মী এবং দোহায় তালিবানের সঙ্গে চলতি শান্তি বৈঠকে প্রধান আলোচনাকারী। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের । দোহা থেকে কথা বললেন ভারতীয় সাংবাদিক অগ্নি রায়ের সঙ্গে।

ফওজিয়া বলেন,  ‘বাবা, স্বামী, ভাইকে হারিয়েছি যুদ্ধে। আমার দেহ বিক্ষত হয়েছে। বার বার হামলা হয়েছে। বুকের তিন সেন্টিমিটার পাশ দিয়ে গুলি চলে গিয়েছে। শরীরে ক্ষত মেরামতির জন্য (ওপেন উন্ড) এখনও নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হয়। ডান হাত ভাল কাজ করে না। অনেক বেদনার মুহূর্ত পার হয়ে এসেছি। বুলেটের শক্তিতে যে জয়লাভ করা যায় না, সেটা বোঝানোই এখন আমার কাজ।এটা কোনও ব্যক্তিগত অর্জনের বিষয় হিসেবে আমি দেখছি না। নোবেল পাই বা না পাই, এই যে এত দূর পৌঁছতে পারলাম, এটা আমার দেশের নারীশক্তির পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তালিবান যুগে নারীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হত। আর এই প্রথম আফগানিস্তানের কোনও নারী নোবেলে মনোনয়ন পর্যন্ত পৌঁছলেন। ভবিষ্যতে সমঅধিকারের জন্য লড়াইয়ের পাথেয় হয়ে থাকবে এই স্বীকৃতি। এর পর বিশ্ববাসী আফগান নারীকে হেলাফেলা করতে পারবেন না। তা ছাড়া, আমি এবং আরও যে মহিলারা তালিবানের সঙ্গে শান্তি-আলোচনার অংশ নিয়েছেন, আমাদের হাত শক্ত হবে।অবশ্যই এক দিনে এই টেবিলে এসে বসতে পারিনি। ২০১০ সালে আমার কনভয়ের উপর তালিবান হামলা হয়েছিল, মরে যাওয়ার কথা ছিল আমার। সে সময় আমার দেশবাসীর কাছ থেকে অঢেল শক্তিও পেয়েছি। তবে দীর্ঘদিন ধরেই তালিবান কন্টাক্ট গ্রুপগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখা শুরু করেছিলাম। তালিবানের মধ্যে এমন অনেক অংশ বা সংগঠন রয়েছে যারা ততটা কট্টর নয়, নারীদের অধিকার সম্পর্কে অনেকটাই উদার মনোভাব নিয়ে চলে। তাদের সঙ্গে এবং তাদের মাধ্যমে কাজ করেছি। আজও যে সবাই মহিলাদের ব্যাপারে সদয় তা নয়। তার মধ্যেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগোতে হবে।

আফগানিস্তানের নারীরা এই বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। সংখ্যালঘুরাও। গৃহযুদ্ধের সময় তাঁরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তালিবানের ওই জমানা আফগানিস্তানের ইতিহাস নয়। অতীতে আফগানি নারীরাই স্থানীয় সমস্ত সমস্যা, সংঘাত মেটাতে ভূমিকা নিত। আমাদের মহিলা কবিদের ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ। তালিবানকে দেশের ইতিহাসকে বুঝতেই হবে।’

ফওজিয়া আশাবাদী। নিজের দেশকে নিয়ে স্বপ্ন অনেক। আফগানিস্তানের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে লড়াই করে চলেছেন ফওজিয়া। হয়ত একদিন আফগানিস্তান হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ও সমৃদ্ধশালী দেশ। ফওজিয়ার মতো অনেক নারীই এথন এগিয়ে আসছে। তারা একটি নতুন আফগানিস্তান তৈরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।### ১৪.১০.২০

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.