--- বিজ্ঞাপন ---

বিবিসির খবর

করোনা বন্দীর রোজনামচা...১

0
রেফায়াত কবির শাওন ##
পিতৃকুলের কাছ থেকে কয়েকটা অভ্যাস, মতান্তরে বদঅভ্যাস পেয়েছি। এক. কাঁচাবাজারে দরদাম না করা। দুই. সংবাদপত্রে আসক্তি। তিন. বিবিসি। দাদাজান বিলেতি কোম্পানীতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে আনিয়ে নিতেন টাইমস, গার্ডিয়ান সহ আরো অনেক সাময়িকী। এগুলো আমাদের বাড়ি পৌছুঁতে এক মাসও লেগে যেত। আর পরম আগ্রহে তাঁকে দেখতাম বিদেশি পত্রিকার পুরোন খবর পড়ছেন।
ভোর ছয়টায় রেডিওতে বিবিসি বাংলা বিভাগের খবরে ঘুম ভাঙত। সিরাজুল ইসলাম, সৈয়দ মাহমুদ আলি, উদয় শন্কর, সাগর সেনের কন্ঠ মনে হয় এখনও হুবুহু নকল করতে পারব আর সপ্তাহান্তে মানষী বড়ুয়ার কন্ঠের গল্প ছাড়া তো ঘুমই হত না। দেশে ক্যাবল টিভি চালু হলে বাবার আসক্তি গিয়ে পড়ে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভির চ্যানেলের উপর।
রিটায়ারমেন্টের পর বাবার হাতে টিভির রিমোট আর তা ঘোরে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস আর কয়েকটি স্পোর্টস চ্যানেলে, অন্য কোন কিছু দেখার জো নেই। শেষমেস, আরো গোটা দুই টিভি কিনে রক্ষে। তো বাবার পাশে বসে বিবিসি টিভি দেখতে দেখতে কিছুটা নেশা আমারও লেগেছিল। সুযোগ পেলে দেখতে ইচ্ছে করে এখনও, কিন্তু চৌদ্দ ঘন্টা শিফ্টের কামলা এই আমি টিভি দেখার ফুরসত পাইনে তেমন। করোনা ভাইরাস সে সুযোগটা করে দিল। লকডাউন জীবনে প্রতিদিন অন্তত একঘন্টা বিবিসি টেলিভিশন নিউজ দেখা হয়।
সেইমত গতরাতেও দেখছিলাম। সরাসরি অনুষ্ঠান ডাউনিং স্ট্রিট থেকে, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী আর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসের প্রধান কথা বলছিলেন। কেউ তুলে ধরছিলেন বর্তমান অবস্থা, কেউ অকপটে তাঁদের প্রস্তুতি নিতে দেরি হওয়ার কথা স্বীকার করে বলছিলেন এখন কি কি করা যায়, কোন কোন অপশন খোলা আছে, কেউ বা গ্রাফ দেখিয়ে বলছিলেন রোগটার গতিপ্রকৃতি। আলোচিত ব্যাপারগুলোর অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের সাথে সরাসরি সম্পর্কৃত নয়। কিছু কিছু ব্যাপার উচ্চ পর্যায়ের পলিসি সংক্রান্ত, কিছু ব্যাপার শুধু ডাক্তার আর বিজ্ঞানীরা জানলেই চলে। তারপরও সব কথা কেন এভাবে এতটা বিস্তারিত বলা হচ্ছে ভাবছিলাম। সম্ভবত গণতন্ত্রে তথ্য জানার অধিকার।
সামাজিক মাধ্যম ভর্তি করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব। কেউ হয়ত আদারসের পানি খেয়ে সুস্থ হওয়ার ফতোয়া দিচ্ছেন। কেউ হয়ত এটাকে আল্লাহর লা’নত বলে, নিদৃষ্ট দোয়া সুরা পড়ে শর্টকাটে মুক্তি পাওয়ার ঔষধ দিচ্ছেন। আরো কত রকমের হাজারো গুজব। গত চব্বিশ ঘন্টায় অন্তত বিশজন পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বাড়িভাড়া থেকে ব্যান্ক লোনের সুদ মওকুফ করে দিয়েছেন। কি ভয়ন্কর অবস্থা – প্রধানমন্ত্রীর নামেও মিথ্যা খবর তৈরি করতে কেউ কেউ পিছপা হচ্ছে না। আর শিক্ষিত মানুষ গাধার মত এসব ছড়াচ্ছে। নিজেকে এসব থেকে বাঁচাতে হোয়াটস্ আপ, মেসেন্জার সবকিছুকে সাইলেন্ট করে দিয়েছে আমার মত অনেকে।
যারা এসব ভুয়া খবর তৈরি করছে তাদের যে অসৎ উদ্দেশ্য আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু শিক্ষিত মানুষ কেন এসব ছড়াচ্ছে। উত্তর একটাই ‘ভয়’। এমন ভয় যে মৃত মায়ের লাশ ফেলে পালাচ্ছে ছেলে। এমন ভয় রোগির চিকিৎসা দিচ্ছে না ডাক্তার। এমন ভয় যে কবরস্থানেও ঠাঁই হচ্ছে না লাশের।
এই দেশে করোনা নিয়ে আমাদের প্রতিদিন অবগত করতেন সরকারের রোগতত্ব ইন্সটিটিউটের প্র্রধান মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। ভদ্রমহিলা আগে তেমন পরিচিত ছিলেন না। তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে ট্রল করেছে অনেকে, বাজে মন্তব্য করেছে তাঁর নিত্যনতুন শাড়ি পরা নিয়ে। আরেকদল তুলে এনেছে, তার উজ্জল একাডেমিক এবং ওয়ার্ক ক্যরিয়ার, তাঁর মানবিক কাজগুলো।
মানুষের মাঝে একটা অনুভূতি কাজ করছে, তারা সত্য খবর, আসল পরিসংখ্যান পাচ্ছে না। মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা কয়েকবার বলেছেন, সীমিত আকারের কমুনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে। ‘সীমিত আকার’ ব্যাপরটা কি তা তো ব্যাখ্যা করলেন না। তাছাড়া কোন ধরণের গবেষণার ভিত্তীতে তিনি সীমিত আকার বললেন তাও পরিস্কার না কারো কাছে। বিবিসিতে দেখা ডাউনিং স্ট্রিটের সংবাদ সম্মেলনের মত এসময় তাঁর সাথে যদি আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ থাকতেন, যদি কোন গ্রাফের মাধ্যমে দেখাতেন কতুটুকু হলে সীমিত, কতটুকু হলে সীমার বাইরে, মানুষ হয়ত গুজবে কান দিত না।
পরিচিত, গ্রহণযোগ্য মানুষের মুখ থেকে কিছু শুনলে মানুষ আশ্বাস পায়। ডা. প্রাণগোপাল, ডা. এবিএম আবদুল্লাহ দের মানুষ ভালবাসে তাঁদের অকপট সত্য উচ্চারণ আর পেশাগত দক্ষতার জন্য। এ ধরণের পরিচিত মুখরা নেই কেন আমাদের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে? সাস্থ্য মন্ত্রী, সাস্থ্য সচিব, সাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে মাঝে মাঝে দেখা যায় টিভির পর্দায়। রাজনীতি আর সিভিল সার্ভিস তাঁদের দন্ডমুন্ডের কর্তা বানিয়েছে। আসলে কি এঁরা কেউ বিশেষজ্ঞ?
কয়দিন আগে বিবিসির আরেকটি অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। করোনা ভাইরাস মিথস টু ইগনোর । বাংলায় এ ধরণের কিছু অনুষ্ঠান করা গেলেও গুজব কমানো যেত অনেক। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো এরকম কিছু করতে পারে। সর্ব বিষয়ে পন্ডিত রাতজাগা ভাঁড়দের নিয়ে টকশো করে পয়সা নষ্ট না করে, সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসল অনুষ্ঠান করতে এগিয়ে আসা উচিত তাদেরও। বিবিসিকে একটা মানদন্ড ধরা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রিন্ট মিডিয়া কিন্তু অসাধারণ কাজ করছে। কিন্তু গ্রাসরুট লেভেলে প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যাওয়ার সুযোগটা অনেক বেশি। আর টেরিস্ট্রিয়াল ব্রডকাস্টের একমাত্র অধিকারী হওয়ায় সরাকারি বিটিভির দায়িত্বটা সবচেয়ে বেশি নয় কি? ### ১৫.১০.২০
আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.