--- বিজ্ঞাপন ---

সাগরের তলদেশ দিয়ে বিদ্যুৎ যাচ্ছে সন্দ্বীপে

বৃহত্তর চট্টগ্রামের জন্য মহাপরিকল্পনা সরকারের

0

বিশেষ প্রতিনিধি##

বিদ্যুত নিয়ে আগের চেয়ে অনেকটা স্বস্তিতে এখন চট্টগ্রামবাসী। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুত এর জন্য হাহাকার করছিল সনদ্বীপবাসি। বিদ্যুৎ এর আলোয় আলোকিত হবে সারা সনদ্বীপ। শুধু একটু সময়ের ব্যাপার। এক্ষেত্রে অসাধ্য সাধন করেছে সরকার। সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বৈদ্যুতিক তার সনদ্বীপে পৌছানো হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের সনদ্বীপের ঘরে ঘরে বিদ্যুত যাবে। চট্টগ্রামেও এখন আগের মতো লোডশেডিং নেই। কোন কারনে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হলে সেবা মিলছে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে। আগে যেখানে বিদ্যুৎ নিয়ে অভিযোগ দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে বিদ্যুৎ বিভাগের কন্ট্রোলের কাজ আরও গণমূখি করা হয়েছে। কোথায় বৈদ্যুতিক বিপর্যয় হলে দ্রুত গতিতে পৌছে যাচ্ছে টিম। পূর্বে যেখানে বিদ্যুৎ এর অভিযোগ নিয়ে প্রকৌশলীদের কাছে যেতে পারতো না গ্রাহকরা, সেখানে প্রকৌশলীরা এখন অপেক্ষা করেন জবাব দিতে। মিটার পদ্ধতি ডিজিটাল করার ফলে যে কোন দোকান থেকে টাকা ঢুকিয়ে নিজের সংযোগ সচল করতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সরকার বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে। এর জন্য ব্যয় হবে প্রায় সোয়া দু’লাখ কোটি টাকা। আগামি ২০৪১ সালকে টার্গেট করে দীর্ঘমেয়াদি এসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। উপজেলাগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ এর জন্য সনদ্বীপের মানুষের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। কারন এখানে বিদ্যুৎ নেয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। এ অবস্থায় সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে এখানে বিদ্যুৎ নেয়ার চেষ্টা চালায় সরকার। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন কেবলের সাহায্যে মূল ভূখন্ডের সাথে সনদ্বীপের সংযোগ স্থাপনের কাজটি এর মধ্যে শেষ হয়েছে। সরকার চীনের সাহায্যে সাগরের তলদেশের ১২ ফুট নিচ দিয়ে সনদ্বীপে বিদ্যুতের তার নিয়ে যায়। সনদ্বীপে বিদ্যুত যাবে সীতাকুন্ড উপজেলার সাহায্যে। এ দু’উপজেলার জন্য প্রায় ৪৫ কিলোমিটার বিশেষ তারের প্রয়োজন হয়। এসব তার আসে চীন থেকে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটি করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কিলোমিটারে তার স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। শীঘ্রই স›দ্বীপ ও সীতাকুন্ডে দুটি সাবস্টেশন ও ট্রান্সফরমার বসানোর কাজ শুরু হবে। সনদ্বীপের পুরো প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে পিডিবি সূত্রে জানা যায়।
সনদ্বীপের বিদ্যুতায়ন প্রসঙ্গে সাবমেরিন কেবল প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী দুলাল হোসেন বলেন, ‘সনদ্বীপে সাবমেরিন কেবল এর মাধ্যমে বিদ্যুত নেয়ার প্রকল্পটি বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। চীনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালে নেয়া হয়। শেষ হয় ২০১৯ সালে। সাগরের ১২ ফুট নিচ দিয়ে বিদ্যুতের তার নেয়া হয়। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার তার টানা হয়েছে। স›দ্বীপে ৩০০ কিলোমিটারের বিদ্যুত বিতরন কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। করোনার কারনে এটি পিছিয়ে গেছে। তিনি বলেন, সনদ্বীপে এখন গ্রীডলাইন থেকে বিদ্যুত দেয়া হচ্ছে। পুরো বিতরন ব্যবস্থার কাজ সম্পন্ন করা গেলে স›দ্বীপের ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌছে যাবে।’
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, জনসংখ্যা ও অর্থনীতির আকার বাড়ার পাশাপশি বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদাও। ২০৪১ সাল নাগাদ বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে কয়েক গুণ। এই অবস্থায় বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, গ্রীড নেটওয়ার্ক ও বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরীর বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মহেশখালী মাতারবাড়িতে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ হাজার ৩১৪ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে আর্থ-সামাজিক ও মানব উন্নয়নসহ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও ১০ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সমীক্ষা করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ও ডুয়েল ফুয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। নবায়নযোগ জ্বালানীর আওতাধীনে বাঙ্গালহালিয়ায় ৬০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এ ছাড়া কাপ্তাইয়ে ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর কাজও চলমান আছে; কাজ সমাপ্তের পর ওই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এদিকে বিদ্যুৎ বিতরণ দক্ষিণাঞ্চলে হেলদি গ্রিড নেটওয়ার্ক তৈরীর জন্য সাতটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ হাজার এমভিএ ক্ষমতার ১৫টি গ্রীড উপকেন্দ্র, ৪০০ কেভি, ২৩০ কেভি, এবং ১৩২ কেভি লাইন নির্মাণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলকে হলদি গ্রিড নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত করা হচ্ছে। এতে ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোল্টেজ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়র বোর্ডের তত্বাবধানে ১১’শ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম জোনের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান আছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১৪টি ৩৩/১১ কেভি নতুন উপকেন্দ্র ও আটটি উপকেন্দ্র আপগ্রেডেশন করা হবে। ফলে উপকেন্দ্রের ক্ষমতা প্রায় ৭৫০ এমভিএ বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া ১৬৩ কিলোমিটার ৩৩ কেভি, ৩০০ কিলোমিটার ১১ কেভি, ৩০০ কিলোমিটার ১১/০.৪ কেভি নতুন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ২৬৭ কিলোমিটার ৩৩ কেভি, ১০০ কিলোমিটার ১১ কেভি, ৩০০ কিলোমিটার ১১/০.৪ কেভি লাইন নবায়ন করা হচ্ছে। দেড় হাজার ১১/০.৪ কেভি ২৫০ কেভিএ বিতরণ ট্রান্সফরমার স্থাপনসহ সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে স›দ্বীপ উপজেলাকে জাতীয় গ্রীডে সংযুক্ত করার কাজ চলমান আছে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরও পাঁচ লাখ নতুন গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ দিকে তিন পার্বত্য জেলার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় ৫৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় ১২টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ, চারটি উপকেন্দ্র আপগ্রেডেশন, ২৫২ কিলোমিটার ৩৩ কেভি, ৪৭০ কিলোমিটার ১১ কেভি, ২৩০ কিলোমিটার ১১/০.৪, ৩৬০ কিলোমিটার ০.৪ কেভি লাইন এবং ১৭৭টি থ্রী ফেইজ ট্রান্সফরমার, ১৫০টি সিঙ্গেল ফেইজ ট্রান্সফরমার স্থাপনের কাজ চলমান আছে। অন্যদিকে ২০৩০ সাল উপযোগী বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষে প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার ডিপিপি প্রণয়ণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীনে ৩৪টি ৩৩/১১ কেভি নতুন উপকেন্দ্র নির্মাণ, সাতটি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র আপগ্রেডেশন, ১২৮.৫ কিলোমিটার ৩৩ কেভি, ৬০০ কিলোমিটার ১১ কেভি, ৮০০ কিলোমিটার ১১/০.৪ কেভি, এক হাজার কিলোমিটার ০.৪ কেভি নতুন লাইন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ৫৮ কিলোমিটার ৩৩ কেভি, ৩০০ কিলোমিটার ১১ কেভি, ৪০০ কিলোমিটার ১/০.৪ কেভিএবং ৮০০ কিলোমিটার ০.৪ কেভি লাইন নবায়ন করা হবে। ৪৯৮.৩ কিলোমিটার ৩৩ কেভি এক্সএলপিই, ৩০ কিলোমিটার ৩৩ কেভি এক্সএলপিই এবং ৩১ কিলোমিটার ১১ কেভি এক্সএলপিই আন্ডারগ্রাউন্ড কপার ক্যাবল স্থাপন এবং ৩ হাজার ৮১২টি ১১/০.৪ কেভি, ২৫০ কেভিএ এবং এক হাজারটি ১১/০.২৩ কেভি, ৫০ কেভিএ ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হবে। ফলে বিতরণ সিস্টেমের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাহককে মানসম্মত, সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৗৎ সরবরাহ ও নতুন গ্রাহক সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, বোয়ালখালী ও সীতাকুন্ড উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ হয়েছে। পটিয়া ও হাটহাজারী উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ হওয়ার পথে। এ ছাড়া সাতকানিয়া ও চন্দনাইশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ হয়েছে। কক্সবাজার সদর, রামু, চকরিয়া, লামা ও নাইক্ষ্যছড়ি উপজেলার অবিদ্যুতায়িত এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজও শেষ হয়েছে।
সূত্র জানায়, বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষের কাছে বিদ্যুৎ নিয়ে পূর্বে প্রায়শ হাহাকার ছিল। এখন তা আর নেই। সাধারনত বন্ধের দিনগুলোতে এখন বিদ্যুৎ আধুনিকায়নের কাজ জোরেশোরে চলছে। বিশেষ করে বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার বসানোর ফলে বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে সচ্ছতা এসেছে। এখন যে কেউ দোকান থেকে প্রি-পেইড মিটারে টাকা ঢুকিয়ে বিদ্যুৎ চালু করতে পারে। বিদ্যুৎ এর ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হবার পর রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হচ্ছে। এনালগ মিটারগুলো তুলে ফেলা হচ্ছে। বিদ্যুত নিয়ে গ্রাহকরা যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে তার জন্য বিদ্যুত বিভাগ আগের চেয়ে অনেক সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। ### ২৫.১০.২০

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.