--- বিজ্ঞাপন ---

মুজিবনগর সরকার গঠন ছিল একটা চ্যালেঞ্জ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ঃ ইতিহাসের পাতা থেকে

0

কাজী আবুল মনসুর

১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গঠন ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। কারন অনেকে চায় নি মুজিবনগর সরকার হোক, অনেকের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে ছিল সংশয়। কেউ কেউ পদ না পেলে সব কিছু ভন্ডুল করার পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেহেতু স্বশরীরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মুজিবনগরে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিল না তাই কার নেতৃত্বে সব কিছু প্রশ্নটি বরাবরের মতোন ছিল। শেষপর্যন্ত নানা মত ও চিন্তা করে উপস্থিত সকলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেন। দেশের স্বার্থে সকলে তা মেনে নেবেন বলে ঘোষণা দেন। তবে বৈইমান  খন্দকার মোশতাকের প্রত্যাশা ছিল নাকি অনেক বেশি। এ লোক ভেতরে নানা ক্ষোভ পূষে রেখে উপরে অভিনয় করে গেছেন, সে সময়কার বুদ্ধিজীবীরা তাই বলেন।

খ্যাতনামা লেখক এম আর আখতার মুকুল তারঁ আমি বিজয় দেখেছি’তে উল্লেখ করেছেন, ‘ …মুজিবনগরে আমরা ইস্পাত কঠিন একথা নিয়ে থাকতে পাতাম। পরবর্তিকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভয়াবহ রূপ দেখতে পাই, তা মুজিবনগরের শতধা-বিভক্ত অথচ সুপ্ত উপদলীয় কোন্দলের বহিঃপ্রকাশের ফল বলেলে অন্যায় বলা হবে না। একটা কথা বলে রাখা দরকার যে স্বাধীনতাত্তোর কালের বাংলাদেশের রাজনীতিকে বুঝতে হলে মুজিব নগরের রাজনীতিকে বুঝতে হবে।’

নানা টানাপোড়েনের পর ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি , তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা বলা হয়। ১৭ এপ্রিল চুড়ান্তভাবে মুজিবনগর সরকার গঠনের বিষয়টি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বিশ্বব্যাপি এটি প্রচারের জন্য যত বেশি পরিমান সাংবাদিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় তার তৎপরতা চলে। কসবা-আখাউড়া সেক্টরে স্বল্পকালীন স্থায়ী একটা এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার সম্বলিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।এখান থেকে ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের একটি রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করা হয়। এ ভাষণ চর্তুদিকে ছড়িয়ে দিতে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সহায়তা নেয়া হয়।

মুজিবনগর সরকার গঠনের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ কিছু এলাকায় কর্তৃত্ব দিতে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন। বক্তৃতার মাধ্যমে তাদের কাছে বার্তা চলে যায়। তিনি কুমিল্লা/সিল্টে এলাকায় মেজর খালেদ মোশাররফ, চট্টগ্রাম/নোয়াখালি এলাকায় মেজর জিয়াউর রহমান, ময়মনসিংহ/টাঙ্গাইল এলাকায় মেজর শফিউল্লাহকে মুক্তিযুদ্ধের কর্তৃত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেন। একইসাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায়মেজর ওসমানকে, ফরিদপুর/বরিশাল/পটুয়াখালি/খুলনা অঞ্চলে মেজর জলিলকে, রাজশাহীতে মেজর আহম্মদকে, সৈয়দপুর/রংপুরে মেজ নজরুলকে দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেন।

মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদ ক’সদস্যের হবে এ নিয়ে নানা মত থাকলেও শেষপর্যন্ত একটি ছোট আকারের মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত হয়। ১৩ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের নির্বাচিত ৬ জনের মন্ত্রী পরিষদ ঘোষণা করা হয়। বন্টন করা হয় দফতর।

১৭ এপ্রিল দেশি-বিদেশী শতাধিক সাংবাদিক কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে ‘ভবেরপাড়া’ গ্রামে হাজির হয়।  ঐতিহাসিক দিনটি স্মরন রাখার জন্য পাচঁ হাজারেরও বেশি গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন। ভবেরপাড়া গ্রামে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। চর্তুদিকে কড়া পাহারায় আনসার ও প্রাক্তন ইপি আরের দুটি পৃথক প্লাটুনের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করেন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজুরুল ইসলাম। জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। কোরান তেলাওয়াতের দিনাজপুরের আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। জনতার মূর্হুমূহু শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে কর্ণেল ওসমানীর নাম ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ভবেরপাড়া গ্রামের নাম বদলে ‘মুজিব নগর’ নামকরণ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রীসভার সদস্যদের মাঝে দফতর বন্টন করা হয়।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, ত্রান ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদের মাঝে দফতর বন্টন করা হয়।

খন্দকার মোশতাক কেন বেইমানি করলেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে বুদ্ধিজীবী লেখক এম আর আখতার মুকুলের বইতে দেখা যায়, …১৯৪৮ সালের শেষভাগে নারায়নগঞ্জের উপকন্ঠে চাষাড়ার নিকটবর্তী মরহুম ওসমান দালালের বাসভবন ‘বায়তুল আমানে’ বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের পরবর্তী বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। এই নবগঠিত সংগঠনের প্রথম সভাপতি হচ্ছেন আসাম থেকে আগত মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। টাংগাইলের যুব নেতা শামসুল হক পার্টি সাধারন সম্পাদক এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ ও শেখ মুজিবর রহমানকে যুগ্ম-সম্পাদক করা হয। পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ শামসুল হক পান সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব। কারন এ সময় তিনি এক উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের শক্তিশালী প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে হারিয়ে তখনকার সময়ে ব্যাপক আলোচিত হন। কিন্ত বছর কয়েক পরে তার মস্তিস্ক বিকৃতি হলে অস্থায়ী সম্পাদক হিসেবে মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিবর রহমানকে দায়িত্ব দিলে খন্দকার মোশতাক তা মেনে নিতে পারে নি। বলা হচ্ছে মোশতাক-মুজিব বিরোধের প্রথম সূত্রপাত এখানে। পরবর্তিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে মোশতাক তার মুখোশ উন্মোচন করে।### তথ্য সূত্রঃ আমি বিজয় দেখেছি

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.