--- বিজ্ঞাপন ---

হেলিকপ্টার ইঞ্জিন তৈরী করে ইতিহাস গড়ল তুরস্ক

প্রতিরক্ষা শিল্পে একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছি, বললেন এরদোয়ান

0

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম

তুরস্ক এবার হেলিকপ্টার ইঞ্জিন তৈরী করে ইতিহাস গড়ল। তুরস্কে তৈরী সামরিক হেলিকপ্টার টি-১২৯ , বেসামরিক হেলিকপ্টার ‘গোকবে’-তেও এই ইঞ্জিন ব‌্যবহার করা হবে। তুরস্কের সর্বশেষ চমক হেলিকপ্টার ইঞ্জিন তৈরীর দেশের তালিকায় নিজেদের স্থান করে নিল গত ৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে । হেলিকপ্টার ইঞ্জিন তৈরীতে সমর্থ বিশ্বের ৭ম দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করল সেদিন তুরস্ক। টার্বো শ‌্যাফট  টিইআই-টিএস ১৪০০ ইঞ্জিনটি এসকিশেহির প্রদেশে এক অনুষ্ঠানের মাধ‌্যমে ব‌্যাপক ‍উতপাদনের জন‌্য কারখানায় হস্তান্তর করা হয় এদিন । গত ৬ ডিসেম্বর সেদেশের দৈনিক সাবাহ পত্রিকায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আন্দালু’র বরাত  দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে যে দেশ ইঞ্জিন তৈরী প্রযু্ক্তিতে যতটা এগিয়ে আছে সেদেশের মর্যাদাও তত উঁচু। বিশ্বে মাত্র হাতে গোণা কয়েকটি দেশই হাই টেক  ইঞ্জিন তৈরীতে পারদর্শিতা দেখিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে চলেছে। প্রতিরক্ষা শিল্পে তো  ইঞ্জিনই হচ্ছে সবচাইতে বড় উপাদান যাকে উতপাদিত পণ্যের প্রাণ বলা হয়। যেমন, জঙ্গী বিমান, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার, ড্রোন প্রভৃতির প্রাণই হচ্ছে এই ইঞ্জিন। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা আধুনিক সভ্যতায় আজ ‘ইঞ্জিন ছাড়া গাড়ী  চলেনা’ একথাটির সাথে কারো দ্বিমত নেই।

প্রেসিডেন্ট রেজিপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইঞ্জিন উৎপাদন শুরুর প্রাক্কালে ইস্তাম্বুলের বাহাদেতিন ম্যানশন থেকে সরাসরি ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে বলেন, “এই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে, আমরা প্রতিরক্ষা শিল্পে একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছি “। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান  তুরস্কের তৈরী প্রথম হেলিকপ্টার ইঞ্জিন এবং  নতুন নকশা কেন্দ্র খোলার উদ্দেশ্যে  ইঞ্জিন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আরও বলেন, তুরস্ক সকল ধরনের বিমান ইঞ্জিন উতপাদনের অন‌্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হতে এগিয়ে যাওয়ার পথে। তুরস্কের ইঞ্জিনিয়াররা মাত্র তিন বছর সময় নিয়ে এই ইঞ্জিনের নকশা ও এটি তৈরী করতে সক্ষম  হয়।  তুরস্কের এসকিশেহির প্রদেশে টার্বোশ্যাফট ইঞ্জিন বিতরণ সুবিধা এবং টিউএসএএস ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রিজের (টিইআই) জন্য একটি নকশা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তুরস্কের শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা বারনক এসময় বলেন, “আজ আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন প্রত্যক্ষ করছি।”  তিনি বলেন, তুরস্ক তার দেশীয় টার্বোশ্যাফ্ট হেলিকপ্টার ইঞ্জিনের ব্যাপক উত্পাদনের জন্য প্রস্তুত, যা বছরে ৬০মিলিয়ন ডলারের  উচ্চ প্রযুক্তির আমদানি সাশ্রয় করবে।

টার্কি অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিআইএআই) ইঞ্জিন উত্পাদনকারী সংস্থা টিউএসএইচ ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রিজ (টিইআই) –এর   ইঞ্জিনিয়ারদের নিজস্ব ডিজাইনে এই ইঞ্জিন নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে সম্প্রতি অতি অল্প সময়ের মধ‌্যে তুরস্ক ড্রোনের ইঞ্জিন তৈরী করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে তুর্কি ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে অভিযোগ এনে কানাডা তুরস্কে গত ড্রোন ইঞ্জিন রফতানি বন্ধ ঘোষণা করার পর নিজ দেশেই ইঞ্জিন তৈরী করে দেখালো চৌকশ তুর্কী সামরিক ইঞ্জিনিয়াররা। তুর্কি দৈনিক সাবাহ পত্রিকায় গত ৩০ অক্টোবর  ড্রোন ইঞ্জিন তৈরীর খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি জানায়, তুরস্কের বৃহৎ ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বেকার এর “বেয়ারআকতার টিভি-৩’ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ‘আকিঞ্চি’ অচিরেই দেশে তৈরী  এই ইঞ্জিন ব্যবহার করতে শুরু করবে।

পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের দেশ হওয়া সত্বেও  তুরস্ককে কারিগরী উচ্চ প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে বরাবরই অনীহা ঘড়িমসি দেখিয়ে আসছিল সহযোগী দেশগুলি। তবে দেশটির দৃঢ়চেতা নেতা বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেজিব তাইয়েপ এরদোয়ানের যুগান্তকারী বেশ কিছু পদক্ষেপসমূহের কারণেই দেশটি পশ্চিমা তথাকথিত মিত্র দেশগুলির বৈষম‌্যমূলক আচরণের মুখে  হাই টেক পণ্য উতপাদনে বেশ দ্রুততার সাথেই  এগুচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দেশটিকে পুরোপুরি পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। এরই ফলশ্রুতিতে তুরস্ক  আগে যেখানে দেশের সামরিক বাহিনীর চাহিদার মাত্র ২০ ভাগ মেটাতে পারতো এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ  নিজ দেশের অস্ত্র নির্মাতারাই উতপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে। দেশটি  নিত্য নতুন হাইটেক ড্রোন রফতানিতেও ইসরাইল, চীনের মত দেশগুলির সাথে সমানে পাল্লা দিচ্ছে। তুরস্কের বৃহৎ অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানী সমূহ বিশ্বের সেরা ১০০টি বড় অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানীর তালিকায় অবস্থানে রযেছে।বর্তমানে সেদেশের বড় অস্ত্র নির্মাতা আসেলসান ৫৪ তম এবং  টিএআই (টার্কি এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি) ৮৪ তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য অস্ত্র নির্মাতার মধ্যে, জাহাজ নির্মাণে এসটিএম, সাঁজোয়া যান নির্মাণে এফএনএসএস, ড্রোনে বেয়ারআকতার আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন, রকেটসান, হাভেলসান, বিএমসি প্রভৃতি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

গত ১৮ বছর ধরে তিনি তুরস্ক পরিচালনায় রয়েছেন এরদোয়ান। এককালের সেদেশের কাসিমপাশা দলের ফুটবল খেলোয়াড় দৃঢ়চেতা এই রাজনীতিবিদ ২০০৩ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তুরস্কের পরিচালনা কাঠামো, সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখা, বিচার ব্যবস্থাসহ  নানা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সংস্কার আনেন। অভিযোগ রয়েছে, তার এসকল সংস্কার দেখে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় দেশগুলি ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে মদদ দিয়েছিল। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঐ ব্যর্থ প্রচেষ্টার অন্যতম নায়ক তুরস্কের গুলেন নামক সুফিবাদের নেতা ফতেউল্লা গুলেনকে আমেরিকা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি  জানানোর পর এই অভিযোগ আরও দৃঢ় বলে প্রমাণিত হয়। ন্যাটো জোটের অপরাপর দেশ গ্রীস, জার্মানী তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জড়িত সেনা অফিসারদের আশ্রয় দেয়। যারা তুরস্কের পার্লামেন্ট ভবনে এফ-১৬ বিমান নিয়ে বোমা বর্ষন করেছে তাদেরকে তথাকথিত এই ন্যাটো মিত্ররা আশ্রয় দেয়। রাস্তায় ট্যাংক নামে। এরদোয়ানকে হত্যার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে সফল হয়নি ষড়যন্ত্রকারীরা। সাধারণ মানুষ এরদোয়ানের সমর্থনে ট্যাংকের সামনে শুয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে দেখা যায়।  রক্তার্ত এই অভ্যুত্থানে ৩০০ নাগরিক নিহত হন আহত ২ হাজারেরও বেশী। তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে বেসামরিক মানুষ হত্যাকারি কুর্দি সন্ত্রাসবাদীদেরও আশ্র্রয় ইন্দন দিচ্ছে এসকল তথাকথিত ন্যাটো জোটের শরিক মিত্র।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.