--- বিজ্ঞাপন ---

কোরিয়ার গিয়ংবু এক্সপ্রেসওয়ে, আর বাংলাদেশের পদ্মা সেতু

একদিকে জেনারেল পার্ক চুং হে, অন্যদিকে শেখ হাসিনা

0

ওমর ফারুক হিমেল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে

দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ং বু এক্সপ্রেসওয়ে, আর বাংলাদেশের পদ্মা সেতু। দুটোই ছিল চ্যালেঞ্জের। কোরিয় যুদ্ধের পর দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে জেনারেল পার্ক সিউলের সাথে বুসান শহরকে যুক্ত করার বড় একটি প্রকল্প হাতে নেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, অর্থনীতির খারাপ অবস্থা দেখে জেনারেল পার্ককে সহযোগিতা করতে কেউ রাজি হয়নি। বিশ্বব্যাংকের কাছে গেলে তারাও ফিরিয়ে দেন। দেশের মানুষের শক্তি আর মনোবল নিয়ে জেনারেল পার্ক নিজেদের উদ্যোগে এটি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সফল হন। এই একটি প্রকল্প পাল্টে দেয় কোরিয়ার অর্থনীতি। একইভাবে বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর জন্য যখন বিশ্বব্যাংক সরে দাড়ায় তখন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দেশের মানুষের শক্তি আর মনোবল নিয়ে এগিয়ে যান। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান হচ্ছে।

কোরিয় যুদ্ধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি। অবকাঠামো বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। কোরিয়া ছিল তখন জীর্ণ শীর্ণ দেশ । কিন্তু এই দেশটি হঠাৎ করে সারা বিশ্বের বুকে শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়। আর এই শক্তিশালী অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার হবার পেছনে রয়েছে একটি জাতির শক্ত মনোবলের প্রাণখোলা ইতিহাস। কোরিয়াকে পরিবর্তন করে দেয় একটি মহাসড়ক। নাম গিয়ংবু এক্সপ্রেসওয়ে। সালটি তখন ১৯৬৩। ভঙ্গুর কোরিয়ার ক্ষমতায় আসেন জেনারেল পার্ক চুং হে।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন কোরিয়ার রাজধানী সিউলের সাথে দ্বিতীয় বৃহৎ শহর বুসানকে যুক্ত করবেন। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হয় গিয়ংবু এক্সপ্রেসওয়ের। এই এক্সপ্রেসওয়েতে তিনি যুক্ত করতে চান দেশের প্রধান শহর গুলিকে। যুক্ত হবে দেজন, গুমি, দেগু এবং বুসান শহর। অভাবের দেশে এরকম বিলাসবহুল প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন সেদেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ, মূলধারার রাজনীতিবিদ এমনকি সাধারণ মানুষ জনগণ। মহাসড়কটি করতে গিয়ে কোরিয়া বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু প্রত্যেকেই কোরিয়াকে ফিরিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা পাশে না থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নিজস্ব অর্থে, প্রযুক্তিতে এবং জনবলে এরকম একটি প্রকল্প করতে সক্ষম হয়।

১৯৬৭ সাল। দক্ষিণ কোরিয়ার মোট বাজেটের ২৩.৬ শতাংশ বরাদ্ধ করা হল এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। ১৯৬৮ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি শুরু হল এই মহাযজ্ঞের কাজ। দুর্গম পথে বিরতিহীন অক্লান্ত পরিশ্রম চলতে থাকল। ক্রমেই এগোতে লাগল এই প্রকল্প। মাত্র ২ বছর ৫ মাসে শেয় হয় এই প্রকল্পের কাজ৷ প্রকল্পের পথে পাহাড়ি দূর্গম অঞ্চল ও ছিল। ৪২৮ কিমি এই সড়কে রয়েছে ২৯ টি বড় ব্রিজ, ১২ টি টানেল এবং ১৯ টা ইন্টারচেঞ্জ। এই মহাসড়ক নির্মাণে কতজন সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করেছিল জানেন? ৮৯ লক্ষ মানুষ। প্রায় ১৬.৫০ লক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করা হয়েছে এই সড়ক নির্মাণে। সেই আমলে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার যা এখনকার সময়ের কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমান। সড়কটি নির্মাণে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৭৭ জন মানুষ। আহত হয়েছিল অসংখ্য। ১৯৭০ সালের ৭ জুলাই এই সড়কটি উদ্বোধন করা হয়। কথা হচ্ছে কি পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া এই এক্সপ্রেসওয়ে করে? দেশটির প্রায় ৬৩% জনগণ এই রাস্তার মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগের সুবিধা পায়। কোরিয়ার গড়ে উঠে হাজার হাজার শিল্প কারখানা যার ভেতর ৮১% কারখানা যুক্ত হয় এই সড়ক কে ঘিরে। দক্ষিণ কোরিয়া পরিণত হয় সারা বিশ্বের অন্যতম কন্সট্রাকশান জায়ান্ট হিসাবে। সেই আমলের এরকম অসাধ্য সাধন কে কোরিয়ারা বলে থাকে Can Do spirit অর্থাৎ, আমরা পারবই। হুন্দাই কোম্পানিকে চেনেনা এমন লোক কম আছে। হুন্দাই কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় এই মহাসড়ক নির্মাণে যুক্ত থেকেই। “আমরা পারবই” এই প্রত্যয় থেকেই কোরিয়াতে গাড়ি নির্মাণ, বিমানবন্দর নির্মান, স্টিল মিল নির্মাণের মত কাজ শুরু হতে থাকে যার প্রধান শক্তি ছিল এই প্রকল্প থেকেই। আর এ সড়কটিই বদলে দিতে থাকে দক্ষিণ কোরিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতিকে। বুসান শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজার হাজার কলকারখানা। আর এ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া দুর্বল অর্থনীতির দেশ থেকে পরিণত হয় টাইগার অর্থনীতির দেশে।

মুজিব কন্যার পদ্মাসেতু
একইভাবে বাংলাদেশের পদ্মাসেতু নির্মানে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার । ১৮ মে জাপান ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদানের চুক্তি করে।  ২৪ মে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ১৪ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। ৬ জুন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে ৬১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়। সেতুর উভয় প্রান্তে জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়। ভূমি উন্নয়নের কিছু কাজও হয়েছিল। কিন্তু ঋন ছাড় দেয়ার আগে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে ঋনের কিস্তি প্রদানে বহু শর্ত সংযোজন করে বিশ্ব ব্যাংক। শেষঅবধি বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং বিশ্বব্যাংকের নিতে অস্বীকার করে । এরপর থেকে শেখ হাসিনা সরকার অসম্ভব কাজটি সম্ভব করার কাজে লেগে যান। প্রথমদিকে অনেকে হাসাহাসি করলেও এখন তাদের মূখে চুনকালি পড়েছে। বিশ্বব্যাংক যখন কল্পিত দূর্নীতির অভিযোগ তোলে তখন দেশের কথিত বুদ্ধিজীবীরা না জেনে না বুঝে সরকারকে তুলোধুনা করতে ছাড়ে নি। পরে অবশ্য প্রমানিত হলো এখানে কোন দূর্নীতি হয়নি। কানাডার আদালত এ ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট মতামত দেয়। পরে টাকা দিতে বিশ্বব্যাংক রাজি হলেও বাংলাদেশ আর তাদের দিকে ফিরে চাই নি।
প্রায় ৬ হাজার ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুতে বিজয়ের মাসে শেষ স্প্যানটি বসানো হলো। ২০২০ সাল তাই স্মরনীয়।  স্বপ্ন পূরণের খুব কাছাকাছি নদীর প্রবহমান জলরাশির ওপর পুরো পদ্মা সেতু। বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে শেষ হলো পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর কাজ। ঠিক দুপুর ১২টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের ১২-১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয়েছে ‘টু-এফ’ স্প্যানটিকে। দূর থেকেই দেখা যায় সেতুর মাঝের শূন্যস্থানটুকু এখন পূর্ণতা পেয়েছে। এ বিশাল কর্মযজ্ঞে দেশি-বিদেশি ২০ হাজার প্রকৌশলী, শ্রমিকদের মেধা ও অক্লান্ত পরিশ্রম জড়িত।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে,প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কিঃমিঃ (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে।এতে বলা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে।
আরেক সমীক্ষায় এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) নির্মানের ফলে দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে লক্ষনীয় অগ্রগতি হবে।এই সেতু চালু হলে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষনাবেক্ষন, জ্বালানী ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে।
এই পদ্মাসেতুর বাস্তব রূপ পেয়েছে একজন মুজিবকন্যার জন্য,অন্যদিকে পার্ক চুং হি’র জন্য কোরিয়ার গিয়ংবু এক্সপ্রেসওয়ে। কোরিয়া আর বাংলাদেশের বড় দু’প্রকল্পের চিত্র একই রকম। প্রমান হয়েছে সততা, আন্তরিকতা থাকলে নিজের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে কারও সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই অনেক বড় প্রকল্প শেষ করা যায়। দেশকে এগিয়ে নেয়া যায় বহুদুর।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.