--- বিজ্ঞাপন ---

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ধারা

৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঊর্ধ্বে জিডিপি, ৪১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

0

:: মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ::

করোনা মহামারীকালেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিবাচক ধারা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ও ওয়েবিনারে কিছুদিন ধরে বেশ আলোচনা চলছে। আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে অক্টোবর ২০২০-এ প্রকাশিত আইএমএফের একটি অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের কারণে। এ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ভারতের জিডিপি কমে যাবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১৮৮৮ ডলার আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ১৮৭৪ ডলার। আগামী বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে আগামী বছর ভারত পুনরায় মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাবে।

মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলে দেয়ার বিষয়টি ভারতীয় সাংবাদিক ও অর্থনীতিবিদরাই সামনে এনেছেন। তারা এটিকে সরকারের সমালোচনার একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে দেখছেন। এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীতে বাংলাদেশের উল্লসিত হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। কারণ আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত সবসময়ই আমাদের সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক রক্ষণশীল থাকে; যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী গত জুনে সমাপ্ত বছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২০৬৪ ডলার। চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি অনুমান করা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এক্ষেত্রে আইএমএফের পূর্বাভাস হলো ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদন বলেছে, এ প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। আইএমএফের মতে ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশকে আরো চার বছর অপেক্ষা করতে হবে।

যে যা-ই বলুক এসব আলোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট যে করোনার থাবায় বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েনি। এ দেশের মানুষ কষ্টসহিষ্ণু এবং যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে করোনাকালীন গত সাত মাসে দেশে শ্রমজীবী মানুষ ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত মানুষের কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার কারণে এদের আয় কমেছে অন্তত ২০ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার সাড়ে ১২ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে; অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি। বন্যায় ৩১ জেলায় ১ লাখ ৪২ হাজার টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। কয়েক মাস লকডাউন ও দোকানপাট বন্ধ থাকার কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা সংকুচিত হয়েছে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে রয়েছে অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার যে আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, তার ইতিবাচক ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে এক্ষেত্রেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ প্রদান সন্তোষজনক নয়। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২১ শতাংশ ঋণ প্রদান সম্ভব হয়েছে। সরকারি ত্রাণ বরাদ্দে অপ্রতুলতা না থাকলেও বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে ত্রাণ পৌঁছেনি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে রফতানিতে পূর্বাবস্থা ফিরে আসা ও প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যা অক্টোবর শেষে ৪১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় পরিশোধ ও বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প খরচ নির্বাহে এটি পরম নির্ভরতা হিসেবে কাজ করবে।

এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এ ঢেউয়ের প্রকোপে লণ্ডভণ্ড হয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। আগের তুলনায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসার উন্নতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দুর্বার প্রচেষ্টা ও দেশপ্রেমের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবী ও সরকারি কর্মচারীরা নির্লোভ ও নিরলস কাজ করলে আমরা সংকট কাটিয়ে সুদিন দেখতে পাব।

আবার আগের প্রসঙ্গ অর্থাৎ মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশের ভারতকে টপকে যাওয়ার প্রসঙ্গে আসা যাক। এটি খুবই সাময়িক। এর আগেও ১৯৯১-৯৩ সালে এমন হয়েছিল। ভারত একটি বিশাল দেশ। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পোৎপাদনে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। প্রচুর কৃষি জমি থাকা ও যান্ত্রিক কৃষি উৎপাদনের কারণে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও খাদ্যসামগ্রী রফতানি করতে পারে। বড় অর্থনীতি হওয়ার কারণে বৈশ্বিক জিডিপির ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ অবদান ভারতের। সেখানে বাংলাদেশের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৩৪, যা হওয়াই স্বাভাবিক। ভারতের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের। তবে ভারতের বুদ্ধিজীবী তথা নবেল লরিয়েট অর্থনীতিবিদরাও স্বীকার করেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা, টিকা দান কর্মসূচি, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হারসহ বেশকিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ বহু আগেই ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। করোনায় বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্য বাড়লেও ভারতে এ আয়বৈষম্য আগে থেকেই অনেক বেশি। বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় একটি উন্নত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ অবস্থায় ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নয়, বরং নিজ শক্তি ও যোগ্যতার বলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঊর্ধ্বে জিডিপি, ৪১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিংবা জিডিপির অবিরত ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটা দুর্বোধ্য আখ্যায়িত করেছেন দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। গত ২৪ অক্টোবর এক ভার্চুয়াল সংলাপে তাঁর আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল উন্নয়নের পরিসংখ্যানগত সূচকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের ভালো থাকা। শহর ও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, নাগরিকদের শিষ্টাচার প্রভৃতি দৃশ্যমান সূচকের উন্নতি হওয়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন মাপার ক্ষেত্রে জরুরি। নিঃসন্দেহে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। তবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অর্থনীতির ম্যাক্রোসূচকের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি ও জিডিপির আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক অবকাঠামো এবং জীবনযাত্রারও উন্নতি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও হবে বলে আমরা আশা করতে পারি। সে জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। উন্নয়নের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ধাপে আইনের শাসনের কঠোর প্রয়োগ এবং নাগরিকদের শিষ্টাচার চর্চা ও উন্নত জীবনধারণের আকাঙক্ষা বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন আনবে।

বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে করোনা মহামারী নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক দারিদ্র্য বৃদ্ধি, শ্রমজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবীদের অনেকের কর্মসংস্থান হারানো এবং নতুন কর্মসংস্থানে ধীরগতি, ভোগ চাহিদায় স্থবিরতা। ফলে কর জিডিপি হার কমে গিয়ে সরকারি আয়ে সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্য এবং একশ্রেণীর মানুষের অসামাজিক কার্যকলাপ ও দুর্বৃত্তায়ন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নিয়ামক ও অপচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর যথোচিত ও সতর্ক পরিচালনা এবং ব্যবসায়ী মহলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে দেশ শিগগিরই সংকট কাটিয়ে উঠে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে বলে আশা করা যায়। ##লেখক : সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব এবং বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.