--- বিজ্ঞাপন ---

পোশাক রফতানিতে চীনের হারানো বাজার দখল করবে কে, ভিয়েতনাম নাকি বাংলাদেশ

0

বিশেষ প্রতিনিধি

২০২০ সালেরে মার্চ মাস থেকে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুপ প্রভাবে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বয়ে এনেছে এক নজিরবিহীন বিপর্যয়। আর একক কোন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ২০% পর্যন্ত পোশাক রপ্তানি করে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তাছাড়া ৫৪% রপ্তানি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবং বাকি ২৬% রপ্তানি করা হয় সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে। তবে করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির ৭৪% এখনো পর্যন্ত কিন্তু চরম হুমকির মুখে রয়ে গেছে।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে চলমান দীর্ঘ মেয়াদি বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের বাজারে চীনের হারানো ক্রয়াদেশের একটি অংশ বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারির ছোবলে বিশ্ব অর্থনীতি চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ তৈরি পোশাক বানিজ্য অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। বিজিএমইএ এর তথ্যমতে, যার প্রত্যক্ষ বিরুপ প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিকারকেরা বাংলাদেশের কাছ থেকে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ১৫.৮৫% পোশাক কম কিনেছিল।

যেখানে বিজিএমইএ এর হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালের হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে ৬.০২ বিলিয়ন ডালারের পোশাক রপ্তানি করা হয়। যা আসলে বিগত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণে পোশাক রপ্তানি ছিল। তাছাড়া ২০২০ সালের শুরুর দিকে বৈশ্বিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও তা কিন্তু এপ্রিল থেকে আশাঙ্খাজনক হারে কমতে শুরু করে। আর ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রধিকারের ভিত্তিতে মোট ৫.০৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পরিমাণ মূল্যের তৈরি পোশাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়। যা কিনা ২০২০ সালে শতকরার হিসেবে ১৫.৮৫% কম ছিল।

তাছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এর এক হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২০ সালে সব মিলিয়ে মোট রপ্তানি আয় হ্রাস পেয়েছে ৫.৭৩ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪৮,৭০০ কোটি টাকা। আর সবচেয়ে বেশি আয় কমেছে তৈরি পোশাক শিল্প খাতের আয় থেকে।
আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক বাজারে চীনের নিজস্ব তৈরি পোশাক রপ্তানি মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০১৯ সালে চীন একক কোন সর্বোচ্চ দেশ হিসেবে ২৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। যেখানে তা ২০২০ সালে আশাঙ্খাজনক হারে হ্রাস পেয়ে ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। শতকরা হারের হিসেবে ২০২০ সালে আমেরিকার বাজারে চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যায় প্রায় ৩৯%।

তবে এটা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি বাংলাদেশকে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের সার্বিক তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে গেলেও এটিকে বিশ্ব মহামন্দার বিবেচনায় কিন্তু তুলনামূলক সন্তোষজনক বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। আসলে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিকারকেরা বৈশ্বিক বাজার থেকে প্রায় ২৫% কম পোশাক আমদানি করেছিল। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৪.০৭ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থের তৈরি পোশাক আমদানি করে। যা কিনা ২০১৯ সালের তুলনায় ২৩.৪৬% কম ছিল।

অটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর শীর্ষ সাত পোশাক রপ্তানিকারক চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া দেশের মধ্যে কেবল কম্বোডিয়ার রপ্তানি বৃদ্ধি পায় ৪.৭৫%। বাকি ৬টি দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হ্রাস পায় ৭% থেকে ৪০% পর্যন্ত। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির শীর্ষ তিন দেশ হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ। আর ৪র্থ অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে ৩.৫১ বিলিয়ন ডলার এবং এক্ষেত্রে দেশটির পোশাক রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২০%। ২০২০ সালে আবার ৫ম অবস্থানে থাকা ভারত ৩.০২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিল এবং সেক্ষেত্রে দেশটির তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৫.৫৮% পর্যন্ত।

অবশ্য ২০২০ সালে সালে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে তুলনামুলকভাবে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্থ হয় ভিয়েতনাম। এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনাম ১২.৫৭ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল। যা কিনা ২০১৯ সালের তুলনায় মাত্র ৭% কম ছিল। যেখানে ২০১৯ সালে ভিয়েতনাম ১৩.৫৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমেরিকার বাজারে রপ্তানি করে।

এখানে প্রকাশ থেকে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি বানিজ্য বিরোধ এবং দেশটিতে সাম্প্রতিক সময়ে গড় মজুরির হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পোশাক রপ্তানির বাজারে চীনের একক পোশাক রপ্তানি ২০২০ সালে ৩৯% হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের আশাঙ্খা অনুযায়ী চীনের সার্বিক পোশাক রপ্তানি চলতি ২০২১ সালের শেষে তা ২০% এ মেনে যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদী এবং সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করলে ও যুগোপযোগী অটোমেশন করলে খুব দ্রুত চীনের হারানো পোশাক রপ্তানি বাজারের ১৫% থেকে ২০% পর্যন্ত বাজার নিজ দখলে নিতে পারবে বলে আশা করা যায়। যেখানে বর্তমানে কিনা আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক এবং টেক্সটাইল সেক্টরে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৬% এর কাছাকাছি। যদিও বাংলাদেশের মোট রিপ্তানি আয়ের ৮৩% পর্যন্ত দখল করে রেখেছে তৈরি পোশাক শিল্প। আমাদের দেশের দ্রুত বিকাশমান তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যাবহার করে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে চীনের হারানো ২০% পোশাক শিল্পের বাজার আয়ত্ব করার বিকল্প কিছু থাকতে পারে বলে মনে হয় না।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.