--- বিজ্ঞাপন ---

হিটলার, মুসোলিনি, সাদ্দামঃ ডিক্টেটরদের শেষ পরিনতি কখনও ভালো হয় নি

0

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে ১৯৪০ সালে সভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপের স্ক্যানিভিয়া অঞ্চলের দেশ ফিনল্যাণ্ড দখলের যুদ্ধে বড় ধরণের পরাজয় বরণ করলে জার্মানীর হিটলার বাহিনী স্টালিনের সভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিক দিক দিয়ে অনেকটা দূর্বল এবং শক্তিহীন ভাবতে শুরু করে। আর হিটলার ফিনিস-সভিয়েত অসম যুদ্ধের বাস্তব পরিস্থিতি ও অবস্থা সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা না করেই অত্যন্ত গোপনে সভিয়েত ইউনিয়ন দখলে বড় ধরণের সামরিক আগ্রাসনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আসলে ফিনল্যাণ্ডের মাত্র ৬৫ হাজার অনিয়মিত সামরিক বাহিনীর কাছে সভিয়েত স্টালিন বাহিনীর প্রায় ২,২৫,০০০ সেনার মৃত্যুবরণ এবং চুড়ান্ত পরাজয়কে হিটলার সুবিশাল সভিয়েত ইউনিয়নকে দখল করা খুবই সহজ হবে বলে মনে করতে থাকে। এর ফলস্বরুপ হিটলার সভিয়েত ইউনিয়নের সাথে করা দীর্ঘ মেয়াদী অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে জার্মানীর নাৎসি বাহিনীকে সরাসরি সভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমনের আদেশ দেন।

অবশ্য তৎকালীন সময়ে নাৎসি বাহিনীর কিছু বিচক্ষণ জেনারেল এবং উচ্চ পর্যায়ের সামরিক অফিসারেরা সভিয়েত আক্রমনের চরম বিরোধীতা করলেও হিটলার এতে কর্ণপাত করেন নি এবং হিটলার তার সেনা বাহিনীকে খুব দ্রুত সভিয়েত ইউনিয়ন দখলের আদেশ দেন। হিটলারের নাৎসী বাহিনী মাত্র ৫ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে গোটা সভিয়েত ইউনিয়ন দখলে আনার মহা পরিকল্পনাকে সামনে রেখে ভয়াবহ আক্রমন শুরু করলেও বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আসলে নাৎসী বাহিনীর জন্য ছিল অত্যন্ত প্রাণঘাতী, খুবই জটিল এবং ভয়াবহ আকারের বিপদজনক এক সিদ্ধান্ত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জার্মানের নাৎসি সামরিক বাহিনী অতি মাত্রায় ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে শুরু করলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছনে ফিরে আসার আর কোন সুযোগ ছিল না।

আসলে ১৯৪১ সালর ২২ জুন হিটলার অপারেশন বারবারোসা নামে পরিচিত সোভিয়েত দখলের এক ভয়ানক সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে নাৎসি সামরিক বাহিনীর উনিশটি ডিভিশনে প্রায় ৮,০০,০০০ সেনা, ৩,০০০ ট্যাংক, ২,৫০০ যুদ্ধবিমান এবং ৭,০০০ এর কাছাকাছি হেভী আর্টিলারী সিস্টেম নিয়ে ব্যাপক মাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করলেও প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটারের অধিক সুবিশাল সভিয়েত সীমান্তে একাধিক ফ্রন্টে একই সাথে যুদ্ধ পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করাটা হিটলারের জন্য ছিল খুবই কঠিন এবং জটিল একটি বিষয়।

তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানীর নাৎসী বাহিনী তৎকালীন সময়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক পরাশক্তিধর দেশ হলেও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স বাহিনীর পাশাপাশি একই সাথে স্টালিনের সভিয়েত বাহিনীর মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ঠ মানের সামরিক সক্ষমতা ছিল কিনা তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। আবার সে সময়ে বিশ্বের আরেক উদীয়মান সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতাকে সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি জার্মানীর হিটলার বাহিনী। যাই হোক, সভিয়েত আক্রমনে নাৎসী বাহিনীর মুল পরিকল্পনা ছিল যত দ্রুত সম্ভব সভিয়েত ইউনিয়নে ছড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্র এবং বড় বড় শহরগুলো দখল করে নিয়ে জার্মান বাহিনীর প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ব্যাপক চাহিদা ও সরবরাহ সুনিশ্চিত করা।

সভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমনের প্রথম দিকে নাৎসি বাহিনী ব্যাপক সাফল্য লাভ করলেও কিছু দিনের মধ্যেই তারা ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে শুরু করে। আসলে দীর্ঘ মেয়াদী এবং বিরামহীন লাগতার যুদ্ধ, সভিয়েত ইউনিয়নে তীব্র ঠাণ্ড, খাদ্য সংকট এবং প্রতিকূল পরিবেশে নাৎসি বাহিনী খুব দ্রুত ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে -২৫ ডিগ্রী তীব্র ঠাণ্ডায় এবং প্রতিকুল পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে রোগে ও খাদ্যাভাবে হাজার হাজার সেনা মৃত্যুবরণ করতে থাকে।

অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রাণঘাতী এই বারবারোসা সামরিক আগ্রাসনে ইতিহাসে অল্প সময়ের মধ্যে দুই পক্ষেই প্রায় ১ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আসলে এ যুদ্ধে সভিয়েত বাহিনী জার্মানীর আক্রমনের মুখে পিছু হঠতে থাকলেও তাদের পোড়া মাটি নীতির যুদ্ধ কৌশলের কাছে বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে থাকে জার্মানীর হিটলার বাহিনী। স্টালীনের পোড়া মাটি নীতি বলতে বুঝায়, সভিয়েত বাহিনী পিছনে সরে গেলেও, যাওয়ার সময় তাদের নিজের শহর এবং বন্দরের সকল সুবিধা যেমন তেলক্ষেত্র, পানি ও খাদ্যের উৎস ধ্বংস করে দিয়ে পিছনে হঠতে থাকে। এতে করে জার্মান বাহিনী কোন সভিয়েত শহর বা বন্দর দখল করলেও বাস্তবে তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে বিশেষ কোন সুযোগ সুবিধা পেত না। স্টালিন বাহিনী নিজেরাই তাদের কৌশলগত তেলক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করে দিয়ে পিছনে সরে যাওয়ায় হিটলারের সভিয়েত ইউনিয়নের তেলক্ষেত্র দখলের মূল পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানী সরবরাহের নতুন উৎস নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার এক মহা পরিকল্পনা রকম ভেস্তে চলে যায়।

তাছাড়া যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে সভিয়েত ইউনিয়নে অতি মাত্রায় শীত এবং ব্যাপক তুষারপাত শুরু হলে -২৫ ডিগ্রী শীতল তাপমাত্রায় জার্মান সেনাদের বেঁচে থাকাটা এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। চরম মাত্রায় খাদ্য ও পানীয় ঘাটতি, জ্বালানী সংকট এবং সর্বোপরি পর্যাপ্ত গোলা বারুদ এবং যুদ্ধাস্ত্র সংকটের মুখে সভিয়েত ইউনিয়নের মাটিতে জার্মানীর হিটলারের বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়।

তাছাড়া একই সাথে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশের সাথে চলমান যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকায় সভিয়েত ইউনিয়নে শতভাগ শক্তি প্রয়োগের বিকল্প কোন সুযোগ ছিল না নাৎসি বাহিনীর কাছে। আর এই সভিয়েত আগ্রাসন যুদ্ধে নাৎসী বাহিনীর প্রায় ৬,৮০,০০০ বা প্রায় ৮০% সেনা মৃত্যুবরণ করলে সার্বিকভাবে এর বিরুপ প্রভাব কিন্তু গোটা ইউরোপ জুড়ে চলমান প্রায় সকল স্পর্শকাতর যুদ্ধক্ষেত্রে বা ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর উপর পড়ে যায়। ফলস্রুতিতে প্রায় সকল ফ্রন্টেই জার্মান বাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে যায়। আর এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে বিংশ শতাব্দির এক ভয়ানক এবং প্রাণঘাতী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর মূল হোতা লৌহমানব বা ডিটেক্টর হিটলারের। তাছাড়া ৫ ডিসেম্বর ১৯৪১তারিখে মাত্র ৫ মাস, ১ সপ্তাহ ও ৬ দিনের মাথায় এই ভয়াবহ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও এর মাধম্যে হিটলারের করুণ পরিণতি ও পরাজয় কিন্তু এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়।

ইতিহাস বলছে, বিশ্বের প্রায় সকল লৌহমানব বা ডিক্টেটর নিজেকে সব সময় অসীম ক্ষমতার অধিকারী এবং অতিমানবীয় মনে করলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু নিজের ভূল সীদ্ধান্ত এবং অহমিকতায় নিজের পতন নিজেই ডেকে আনে। জার্মানীর হিটলার নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে গড়ে তুললেও শেষ পর্যন্ত তার গুরুতর ভূলের কারণে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। আবার প্রায় ২৫০ খ্রীষ্টাব্দ পূর্বাব্দে যদি আলেক জাণ্ডার দ্যা গ্রেটের বিশ্ব জয়ের কথা বলা হয়, তাহলে সেখানেও কিন্তু মহা ক্ষমতাশীল হয়েও মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই আলেক জাণ্ডার দ্যা গ্রেট শেষ অবধি ভারত বর্ষ দখল করতে এসে নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। বিশ্ব জয়ের নেশা এবং অতি মাত্রায় যুদ্ধ আসক্তিই মুলত খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের মহান ডিক্টেটর বা লৌহমানব আলেক জাণ্ডার দ্যা গ্রেটের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয়।

ঠিক একই পথ ধরে বলা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর লৌহমানব নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং বিংশ শতাব্দীর হিটলার, মুসোলিনী, সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফী এবং রবার্ট মুগাবের মতো লৌহমানব বা ডিটেক্টর নিজের দেশে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু কেউই নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। বরং তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে এসব কথিত ডিক্টেটরদের কর্মফল বা অপকর্মের জন্য কিন্তু নিজ দেশের সাধারণ জনগণকে জীবন দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে চরম মূল্য দিতে হয়েছে বা এখনো অনেক দেশকে তার অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আবার অনেক ডিক্টেটর দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকলেও তার দেশের লাখো সাধারণ নিরীহ মানুষগুলো কিন্তু ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে রয়েছে। বর্তমানে সাদ্দামের ইরাক ও গাদ্দাফীর লিবিয়ার এহেন চরম মাত্রায় এবং দীর্ঘ মেয়াদী ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি বলে দেয় দেশগুলোর আজ কি ভয়াবহ করুণ অবস্থা।

এদিকে সিরিয়ার বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় টিকে থাকতে সিরিয়াকে আজ এক ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছে। প্রায় ১০ বছর ব্যাপী চলা গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় প্রায় ৯ লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের করুণ মৃত্যুর পাশাপাশি দেশটির আজ প্রায় ছয় থেকে সাত মিলিয়ন মানুষ নিজ দেশেই কিংবা অন্য কোন দেশের শরণার্থী শিবিরে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে এবং বাস্তচ্যুত অবস্থায় অস্থিতিশীল যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে মানবেতর জীবব-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে আবার চীনের শি জিং পিং এবং রাশিয়ার পুতিন সাহেন এক বিংশ শতাব্দীর নব্য ডিক্টেটর সেজে বিশ্ববাসীকে আবারো নতুন করে ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.