--- বিজ্ঞাপন ---

অবশেষ আমেরিকা হাত বাড়ালো ভারতের প্রতি, টিকাসহ সব সহযোগিতা দেবে

0

অবশেষে মন গলেছে আমেরিকার। ভারতের করোনা মোকাবেলায় হাত বাড়িয়েছে তারা। ভারতের একের পর এক আর্জি ছিল অবিলম্বে এসট্রাজেনেকার টিকার জন্য। কিন্ত বাইডেন সরকার সিদ্ধান্ত নিতে সময় নেয়।

ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজারের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়,  ভারতে টিকা তৈরির কাঁচামাল পাঠাবে বলে জানাল আমেরিকা। রবিবার তেমনটাই জানা গেল আমেরিকা প্রশাসনের তরফে জারি করা একটি বিবৃতির মাধ্যমে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেরাম ইনস্টিটিউটে কোভিশিল্ড টিকা প্রস্তুত করার জন্য যে সমস্ত কাঁচামালের প্রয়োজন, তা পাঠানো হবে জলদি। তীব্র সমালোচনার পরে সিদ্ধান্ত বদল করল আমেরিকা।

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তেই ধসে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। অক্সিজেন, টিকা, ওষুধ— করোনা সংক্রমণ রোখার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট দেখা দেওয়ার পরে আমেরিকার কাছে সাহায্য চেয়েছিল ভারত। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের তরফে টিকা তৈরির কাঁচামাল রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তার পরেই দেশের জনসাধারণ ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাইডেনের প্রতি। ঠিক দেড় বছর আগের প্রসঙ্গ তোলা হয়। গত এপ্রিলে যখন আমেরিকা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চেয়েছিল ভারতের কাছে, তখন ৫ কোটি ট্যাবলেট পাঠানো হয়েছিল সে দেশে। কিন্তু যখন তাদের সময় এল, সাহায্য করবে না বলে জানিয়ে দিল আমেরিকা।

এমনই সময়ে আমেরিকা বিবৃতি জারি করল ভারতকে সাহায্য করবে বলে। জানানো হয়েছে, আমেরিকা ভারতের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবে এই অতিমারি মোকাবিলা করতে। টিকা তৈরির কাঁচামালের পাশাপাশি পাঠানো হবে কোভিড চিকিৎসা সরঞ্জামও। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র এমিলি হর্ন সে কথা নিশ্চিত করেছেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভানের মধ্যে কী কথোপকথন হয়েছে, তা জানিয়েছেন এমিলি। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতের কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষা করার জন্য আমেরিকা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। পিপিই কিট, র‌্যাপিড টেস্ট কিট, ওষুধের সরঞ্জাম, ভেন্টিলেটর পাঠানো হবে খুব তাড়াতাড়ি।’’আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (সিডিসি) জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি দলকেও দিল্লি পাঠানো হবে। যাঁরা আমেরিকার দূতাবাস ও ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অতিমারি মোকাবিলায় কাজ করবেন।শনিবার বাইডেন প্রশাসনের কাছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-র টিকা পাঠানোর জন্য আর্জি জানিয়েছিলেন আমেরিকার কংগ্রেসের ভারতীয় বংশোদ্ভূত সদস্য রাজা কৃষ্ণমূর্তি। কেবল ভারত নয়, আরও বেশ কয়েকটি দেশে জরুরি ভিত্তিতে টিকা পাঠানোর কথা বলেছিলেন তিনি। এ ছাড়া গত মাস থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান আদর পুনাওয়ালা একাধিক টুইট করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে। টিকা তৈরির কাঁচামালের রফতানির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি।

কি ছিল ভারতের আর্জি

কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ হয়ে ওঠায় ভারত-সহ কয়েকটি দেশে জরুরি ভিত্তিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-র টিকা পাঠানোর জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের কাছে আর্জি জানালেন আমেরিকার কংগ্রেসের ভারতীয় বংশোদ্ভূত সদস্য রাজা কৃষ্ণমূর্তি। শনিবার তিনি এই আর্জি জানিয়েছেন বাইডেন প্রশাসনের কাছে।

শনিবার ভারতে নতুন কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৮৬। গত বছর কোভিড সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এক দিনে আক্রান্ত হওয়ার নিরিখে ভারতে যা সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে কোভিডে ২ হাজার ৬২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

একটি বিবৃতিতে কৃষ্ণমূর্তি বলেছেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমেরিকার কাছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-র বানানো কোভিড টিকার ৪ কোটি ডোজ মজুত রয়েছে। তার একটা অংশ আমরা ইতিমধ্যেই মেক্সিকো ও কানাডায় পাঠাতে শুরু করেছি। বিশ্বে সংক্রমণ যে ভাবে বাড়ছে তাতে দরজাটা আরও উন্মুক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমি বাইডেন প্রশাসনের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি ভারত, আর্জেন্টিনার মতো কয়েকটি দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-র বানানো কোভিড টিকার কয়েক লক্ষ ডোজ জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হোক। এর ফলে এই দেশগুলি কোভিড মোকাবিলায় আরও শক্তি অর্জন করবে।’

আমেরিকার ব্যাপক সমালোচনা ভারতীয় গণমাধ্যমে

আনন্দবাজার লেখে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাউস ঢাউস বাক্সে আমেরিকায় ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তখন ট্রাম্পের বিশ্বাস ছিল, কোভিড সংক্রমণ রুখতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের জুড়ি মেলা ভার! বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই বলছিলেন, ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কার্যকরী হবে না কোভিড সংক্রমণ রুখতে। বরং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবু ট্রাম্পের তখন অগাধ বিশ্বাস হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের উপর। অথচ ছিঁটেফোঁটাও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নেই ট্রাম্পের দেশে। আর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তৈরি করে ভারতই। তাই বন্ধু মোদীর কাছে সাহায্য চাইতে দেরি করেননি মোদী। আমেরিকায় ভোটের বছরে বন্ধু ট্রাম্প যাতে বিপদে না পড়েন সে জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দেরি করেননি মোদীও। গত এপ্রিলে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ৫ কোটি ট্যাবলেট বিমানে চাপিয়ে আমেরিকায় পাঠিয়েছিল ভারত। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রফতানির নিষেধাজ্ঞা তড়িঘড়ি তুলে নিয়ে।

এ বার ভারতের দরকার দেশে কোভিড টিকা তৈরির কাঁচামাল। সেটা আমেরিকাই দিতে পারে। তাই আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিল ভারত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গোড়া থেকে ‘ভারতবন্ধু’ হিসাবে পরিচিত বাইডেন কোনও স্পষ্ট আশ্বাস এখনও পর্যন্ত দেননি। বরং তাঁর প্রশাসন টিকা তৈরির কাঁচামাল রফতানির উপর জারি করেছে নিষেধাজ্ঞা।

আমেরিকার বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আমেরিকায় থাকা ভারতের রাষ্ট্রদূত তরণজিৎ সিংহ সান্ধুও এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জানা গিয়েছে, নয়াদিল্লিকে বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, ভারতে টিকা তৈরির ক্ষেত্রে যাতে সমস্যা না হয় সে দিকে নজর দেবে তারা। তবে প্রথমে দেশের মানুষের চাহিদা মেটানো হবে। তার পরেই কাঁচামাল রফতানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কেন? প্রশ্নটা উঠছে এই কারণেই যেহেতু আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারের গোড়া থেকেই বার বার নিজেকে ‘ভারতবন্ধু’ হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন বাইডেন ও কমলা হ্যারিস, পরে যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তাঁরা ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঠাঁই পেয়েছেন বাইডেন-হ্যারিসের মন্ত্রিসভায়। এর পরেও তা হলে কেন এমন আচরণ আমেরিকার?

এক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, এর কারণ জানতে হলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। ২০১৬-য় আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারের ছবিটা ছিল একেবারে বিপরীত। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প তখন ‘ভারত-বিদ্বেষী’ বলেই ছিলেন সর্বজনবিদিত। ২০১৮ থেকে অবশ্য তিনি একটু একটু করে ভারতের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। চিনকে ‘সমঝে রাখা’ যাবে ভেবে। একই সঙ্গে ফের হোয়াইট হাউসে ফেরার ‘পথের কড়ি’ জোগাড় করে দিতে পারেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা, এই উপলব্ধি থেকে পুনর্নিবাচিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ট্রাম্প আরও বেশি করে মোদীর বন্ধু হয়ে উঠতে চেষ্টা করেন। মোদীকে নিয়ে ‘হাউডি মোদী’-র মতো জমকালো অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন ট্রাম্প, তাঁর নিজের মুলুকে। নিজের দেশে ভোটের বছরে অতলান্তিক মহাসাগর পেরিয়ে আসেন ভারতে, মোদীর রাজ্য গুজরাতে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সুতরাং বর্তমানে টিকা তৈরির কাঁচামালের উপর ‘ভারতবন্ধু’ বাইডেন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টা দেখতে হবে এই প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে।

এক কূটনীতিবিদের কথায়, ‘‘আজ না হলে কাল ভারতকে টিকা তৈরির কাঁচামাল দেবে আমেরিকা। কিন্তু চাইলেই দেবে না। একটু ঝুলিয়ে রাখবে। বাইডেন, হ্যারিস চাইছেন মোদী সমস্যাটা নিয়ে একটু ভাবুন। উদ্বিগ্ন থাকুন। হিউস্টনে ট্রাম্পের হাত তুলে ধরে তো মোদীই বছর তিনেক আগে বলেছিলেন, ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’। দু’এক জন বাদে কোনও ডেমোক্র্যাটই সেই সময় হাজির থাকেননি ট্রাম্পের ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানে। থাকেননি হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিও। কমলা হ্যারিসই বা কী ভাবে ভুলতে পারেন, নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় বলায় কী ভাবে মোদীর অনুগামীদের শ্লেষবিদ্ধ হতে হয়েছিল তাঁকে।’’

ওই কূটনীতিকের বক্তব্য, ‘‘আমেরিকা চাইছে টিকা তৈরির কাঁচামাল পাওয়ার জন্য আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত তরণজিৎ সিংহ সান্ধু ক্যাপিটল হিলকে সাধাসাধি করুন। সাধাসাধি করুন পেলোসিকেও। তা হলে শেষ পর্যন্ত দেওয়া হবে। আর দিলেই ঢাকঢোল পিটিয়ে তা ঘোষণাও করবে বাইডেন প্রশাসন।’’

সবশেষে আমেরিকার মন গলায় স্বস্তি ফিরে এসেছে ভারতে। এখন দ্রুত সব কিছু কার্যকর করতে ভারত সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.