--- বিজ্ঞাপন ---

ইসরাইলের সাথে ফিলিস্তিনিরা কি বড় ধরনের কোন যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে ?

0

কাজী আবুল মনসুর / সিরাজুর রহমান

ইসরাইলের সাথে ফিলিস্তিনিরা কি বড় ধরনের কোন যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিশ্বের সচেতন মানুষগুলোর কাছে। ফিলিস্তিনকে কি শেষ করতে চাইছে ইসরাইল। যেভাবে একের পর এক হামলা চলছে তাতে ফিলিস্তিনের সাধারন মানুষ মারা যাচ্ছে। বুধবার পর্যন্ত ইসরাইলের গাজায় মারা গেছে ৫৬ জন। এর মধ্যে ১৪ জনই শিশু ও ৫ জন নারী। আনাদুলো জানায়,প্রায় সাড়ে ৩শ আহত হয়েছে। ইসরাইল থেমে হামলা অব্যাহত রেখেছে।

জানা গেছে, ফিলিস্তিনিদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে ইসরাইল সব সময় কোন না কোন হাঙ্গামা করে যায়। নিরীহ ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষপর্যন্ত তাদের পক্ষে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালিন সময়ে পরিকল্পিতভাবে ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশগুলোর চুক্তি করাই। ভয়ের কারন এখন একটাই তা হলো, বিগত আরব – ইসরাইল যুদ্ধের মতো মুসলিম দেশগুলো কি নিরীহ ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে।

গত সোমবার ইজরায়েল অধিকৃত গাজা ভূখণ্ড এবং জেরুসালেমের একাংশে হামলা চালিয়েছিল হামাস। পালটা জবাব দেয় ইজরায়েলও। ইজরায়েলের সেনার সাফাই, তারা হামাসের উদ্দেশেই আক্রমণ চালিয়েছিল। এদিকে তার আগে গাজা থেকে করা রকেট হামলায় ৩ জন ইজরায়েলি মারা যান। সব মিলিয়ে রীতিমতো উত্তপ্ত পরিবেশ। এরই মধ্যে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানির একটি পাইপ লাইন ফিলিস্তিনি রকেট হামলায় ধ্বংস হয়েছে। ডেইলি সাবাহ্র খবরে জানা যায়, মঙ্গলবার ইসরাইলের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট প্রতিরোধী প্রতিরোধী ব্যবস্থা ওই রকেট হামলা প্রতিরোধ করতে পারেনি। বার্তা সংস্থা রয়টার্স ইসরাইলের সরকারি কর্মকর্তা ও দেশটির জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এ খবর প্রকাশ করেছে।

চ্যানেল ১২ টিভির ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরাইলের ভূমধ্যসাগরীয় শহর আশকেলনের একটি বড় জ্বালানি কেন্দ্রে লেলিহান অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছে। এ আশকেলন শহরটি তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত।অবশ্য চ্যানেল ১৩ জানিয়েছে, আশকেলনের জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি। ওই দিনের (মঙ্গলবার) প্রথমদিকে অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ২৮ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়। হতাহতদের মধ্যে শিশুও আছে। জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদের চত্বরে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের মধ্যেকার চরম অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের মধ্যেই এ সহিংস সঙ্ঘাত শুরু হয়েছে।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় নিহতদের মধ্যে ১০ জন শিশু ও একজন নারী রয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরো ১৫২ জন। ইসরাইলি হামলার জবাবে ফিলিস্তিনিরা হামাস নিয়ন্ত্রিত অবরুদ্ধ গাজা থেকে আশকেলন শহরে রকেট হামলা করলে দু’জন ইসরাইলি নারী নিহত হয় বলে জানান দেশটির জরুরি বিভাগের কর্মকর্তা মাজেন ডেভিড অ্যাডম।

জানা গেছে, ঘটনার সুত্রপাত মসজিদুল আল আকসা থেকে। এ মসজিদে ফিলিস্তিনি মুসলিমরা জুমাতুল বিদা নামাজ আদায় করছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই ইসরাইলি ইহুদি সৈনিকেরা নামাজরত মুসল্লিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এই হামলায় আনুমানিক ২০ জন শহীদ হয়েছেন ও দুই শতাধিক আহত হয়েছে।
এর মধ্যে হামলার নিন্দা জানিয়েছে, বাংলাদেশ, তুরস্ক ও পাকিস্তান। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ফিলিস্তিনদের আশ্বস্ত করেছেন যে তাদের পাশে সবসময় তুরস্ক থাকবে গোলাবারুদ ও অস্ত্র সহ বিমান দিয়ে সাহায্য করবেন। বাকি দেশগুলো কি প্রতিক্রিয়া দেখায় এটাই এখন দেখার বিষয়।

ইসরাইল -ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব যে কারনে

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরব ভূমি ফিলিস্তিনে ইহুদীরা ব্যাপক হারে আসা শুরু করলে ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছে যায়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়ে যায়। তবে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্থার জেমস বালাফর ফিলিস্তিন ভূখন্ডে নতুন একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে সারা ইউরোপ থেকে হাজার হাজার ইহুদি জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে দেয়।

১৯১৯ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদির সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ হাজার। অথচ ১৯৩১ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছে যায় এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছয় থেকে আট লাখে উন্নীত হয়। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ফিলিস্তিনে ব্যাপক হারে ইহুদিদের আগমনের বিষয়টিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরবরা বিপদজনক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করেনি। বরং ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসতে থাকলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণামের বিষয়টিকে বিবেচনা না করেই ফিলিস্তিনের স্থানীয় আরবরা হাজার হাজার একর জমি অপেক্ষাকৃত ধনী ইহুদিদের কাছে বিক্রি করে দিতে থাকে।

এতে করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন নতুন এলাকায় এবং জনমানবহীন অঞ্চলে ইহুদি বসতি গড়ে উঠে। তার পাশাপাশি ফিলিস্তিনের একটি বড় অংশ চীর দিনের মতো ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তাছাড়া ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সারা ইউরোপে ইহুদীবিদ্বেষ হিটলারের নির্দেশে ৫০ লক্ষের কাছাকাছি ইহুদি জনগোষ্ঠী গণহত্যার শিকার হলে আবারো সারা ইউরোপ থেকে লক্ষ লক্ষ ইহুদি স্থায়ীভাবে ফিলিস্তিনে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। এ সময় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জনসংখ্যা ১০ লাখের সীমাকে অতিক্রম করে ফেলে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটি স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা করলে শুরু হয় ভয়াবহ প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ।

আসলে ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল নামক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলে বিভিন্ন সময়ে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের চার বার ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যা কিনা আরব-ইসরাইল যুদ্ধ নামে পরিচিত। তবে ১৯৪৮-৪৯ সালে আরব-ইসরাইল প্রথম যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে ও আফ্রিকায় মোট ২১টি আরব দেশ থাকলেও আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মাত্র ৭টি আরব দেশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অথচ যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলি সৈন্যসংখ্যা ছিল আরবদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই যুদ্ধে ইসরায়েল মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নামায় এবং তাদের যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম ছিল আরবদের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক। যেখানে কিনা মিশর, ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব, ইয়েমেন এবং খুব সম্ভবত লেবানন মিলিয়ে মোট ৭টি আরব দেশ সম্মিলিতভাবে মাত্র ৬৩ হাজার সৈন্যকে ফিলিস্তিনে প্রেরণ করে ইসরাইলকে মোকাবেলা করার জন্য।

প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশর একা ২০ হাজার, ইরাক ১৮ হাজার এবং সিরিয়া ১৮ হাজার সেনা সমাবেশ করলেও সৌদি আরবের ছিল ১,২০০ এবং ইয়েমেনের ছিল মাত্র ৩০০ জন সেনা। আরব ইসরাইল প্রথম যুদ্ধে আসলে সৌদি আরব এবং ইয়েমেনের অংশগ্রহণ ছিল একেবারেই প্রতিকী বা মানমাত্র। তাছাড়া আর কোন আরব রাষ্ট্র এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।

যুদ্ধের শুরু থেকেই আরব দেশগুলো যে যার মতো করে নিজের এজেণ্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এবং নিজেদের মধ্যে চরম মাত্রায় সমন্বয়হীনতার কারণে খুব দ্রুতই যুদ্ধের ময়দানে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি শত শত ফিলিস্তিন গ্রাম ও নগর ধ্বংস হয়ে যায় এবং ইসরায়েল কিন্তু নতুন করে ফিলিস্তিনের প্রায় ৭০% এলাকা দখল করে নেয়।

যদিও প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরুর আগেই ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিতকরণ সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব পাশ করা হয়। যার আওতায় জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের ৪৫ শতাংশ ভূমি ফিলিস্তিন আরবদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদিদের দিয়ে দুটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাছাড়া ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা স্বতন্ত্র শহর হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ করা হয়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.