--- বিজ্ঞাপন ---

ইসরাইলের যত ভয় হামাসকে নিয়ে

0

বিশেষ প্রতিনিধি, মধ্যপ্রাচ্য

ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের আগ্রাসনের মুখে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে তার সংগঠনের যোদ্ধারা। তিনি বলেন, দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হামাস যোদ্ধারা দৃঢ়চেতা অবস্থানে রয়েছে।

টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে ইসমাইল হানিয়া মঙ্গলবার বলেন, দখলদার ইসরাইল সরকার যতদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে তার ঘৃণ্য অপরাধযজ্ঞ বন্ধ না করবে এবং পবিত্র জেরুজালেম আল-কুদস শহর ও আল আকসা মসজিদের ওপর দখলদারিত্বের অবসান না ঘটাবে, ততদিন পর্যন্ত হামাস যোদ্ধারা প্রতিরোধ লড়াই অব্যাহত রাখার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি সুস্পষ্ট করে বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত ইহুদিবাদী ইসরাইল তার আগ্রাসন এবং সহিংসতা অব্যাহত রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার জবাব দেয়ার অধিকার রাখে ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনি জনগণকে রক্ষার অধিকার হামাসের রয়েছে।”

গাজা উপত্যকা থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবে একসাথে যে ১৩০টি রকেট হামলা চালিয়েছে তার ভূঁয়সী প্রশংসা করেন ইসমাইল হানিয়া। তিনি বলেন, “পবিত্র জেরুজালেম ও আল আকসা মসজিদ রক্ষায় আমরা বিজয় লাভ করেছি এবং যুদ্ধ কিংবা শান্তি যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি

ফিলিস্তিনের ফাতাহ এবং হামাস
ফিলিস্তিনে দুটো রাজনৈতিক দল সক্রিয়। ফাতাহ এবং হামাস। দুটো দলই সুন্নি। ফাতাহ দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৯ সালে। প্রথমদিকে সংগঠন টি গোপনে কার্যক্রম চালাতো। ফাতাহ দলটির প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত। ১৯৬৫ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের সহযোগিতায় ইয়াসির আরাফাত প্রকাশ্যে ফাতাহ দলটির ঘোষণা করেন। এ সময় দলটি ইসরায়েলের দখলদারিত্ব র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র সংগ্রাম এই দুটো একসাথেই চালিয়ে যাবার প্রত্যয়ে এগিয়ে যায়। ফাতাহ দলটি তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের থেকে ব্যাপক সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পায়। অন্যান্য আরব রাষ্ট্র থেকেও তারা তখন সাহায্য পায়। তারা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব র বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণকে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করে। সব ভালো মতই চলছিলো। কিন্তু এরপর মিসরের ক্ষমতায় আসেন আনোয়ার সাদাত। তার শাসনামলে ফিলিস্তিন তথা ফাতাহ র প্রতি মিসরের সহযোগিতা কমতে থাকে। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমলে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে মিসর তার বিশাল জায়গা সিনাই উপদ্বীপ ইসরায়েলের কাছে হারায়। সাদাত প্রসিডেন্ট হয়ে সিনাই উপদ্বীপ ইসরায়েলের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। ১৯৭৩ সালের আরব ইসরায়েল যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট সাদাত সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন সিনাই উপদ্বীপ মুক্ত করতে। কিন্তু যুদ্ধে হেরে যান। এরপর
তিনি ইসরায়েলের সাথে আলোচনায় বসেন এবং মিশর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির কারণে আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিম শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। চুক্তির ফলে মিশর সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পায়। সাধারণ ভাবে মিশরীয়দের কাছে তা জনপ্রিয় হলেও মুসলিম ব্রাদারহুড ও বামপন্থিরা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ব্যাপারে কোনো প্রচেষ্টা না থাকায় তা প্রত্যাখ্যান করে। বাকি আরব বিশ্বের সাথে আলোচনা না করে ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তিকে সুদান ছাড়া বাকি আরব দেশগুলো ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন তথা ফাতাহ প্রতিবাদ করে। পরবর্তীতে আনোয়ার সাদাত কে ভরা মিলিটারি প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রকাশ্যে হত্যা করে মিসর সেনাবাহিনীর একটা অংশ। মিসরের ক্ষমতায় আসেন এরপর হোসেনি মোবারক। তিনিও ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি এগিয়ে নেবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ফলে তার শাসনামলেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহযোগিতা প্রায় বন্ধই থাকে। ফলে মিসরের থেকে ফাতাহ র প্রতি রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ফাতাহ শেষ পর্যন্ত তার নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়।
১৯৯৩ সালে ইসরাইলের সঙ্গে অসলো আপোস চুক্তি স্বাক্ষরের আগ পর্যন্ত ফাতাহ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মুক্ত করার নীতিতে অবিচল ছিল। কিন্তু আপোস চুক্তি স্বাক্ষরের পর ফাতাহ’র তৎপরতা কেবল রাজনৈতিক সংগ্রামেই সীমিত হয়ে পড়ে। নীতিগত এই পরিবর্তনের কারণে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে খুবই সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯৪ সালে।

শান্তি চুক্তি র ফলে ইয়াসির আরাফাত নোবেল পুরস্কার পান। এবং জাতিসংঘ ইয়াসির আরাফাত কে ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন এবং যতদিন না ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হয় ততদিন তিনি রাষ্ট্র প্রধানের মর্যাদা ভোগ করবেন।২০০৪ সালের ১১ ই নভেম্বর ইয়াসির আরাফাতের রহস্যজনক মৃত্যুর পর স্বশাস কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক সংগ্রাম দূর্বল হয়ে পড়ে।
ফিলিস্তিনের কট্টর ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হামাস। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। কারন মিসরের কাছ থেকে সামরিক সহযোগিতা না পেয়ে ফাতাহ তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম স্তিমিত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরায়েলের নির্যাতন তো আর থেমে থাকে নি। ইসরায়েলের অত্যাচারে ফিলিস্তিনিরা আরও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পড়ে। কিন্তু ফাতাহ তখন ফিলিস্তিনিদের সেই প্রতিশোধ পরায়ণ আবেগের সাথে তাল মেলাতে পারে নি, কারন মিসরের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছিলো না। ফলে ফিলিস্তিনি দের সেই আবেগের ফলে জন্ম নেয় হামাস। হামাস সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাদের চাওয়া হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামি রাষ্ট্র।
হামাস প্রাথমিকভাবে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। প্রথমত, এর সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাশেম ব্রিগেডসের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা।
কট্টর ইসরায়েলবিরোধী আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসিনের নেতৃত্বে আবদেল আজিজ আল-রান্তিসি ও মাহমুদ জহর হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৪ সালের মার্চে গাজায় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন আহমাদ ইয়াসিন। পরের মাসেই নিহত হন আজিজ আল-রান্তিসি। সংগঠনটির বর্তমান প্রধান খালেদ মিশাল।
ইসরায়েল বিরোধী কট্টর অবস্থান, ইসরায়েলে রকেট হামলা চালানোর দীর্ঘ ইতিহাস ও এই অবস্থান থেকে সরে না আসার দৃঢ় ঘোষণার কারণে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে কোনো কোনো দেশ। এ তালিকায় রয়েছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান এবং ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
২০০৫ সালের সংসদ নির্বাচনে ১৩২টি আসনের মধ্যে হামাস ৭০টি আসনে জয়ী হয়। আরব লিগ ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থার পর্যবেক্ষকরাসহ আন্তর্জাতিক অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা হামাসের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করে ওই নির্বাচনকে সুষ্ঠ বলে ঘোষণা করে। ফলে ফিলিস্তিনে ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় হামাসের সরকার। অভ্যন্তরীণ জনসমর্থন ও অন্তবর্তীকালীন ফিলিস্তিনি সংবিধানের আলোকে এগিয়ে যায় হামাস। কিন্তু আব্বাসের স্বশাসন কর্তৃপক্ষ হামাস সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং এভাবে দুই পক্ষের মধ্যে বিভেদ জোরদার হয় এবং সংঘাত তুঙ্গে উঠে ২০০৭ সালে যখন এক লড়াইয়ে হামাস গাজা দখল করে। এখনো গাজার শাসনক্ষমতায় তারা। পশ্চিম তীরের শাসনক্ষমতা ফাতাহর হাতে। তবে ফিলিস্তিনে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
গাজা থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে হামাসের রকেট হামলা চালানো বন্ধ করার কথা বলেই ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনটি বড় অভিযান চালায় ইসরায়েল। গত বছরের জুলাইয়ে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের পতনের পর প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে যায় কট্টরপন্থী এ সংগঠনটি। ইরানের কাছ থেকে এখনো কিছু অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পায় বলে মনে করা হয়। তবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সমর্থন করায় হামাসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইরান। তবে ইরানের সাথে বর্তমানে হামাসের সম্পর্ক উন্নতি র আভাস মিলেছে।
ফিলিস্তিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিলো ২২ মে। সব জনমত সমীক্ষাতেই হামাসের জয়ের স্পষ্টতা ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ফিলিস্তিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ( ফাতাহ নেতা) নির্বাচন স্থগিত করেন। ইসরায়েল, আমেরিকা সহ পশ্চিমারা এবং তাদের মিত্র আরব দেশগুলো চায় ফিলিস্তিনের ক্ষমতায় ফাতাহ থাকুক। কিন্তু ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ মানুষের রায় হামাসের দিকেই রয়েছে বলে সুত্র জানায়।

হামাসের জম্ম যেভাবে
হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শহীদ শেখ আহমাদ ইয়াসিন। তিনি ইজরাইলী সেনাদের মিসাইল হামলায় শাহাদাত বরণ করেন।
হামাসের প্রথম গঠনতন্ত্র রচনা করেন আব্দুল আজীজ রানতিসি। তিনিও ইজরাইলী সেনাদের হাতে শহীদ হন।আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন সালিহ শাহাদাহ। তিনি ২০০২ সালে গাজায় ইজরাইলী হামলায় শহীদ হন।

হামাসের প্রথম রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ছিলেন মুসা আবু মারজুক। ক্যারিয়ার- সংসার সেভাবে করতে পারেননি বহুবছর। আজ এ দেশে তো কাল আরেক দেশে। এভাবেই পার করেছেন জীবনের সোনালী বসন্তগুলো।হামাসের আলোচিত সাবেক রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান খালিদ মিশাল। জন্ম নিয়েছেন উদ্বাস্তু হয়ে। নিজ দেশের মাটিতে জন্ম নেয়ারও সুযোগ পাননি। সারা জীবন দেশকে স্বাধীন করার জন্য আন্দোলন করে গেলেন। অথচ দেশে পা দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন একবার। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বছরের পর বছর।হামাসের বর্তমান প্রধান ইসমাইল হানিয়া। চোখের সামনে একের পর এক সহকর্মীর শাহাদাত দেখেছেন। জনগনের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু কাজ করার সুযোগ পেলেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার করেন প্রতিটি মুহুর্ত।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.