--- বিজ্ঞাপন ---

দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং, ৩০ ডলারের ব্যবসা এখন ৪৭৩ বিলিয়ন ডলার!

0

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু আগের বছর ১৯৩৮ সালের পহেলা মে দক্ষিণ কোরিয়ার একজন সাধারণ ব্যবসায়ী লি বিয়াং চুল মাত্র ৩০ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে একটি ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনি ১২ই ফেব্রুয়ারী ১৯১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দেন স্যামস্যাং। স্যামস্যাং এর ব্যবসার শুরু দিকে কোন ধরণের ইলেক্ট্রনিকস কিংবা ভারি শিল্পপন্য তৈরি বা রপ্তানি করত না। বরং প্রথম দিকে লি বিয়াং চুল তার স্যামস্যাং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটিতে দক্ষিণ কোরিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী তেইগু শহরে মাত্র ৪০ জনের মতো কর্মচারী এবং স্টাফ নিয়ে বড় ধরণের মুদি দোকানের মতো ঘরে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে স্যামস্যাং দক্ষিণ কোরিয়ার স্থানীয় পন্য যেমন শুটকী, লুডলস এবং শাক-সবজি সীমিত পরিসরে বিদেশে রপ্তানি করত এবং স্বল্প মূল্যের প্রয়োজনীয় পন্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করত।

স্যামস্যাং তেইগু শহরে ব্যবসা শুরু করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালের দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার ব্যাপক বিস্তৃত লাভ করে। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্যামসাং কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতা ভারী শিল্প হিসেবে চিনি কল ও তাত শিল্পে বড় ধরণের বিনিয়োগ করে এবং তাতে স্যামস্যাং ব্যাপক মুনাফা করে। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায় স্যামসাং এর তৈরি তাত ও কাপড় ফ্যাক্টরি ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় তাত বা কাপড় তৈরির কারখানা। আর এই ব্যবসাই মুলত স্যামস্যাং এর ভাগ্য বদলে দিতে শুরু করে এবং প্রতিষ্ঠানটির হাতে খুব অল্প সময়েই নতুন কোন খাতে বিনিয়োগ করার মতো বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে আসে।

স্যামস্যাং গ্রুপ আসলে ১৯৬০ সালের দিকে তাদের হেভী ইলেক্ট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রিজ হাব গড়ে তুলতে শুরু করে। তাছাড়া বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকেই স্যামস্যাং বিশ্ব চাহিদার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের ইলেকট্রনিক ডিভাইস, স্যামসাং ইলেকট্রো-মেকানিক্স, স্যামসাং করনিং, স্যামসাং সেমিকন্ডাক্টর এবং টেলিকমিউনিকেশন ডিভাইস তৈরির কারখানা দক্ষিণ কোরিয়ার সুয়োন শহরে স্থাপন করে এক নতুন যুগের সূচনা করে। আর সেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবে প্রথমে সাদা-কোলো টেলিভিশন উৎপাদন শুরু হয় এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এক মিলিয়ন ইউনিট সাদা-কালো টেলিভিশন তৈরি এবং বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করে এক বিরল রেকর্ডের সৃষ্টি করে। তার পাশাপাশি স্যামস্যাং ওয়াশিং মেশিন তৈরি এবং বিক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় স্যামস্যাং।

স্যামস্যাং ১৯৭৭ সাল থেকেই কালার টেলিভিশন উৎপাদন শুরু করে এবং একই বছর তারা কোরিয়ায় কনস্ট্রাকটিভ অ্যাাণ্ড কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিতেও প্রবেশ করে। ১৯৭৮ সালে স্যামস্যাং রঙ্গিন এবং সাদা-কালো মিলিয়ে মোট প্রায় চার মিলিয়ন ইউনিট টেলিভিশিন তৈরি করে এবং বিশ্ব বাজারে বিক্রয়ের এক নতুন মাইলফলক অর্জন করে। আবার ১৯৭৮ সাল থেকেই তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে মাইক্রো ওভেন, রেফ্রিজারেটরের বানিজ্যিক উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।

তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার একটি স্থানীয় টেলিফোন তৈরির কোম্পানি কিনে নিয়ে স্যামস্যাং উচ্চ প্রযুক্তির টেলিকমিউনিকেশন শিল্পের যুগে প্রবেশ করে। প্রথমে তারা বানিজ্যিকভাবে টেলিফোনের সার্কিট বোর্ড এবং টেলিফোন সেট তৈরি করত এবং ১৯৮০ সালের দিকে স্যামসাং ইলেকট্রনিকস নামক একটি স্বতন্ত্র শাখায় স্যামসাং রিসার্চ ও ডেভেলেপমেন্ট খাতে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করে এবং স্যামসাং একই সময়ে ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর দেশের বাহিরে পর্তুগাল, টোকিও, নিউ ইয়র্ক, অস্টিন, টেক্সাসে এসেম্বলী লাইনের নতুন শাখা স্থাপন করে।

১৯৮৭ সালের ১৯শে নভেম্বর স্যামস্যাং গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়াং চুল এর মৃত্যু হলে স্যামস্যাং গ্রুপ কার্যত চারটি বড় বিজনেস গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। এর মধ্যে স্যামসাং নামক একটি গ্রুপে মূলত ইলেকট্রনিক্স পন্য, কনস্ট্রাকশন, ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কিত সবকিছুকে স্হানান্তর করা হয়। তখন থেকে স্যামসাং কেবল ইলেকট্রনিক্স এর ওপর নতুনভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তাদের কনস্ট্রাকশন ডিভিশনটি মালয়েশিয়ায় দুই পেট্রোনাস টাওয়ার্স, তাইওয়ান-এর তাইপে ১০১ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বুর্জ খলিফার মত সর্ব বৃহৎ দালান এর কাজ করে এক নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে রেখেছে। স্যামসাং ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিসনটি স্যামসাং টেকউইন নামে পরিচিত। তারা বিশ্ব মানের জেট ইঞ্জিন ডিজাইন, উতপাদন এবং ডেভেলপমেন্ট করে থাকে।

১৯৮০ সাল থেকেই স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স কালার টিভি, ভিসিআর, ভিসিপি, পার্সোনাল কম্পিউটার, টেপ রেকর্ডার উৎপাদন শুরু করে এবং সারা বিশ্বে রপ্তানি করতে থাকে। তাছাড়া ১৯৮৯ সালে স্যামস্যাং বৃটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে একটি নতুন কোরিয়ান বিপি ক্যামিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ নামে। নব্বয়ের দশক থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামস্যাং কর্পোরেশন কম্পিটারের হার্ডসিস্ক, মেমোরি কার্ড এবং নিজস্ব কম্পিউটার উৎপাদনের কাজ শুরু করে দেয় এবং ১৯৯৯ সালে স্যামসাং তাদের প্রথম ইন্টারনেট ভিত্তিক মোবাইল ফোন বাজারে ছাড়ে। তাছাড়া ২০০০ সাল থেকেই বিশ্বমানের কম্পিটার এবং ল্যাপটপ বাজারে আনতে শুরু করে দেয় এবং ঠিক একই সময়ের মধ্যে উন্নত প্রযুক্তির এইচডি টিভি বাজারে আনে।

২০০১ সালে, বিশ্বের বৃহত্তম যাত্রীবাহী বিমান ইউরোপের বিখ্যাত এয়ারবাস এভিয়েশন কোম্পানির এ৩৮০ হেভি প্যাসেঞ্জার জেটে ব্যবহৃত রোলস রয়েস ট্রেন্ট ৯০০ জন্য কমবুস্টার মডিউলের একমাত্র সরবরাহকারী ছিল স্যামসাং টেকউইন এবং তার পাশাপাশি বোয়িং কর্পোরেশনের ড্রিমলাইনার ৭৮৭ জেনেক্স ইঞ্জিন প্রোগ্রাম তৈরীর একটি অংশ ডিজাইন ও তৈরির অংশগ্রহণকারীও ছিল স্যামসাং টেকউইন। আবার স্যামস্যাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইসেন্স নিয়ে নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে নিজস্ব প্রযুক্তির সমন্বয়ে বিশ্ব মানের এফ-১৬ এর মতো ডেডিকেটেড জেট ফাইটার তৈরি করে। তবে চুক্তি মোতাবেক দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামস্যাং এর তৈরিকৃত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তৃতীয় কোন দেশে রপ্তানি কিংবা হস্তান্তর করতে পারে না।

বৈশ্বিক পর্যায়ের বিজনেস ফরচুন ম্যাগাজিনের তথ্য মতে, দক্ষিণ কোরিয়া ভিত্তিক স্যামসাং জায়ান্ট কর্পোরেশনের করোনা মহামারির মধ্যে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়লেও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রেভিনিউ ছিল ২০০.৬০ বিলিয়ন ডলার, নীট মুনাফা ২০.৮৪ বিলিয়ন ডলার এবং তাদের মার্কেট ভ্যালু ৪৭৩.১৬ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া স্যামসং ২০১৮ সালে বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে এটি বিশ্বের ১৪ তম বৃহত্তম কোম্পানি হিসাবে নিজের যোগ্য স্থান করে নেয়। আবার স্যামসাং এর মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২৯৩.০০ বিলিয়ন ডলার। যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া চলতি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪৪.৮০ বিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানি করেছে এবং ৪২.২০ বিলিয়ন ডলারের পন্য ও সেবা আমদানি করেছে। যেখানে কিনা মাত্র ৫.১ কোটি জনসংখ্যার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া করোনা মরামারির ভয়াবহ বিপর্যায়ের মুখেও ২০২০ সালে মোট ৫১২.৫০ বিলিয়ন ডলারের পন্য ও সেবা সারা বিশ্বে রপ্তানি করেছে।

২০১০ সালের মোবাইল ওয়াল্ড কংগ্রেসে স্যামসাং তাদের ফ্লাগশীপ স্মার্টফোনের এস সিরিজের স্মার্টফোন এর নতুন যাত্রা শুরু করে এবং ঠিক একই বছর ২০১০ সালের শেষের দিকে তারা প্রথম সম্পূর্ণ কার্যকর এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম নির্ভর ট্যাবলেট বিশ্ব বাজারে ছেড়ে বিশ্বকে চমকে দেয়। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের এ্যাপলো কর্পোরেশনের তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে দামী স্মার্টফোন আইফোনের ডিসপ্লে এবং মাদারবোর্ড তৈরি ও সরবরাহ করে থাকে স্যামস্যাং কর্পোরেশন।

বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামস্যাং কর্পোরেশন সারা বিশ্বের মধ্যে একটি সফল বানিজ্যক প্রতিষ্ঠান এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি এশিয়া মহাদেশের সর্ব বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং ইণ্ডাস্ট্রিয়াল হাবের নাম আসলে স্যামস্যাং এর নাম সবার উপরে উঠে আসে। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার মোট বৈশ্বিক রপ্তানির এক পঞ্চমাংশ একাই নিয়ন্ত্রণ করে স্যামস্যাং। যা কিনা বাংলাদেশের মতো উদীয়মান উন্নয়শীল দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরগুলোর জন্য এক আদর্শ নজির হতে পারে। তাছাড়া লি বিয়াং চুল এর স্বপ্নের শিল্প প্রতিষ্ঠান স্যামস্যাং কর্পোরেশন তার দেশ ও জাতিকে শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিগত পাঁচ দশক থেকে নিবিড়ভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.