--- বিজ্ঞাপন ---

লিবিয়াঃ এক দেশ, দু’সরকার, সামনে কি গৃহযুদ্ধ

0

কাজী আবুল মনসুর / সিরাজুর রহমান

লিবিয়ার কথা উঠলেই গাদ্দাফির ছবিটি চোখের সামনে চলে আসে। সামরিক দিক দিয়ে বিভিন্নভাবে শক্তিশালী হয়েও লিবিয়ার শেষ রক্ষা হলো না। এক সময়ের লৌহ মানব বলে খ্যাত গাদ্দাফির নির্মম মৃত্যুর পর কার্যত দেশটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। কথিত আরব বসন্তের জোয়ারে ভেসে যায় লিবিয়ার মতো একটি সম্পদে পরিপূর্ণ দেশ। যে দেশটি মধ্যেপ্রাচ্যে বেশ আলোচিত ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের বদ নজরে পড়ে লিবিয়া ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে এক দেশে রাজত্ব করছে দু’সরকার।

রাশিয়ার স্পুটনিক নিউজের তথ্যমতে, গতকাল ২৯শে মে লিবিয়ায় রাশিয়া, ফ্রান্স, মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত হাফতারের এলএনএ মিলিশিয়া বাহিনী তাদের কাছে থাকা ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান এবং সামরিক সাজ সরঞ্জামের প্রদর্শন করে। তবে প্যারেডে তাদের হাতে থাকা ফ্লাইং কফিন খ্যাত একটি মিগ-২১ মহড়া চলাকালীন অবস্থায় আকাশেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং যুদ্ধবিমানটিতে থাকা পাইলট ঘটনাস্থলেই মারা যান।

লিবিয়ার সাবেক একনায়ক গাদ্দাফী বেঁচে থাকা অবস্থায় ২০১০-১১ সাল পর্যন্ত লিবিয়ার বিমান বাহিনীতে মিগ-২১ ছিল ২২০টি, মিগ-২৩ ছিল ১৩০টি, মিগ-২৫ ছিল ১২৫টি এসইউ-২২ ছিল ৫০টি, এসইউ-২৪ ছিল ৬০টি, জি-২ ছিল ১১৬টি, মিরেজ-৫ ছিল ৮০টি এবং মিরেজ এফ-১ ছিল ১২০টি। সব মিলিয়ে কাগজে কলমে গাদ্দাফীর বিমান বাহিনীতে মোট ৯০১টি যুদ্ধবিমান ছিল। অথচ রাশিয়া এবং চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মান সম্মত কোন যুদ্ধবিমান সংগ্রহের কোন উদ্যোগ নেয়নি গাদ্দাফি প্রশাসন। যার ফলাফল ঠিক হাতে নাতেই পেয়ে গেছে ২০১০-১১ সালে চলা গৃহযুদ্ধে।

পশ্চিমা বিশ্বের উস্কানী এবং আরব বিশ্বের বিশ্বাসঘাতকতায় আরব বসন্তের জোয়ারে ২০১০ সালে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে গাদ্দাফির শাসনের পতন হতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। পাশ্চিমা বিশ্বের রাফাল, ইউরোফাইটার তাইফুন এবং এফ-১৬ কিংবা এফ-১৫ এর ব্যাপক আগ্রাসনের মুখে লিবিয়ার গাদ্দাফীর বিমান বাহিনীর হাতে থাকা এই জাতীয় নিম্ন মানের এবং অকার্যকর যুদ্ধবিমান এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নুন্যতম কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। যার চূড়ান্ত ফলাফল গাদ্দাফীর শাসনের পতন, মৃত্যু এবং দীর্ঘ মেয়াদে লিবিয়ার ধ্বংস দেখেছে বিশ্ব। অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদি অস্থিতিশীল যুদ্ধ পরিস্থিতির দায় এখনো পর্যন্ত দেশটির নিরাপরাধ নাগরিকদের বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

লিবিয়া আফ্রিকার বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলোর একটি। আকারে বিশাল হলেও জনবসতি খুবই কম। দেশের বেশির ভাগ অংশজুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। লিবিয়ার প্রায় সব লোক বাস করে উপকূলবর্তী অঞ্চলে। লিবিয়ায় কার্যত এখন দুটি সরকার। একটি জেনারেল হাফতারের বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চলীয় ‘ওয়ারলর্ড’; অপরটি জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত ‘ত্রিপলি সরকার’। এই সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সাররাজ। জেনারেল হাফতারের প্রতি সমর্থন রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, মিসর, রাশিয়া ও সৌদি আরবের। বছর চারেক আগে দেশটিতে আরো কয়েকটি সরকার ছিল। কারো ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ২০১১ সালে আরব বসন্তের প্রভাবে বিক্ষোভ ও গৃহযুদ্ধে লিবিয়ার দীর্ঘকালীন শাসক মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফির পদচ্যুতি ও নিহত হওয়ার পর দেশটি দু’পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

জাতিসংঘ স্বীকৃত লিবিয়ার সরকার রাজধানী ত্রিপোলিসহ দেশটির পশ্চিমাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। অন্যদিকে বেনগাজিকে কেন্দ্র করে মিসর, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থিত বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনী দেশটির পূর্বাঞ্চলের দখল নেয়।

জেনারেল হাফতার গত চার দশক ধরেই লিবিয়ার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই চার দশকে তার অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। কখনো তিনি ছিলেন লিবিয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রের কাছাকাছি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আবার কখনো তাকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। পরে আবার তার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে ক্ষমতার কেন্দ্রে।

১৯৪৩ সালে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর আজডাবিয়ায় খালিফা হাফতারের জন্ম। ১৯৬৯ সালে কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সেনা কর্মকর্তারা রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। গাদ্দাফির শাসনামলে হাফতার বেশ দ্রুত উপরের দিকে উঠে যান। ১৯৮০’র দশকে লিবিয়ার বাহিনী যখন প্রতিবেশী দেশ চাদে সঙ্ঘাতে লিপ্ত, তখন তাকে সেই লড়াইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে এটিই হাফতারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ফ্রান্সের সমর্থনপুষ্ট চাদ বাহিনীর হাতে তার বাহিনী পরাজিত হয়। চাদে এই বাহিনী পাঠানোর কথা গাদ্দাফি বরাবরই তা অস্বীকার করছিলেন। কাজেই যখন হাফতার ও তার বাহিনী চাদের সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন, গাদ্দাফি তাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। এটি জেনারেল হাফতারকে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ করে। পরের দুই দশক ভার্জিনিয়ায় নির্বাসিত হয়ে তিনি গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কৌশল বের করার চেষ্টা করেন। তিনি থাকতেন সিআইএ’র সদর দফতরের খুব কাছে। তার সাথে সিআইএ’র বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলেই মনে করা হয়। গাদ্দাফিকে হত্যার বেশ কয়েকটি চেষ্টায় সিআইএ তাকে সমর্থন দেয়।

২০১১ সালে লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। জেনারেল খালিফা হাফতার এ সময় দেশে ফিরে আসেন। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তবে গাদ্দাফির পতনের পর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাফতারের কথা আর তেমন শোনা যায়নি। ২০১৪ সালে হঠাৎ আবার তাকে দেখা যায় টেলিভিশনে। সেখানে তিনি তার ভাষায়, জাতিকে রক্ষার এক পরিকল্পনা হাজির করেন ও নির্বাচিত পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। তবে তার পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন ছিল না। এ সময় তার প্রতিপক্ষ হয় লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজি এবং পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য শহরের নিয়ন্ত্রণকারী আলকায়েদার সহযোগী সংগঠন আনসার আল শরিয়া।

ওই বছর মে মাসে জেনারেল হাফতার বেনগাজি এবং লিবিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে উগ্রবাদী আনসার আল শরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। শুরুতে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা বেনগাজির বেশির ভাগ এলাকা থেকে উগ্রবাদীদের হটিয়ে দেয়। মে মাসে তারা আরো সাফল্য পায়। সেপ্টেম্বরে গুরুত্বপূর্ণ তেল টার্মিনালগুলোর দখল নেয় হাফতার বাহিনী। এর আগ পর্যন্ত টার্মিনালগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিল জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত বাহিনী। লিবিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব তেল টার্মিনাল তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় হাফতারের নেতৃত্বে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর চারপাশে হাফতারের বাহিনী এবং প্রধানমন্ত্রী সাররাজ সরকারের মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বোঝাই যাচ্ছে, দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের তদন্তকারীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর হিফতারকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে।  সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানের সাথে দেখা করার পর হাফতার আরো আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন। এসব শক্তিধর রাষ্ট্রের অব্যাহত হস্তক্ষেপের কারণে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য জাতিসঙ্ঘের চেষ্টা শেষ হয়ে যেতে বসেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিপোলির সরকারকে সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিস্পৃহতা ও হাফতারের প্রতি ওই সব শক্তিধর রাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন লিবিয়াকে আরো বড় ধরনের দ্বন্দ্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। # সূত্রঃ নয়াদিগন্ত

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.